মাসউদুর রহমান
তোমার রূপকথার গল্পগুলো
পথ
দীর্ঘ এক পথ, যোজন যোজন লম্বা। অনতিক্রম্য মহাদৈর্ঘের এ পথ। পথের দু’দিকের দু’টি শেষ বিন্দুতে দু’জন ব্যক্তি দাঁড়িয়ে- আমি আর তুমি। দূরত্ব এত যে, কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
কিন্তু আমরা একে অপরকে অনুভব করতে পারছি। তাই আমি যখন এক কদম হেঁটে সামনে গেলাম, আমি বুঝতে পারলাম আমাদের দূরত্ব দু’কদম কমে গেছে। হঠাৎ মনে হলো, এভাবে পথ কি কখনো শেষ হবে? না আমরা কেউ কাউকে দেখতে না পাওয়ার বেদনা নিয়ে মাঝ পথে মাটিতে মিশে যাবো? আমি জানি, তুমিও তাই ভাবছো। অনতিক্রম্য এই দূরত্ব আমাকে এবং তোমাকেও দ্বিধান্বিত এবং হতাশাগ্রস্ত করে তুলছে। কিন্তু আমরা তো পরস্পরকে ভালোবাসি। কেউ কাউকে পাই আর না পাই, দেখি আর না দেখি, তাতে কী? আমাদের ভালোবাসা আমাদের ব্যথা উপশম করবে, আমাদের না পাওয়াকে পুষিয়ে দেবে, অ-দেখাকে মানিয়ে নেবে। তুমিও নিশ্চই এভাবেই ভাবছো আর এ-ও ভাবছো যে ফিরে যাবে, কারণ আমিও যে ফিরে যাবার কথা ভাবছি।
ভাবতে ভাবতে মনের কোণে এক টুকরো বেদনা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। আমার সামনে মাটিতে এক জোড়া পা দেখতে পেলাম। দৃষ্টিটা ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে তুলতে তুলতে এক জোড়া হাত, একটা শরীর আবিষ্কার করলাম আমার সামনে। দেখলাম আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছো তুমি এবং আমিও তোমার দিকে।
কী আশ্চর্য! পৃথিবীটা যে গোল সেটা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম!
আজ্ঞাবাহী
নারী ও পুরুষের প্রেমের মাধ্যমে আমার জন্ম হয়নি, আমার জন্ম ঈশ্বরের হাতে, অনেকটা আদমের সৃষ্টির মতো। তবে আমাকে সৃষ্টির প্রতিটি প্রক্রিয়ার শেষেই ঈশ্বর আমাকে একবার করে জিজ্ঞেস করতেন, “ভেবে দেখো, জন্মাবে কিনা, তুমি যদি না চাও, তবে তোমার জন্ম প্রক্রিয়া এখানেই বন্ধ করে দিই।” আমার সর্বদা একটাই উত্তর ছিল, “না, আমি জন্মাতে চাই।” এভাবে এক বিন্দু জমাট রক্ত থেকে এক টুকরা মাংস, মাংসের ভেতরে হাড়-গোড়, ধীরে ধীরে হাত-পা এবং এক সময় এই পূর্ণ ‘আমি’টার জন্ম হয়। জন্মাবার পর ঈশ্বর আমাকে তোমার কাছে পাঠালেন, তোমার অধীন করে। আমার ভাগ্যলিপিতে ঈশ্বর এটাই লিখে দিয়েছিলেন। এখন তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। আমার মুখ দিয়ে এখন যে কথা বেরোয়, তা আসলে তোমার কথা। আমার নিজের কোন দাবি নেই, তোমার যেটা দাবি সেটা আমারও। তুমি গাইতে বললে আমি গাই। তুমি যখন হাসো, তোমাকে খুশি করার জন্য আমিও হাসি, কারণ তোমার খুশিতে যে আমাকেও খুশি হতে হয়। আমার নিজের কোন চাওয়া-পাওয়া নেই, দিন-রাত নেই, স্বপ্ন নেই, বাস্তবতা নেই, তোমার যা আজ্ঞা, তা-ই আমার আজ্ঞা। তোমার থাকলে আমার আছে, তোমার না থাকলে আমারও নেই। ঈশ্বর আমার ভাগ্য খাতায় এটাই লিখে রেখেছেন। তুমিও আমার উপর প্রচণ্ড খুশি। এরকম পরম আজ্ঞাবাহী কি আর পাওয়া যায়!
জানি না তুমি খুশি হয়ে ঈশ্বরকে কখনো ধন্যবাদ দিয়েছো কি না। যদি না দিয়ে থাকো, তবে ভালো করেছো। কারণ ঈশ্বর আমার কপালে আরো একটা কাজ নির্ধারণ করে রেখেছেন- আমার হাতে তোমার মৃত্যু।
গল্প
ধরো, আমরা দু’জন সামনা-সামনি বসে আছি, গল্প করবো। ঠিক হলো, আজ তুমি গল্প করবে আর আমি শুনবো। আবার ধরো, আমি অন্য কোনো একদিন তোমাকে গল্প শুনিয়েছিলাম, তাই আজ তোমার পালা। তুমি শুরু করলে তোমার গল্প, বললে, “ভাবো,” আমি বললাম, “কি ভাববো?” তুমি বললে, “ভাবো, একটা সিংহের খাঁচা একপাশে আর একটা বাঘের খাঁচা অন্যপাশে। মাঝখানের শূন্য জায়গাটাতে তুমি।” আমি খুব আগ্রহে কান পাতলাম। আমার আগ্রহ দেখে তুমি ভাব নিলে, “থাক, এটা আজ আর না বলি।” “কেন? আজই বলতে হবে,” আমি প্রতিবাদ করলাম। “ঠিক আছে, ঠিক আছে, শোন।” তুমি মৃদু হাসলে। তুমি ফের শুরু করলে, “তোমাকে আমি বললাম, বাঘ কিংবা সিংহ যে কোন একটা খাচায় তোমাকে প্রবেশ করতে হবে। তুমি কোনটাতে যাবে?” তুমি আমাকে প্রশ্ন করলে। “ক্ষুধার্ত বাঘ, ক্ষুধার্ত সিংহ, একই কথা। তুমি যেটাতে ফেলতে চাও।” আমি হেসে উত্তর দিলাম। তুমি কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললে, “বাঘের খাচায়। কিন্তু সেখানে পাঠানোর আগে আমার সঙ্গীরা তোমার হাত-পা বেঁধে ফেলবে। তারপর তোমাকে সেখানে নিক্ষেপ করবে।” আমি হাসলাম, বললাম, “বেশ।” তোমার গলা খাদে নামিয়ে, কণ্ঠে আরো বেশি গভীরতা এনে, চেহারায় আরো বেশি কাঠিন্য এনে, তুমি আমার খুব কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলে, “তোমাকে একটা প্রশ্ন করবো?” “করো।” আমি বড় বড় চোখে বললাম। তুমি শুরু করলে, “আমি তোমাকে দু’টি পছন্দ দেবো, এক, বাঘের খাচায় গিয়ে আপোসে তুমি বাঘের খাদ্য হয়ে যাবে, দুই, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তুমি বাঘের সাথে লড়াই করবে।” তোমার গলার স্বর অদ্ভুতভাবে কাঁপছিল। আমি স্থির দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকালাম। তুমি দু’চোখ বন্ধ করে ফেললে, মনে হয় আমার উত্তর শুনতে ভয় পাচ্ছো। “আমি বাঘের সাথে লড়াই করবো, হাত-পা বাঁধা অবস্থায়।” তোমার বন্ধ করা চোখ দু’টির দিকে তাকিয়ে আমি বললাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে তুমি চোখ খুললে। উঠে দাঁড়ালে এবং ফিরে গেলে। পেছন ফিরে বলে গেলে, “কোন বোকা লোকের সাথে আমার বন্ধুত্ব থাকতে পারে না।”
কাঙ্খার পাপে
ওদের দু’জনেরই বয়স ৩০। কিন্তু তাদের একজন বিবাহিত, অন্যজন অবিবাহিত। দুইজনই গেল ঈশ্বরের কাছে, একটা প্রার্থনা করতে। প্রথমে গেল অবিবাহিতজন। ঈশ্বর জানতে চাইলেন, “তোমার কী আবেদন পেশ করো।” অবিবাহিত বললো, “পৃথিবীর সবচে’ সুন্দরী কুমারীটি আমাকে দিন।” “তাকে তোমার কী প্রয়োজন?”- ঈশ্বর প্রশ্ন করলেন। অবিবাহিত উত্তর দিলো, “এ আমার সারা জীবনের স্বপ্ন।” ঈশ্বর বিরক্ত হলেন, “এটা কি একজন মানুষের সারা জীবনের স্বপ্ন হতে পারে? ঠিক আছে, পৃথিবীর সবচে’ সুন্দরী কুমারীটি আমি তোমাকে দিলাম। তবে এ জন্য তোমাকে আরো আঠারো বছর অপেক্ষা করতে হবে”- ঈশ্বর শর্ত দিলেন। “আমি প্রতীক্ষা করতে রাজী আছি”- দৃঢ় কণ্ঠে অবিবাহিত উত্তর দিল এবং ফিরে গেল।
এবার বিবাহিত এলো ঈশ্বরের কাছে। ঈশ্বর তার কাছেও জানতে চাইলেন, “কী আবেদন তোমার, পেশ করো।” অত্যন্ত বিনীত হয়ে সে চাইলো, “পৃথিবীর সবচে’ সুন্দরী কুমারীটি আমায় দিন।” ঈশ্বর বাঁকা চোখে চেয়ে বললেন, “কিন্তু তুমি তো বিবাহিত?” “আমি আমার স্ত্রী’র উপর সন্তুষ্ট নই”- বিবাহিত উত্তর করলো। ঈশ্বর মৃদু হাসলেন। তারপর অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে বিবাহিতকে দেখলেন। বললেন, “ঠিক আছে, পৃথিবীর সবচে’ সুন্দরী কুমারীটি আমি তোমাকে দিলাম।” বিবাহিতজন অত্যন্ত খুশি হয়ে ফিরে গেল।
...কিছুদিন পর, বিবাহিতের স্ত্রী একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিলো। তার মুখ দেখে বিবাহিত খুব দুঃখ পেল। বুঝতে পারলো, ঈশ্বর তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছেন। ১৭ বছর পর মেয়েটির মা-বাবা এক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে। তার ১ বছর পর পিতৃ-মাতৃহীন অসহায় ঐ মেয়েটিকে তার আত্মীয়-স্বজনেরা তার চে’ ৩০ বছরের বড় প্রায় বৃদ্ধ এক লোকের সাথে বিয়ে দেয়। এটি ছিলো লোকটির প্রথম বিয়ে।
ঈশ্বর! দয়া করে বলবেন কি, মেয়েটার কী অপরাধ ছিল?
একটি মৃত্যু সংবাদ
ধরো, তুমি একটা গাছ হলে আর আমি এক পথিক। মনে করো, সময়টা মধ্য দুপুর। সুর্যটা তার সবটুকু প্রাণশক্তিকে আমার মাথায় ঢেলে দিচ্ছিল। আমার পক্ষে আর পথচলা সম্ভব হচ্ছিল না। আমি যখন তোমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তুমি আমায় ডাকলে, “পথিক, বসে যাও দু’দণ্ড। আমার ছায়ায় তোমার ভালো লাগবে।” ঘামে সিক্ত শরীরটা নিয়ে আমি তোমার শেকড়ে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম, যেন তোমার কোলে মাথা রেখেছি। তুমি তোমার ডালপালাগুলো অনেক নিচে নামিয়ে আনলে যাতে ছায়াটা আরো বেশি গাঢ় হয়। তোমার পাতাগুলো আলতো আলতো দোলাতে লাগলে, মনে হলো আমার মাথায় যেন তুমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছো। মৃদু বাতাস তোমার পাতার ফাঁক দিয়ে যাবার সময় এমনভাবে শব্দ উৎপাদন করছিলো, মনে হয় তুমি আমার কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বলছো। আমি চোখ বুজে কান পেতে রইলাম। “কতদূর যাবে?”- তুমি জানতে চাইলে। “জানি না”- ক্লান্ত স্বরে আমি বললাম। “জানো না!”- তুমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে। “না”- আমি অস্ফুট স্বরে বলতে লাগলাম, “শুধু জানি, এ পথ ধরে আমাকে চলতেই হবে।” “এত কষ্ট করে কী লাভ? আমার কাছে থেকে যাও, আমি তোমাকে পরম শান্তিতে ঘুম পাড়িয়ে রাখবো, রৌদ্র-তাপ তোমাকে স্পর্শও করতে পারবে না, তোমার শরীরে কখনো ক্লান্তি আসতে দেবো না, তোমার প্রশান্তির জন্য যা যা প্রয়োজন, তা-ই তোমাকে আমি দেবো। তুমি কেবল আমার কাছে থেকে যাও”- এক নিঃশ্বাসে তুমি সবটুকু কথা বললে, যেভাবে প্রচণ্ড নেশাগ্রস্ত কেউ এক নিঃশ্বাসে একটা বোতল খালি করে ফেলে। আমার চোখে ততক্ষণে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছে। আমি ঘুম জড়ানো কণ্ঠে তোমাকে বললাম, “নাহ্। সেটা সম্ভব না, আমাকে যেতেই হবে।” তুমি কিছুই বললে না। একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলে। প্রচণ্ড ঝড়ের আগে প্রকৃতি যেভাবে শান্ত হয়ে যায় সেভাবেই তুমি নিরব-নিস্পন্দ হয়ে গেলে। আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কারণ তুমি যে মাতৃময়ী, সেটা আমার জানা ছিল। কিন্তু তুমি যে রাক্ষসী সেটা আমার জানা ছিল না। যখন জানতে পেরেছিলাম, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, আমার আর কিছুই করার ছিল না...
পরিশিষ্ট : সেদিন বিকেলে নদীর ধারের মাটির রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় বড় গাছটার নিচে সবাই একটা লাশ পড়ে থাকতে দেখলো। লোকটা হয়তো বিশ্রাম নিচ্ছিল, প্রচণ্ড বাতাসের তোড়ে গাছটার একটা বড় ডাল লোকটার মাথার উপর ভেঙ্গে পড়ায় তার মাথাটা একেবারে থেতলে গিয়েছিল। এতেই তার মৃত্যু হয়। স্থানীয় সংবাদপত্রে খবরটা এভাবেই ছাপা হয়।
(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/ এমডি/ নভেম্বর ১৯, ২০১৩)