দিরিপোর্ট ডেস্ক : ফিলিপাইনি নারী জিনা লাডরেরা হংকংয়ে গৃহকর্মীর কাজ করেন। তবে তার পরিবারের অন্য সদস্যরা ফিলিপাইনেই থাকেন। ঘরে তার স্বামী, দুই সন্তান আর শ্বশুর-শাশুড়ি রয়েছেন। স্বামী পেশায় একজন নিরাপত্তারক্ষী। তাই আরেকটু সচ্ছলতার আশায় তিনি হংকংয়ে পাড়ি জমিয়েছেন। সব কিছুই ভালো চলছিল। কিন্তু ৮ নভেম্বর ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হাইয়ানের আঘাতে তার সাজানো পরিবার যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল।

তিনি তার পরিবারের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ হারালেন। চিন্তায়, অস্থিরতায় শেষ পর্যন্ত তিনি হংকং থেকে ফিলিপাইনে চলে আসলেন। খুঁজে পেলেন পরিবারকে। সিএনএন প্রতিবেদনের ছায়া অবলম্বনে আরও জানাচ্ছেন আহাম্মদ উল্লাহ সিকদার।

শুক্রবার, ৮ নভেম্বর সকাল বেলা ফিলিপাইনে আঘাত হানে সুপার টাইফুন হাইয়ান। সর্বশেষ পাঁচদিন আগে স্বামী পেড্রো লাডরেরা ও সন্তানদের সঙ্গে কথা হয় জিনার। কিন্তু এরপর থেকেই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ নেই। এইভাবে পাঁচদিন যোগাযোগহীন থাকার পর অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে তিনি ফিলিপাইনে তার পরিবারকে খুঁজতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার এই যাত্রা কী সহজ হবে? খুঁজে কী পাবেন স্বজনদের? কিছুই জানা নেই তার।

অজানা সেই যাত্রায় তিনি কিছু খাবার, পানি, তাবু ও ঘুমানোর ব্যাগ নিয়ে হংকং থেকে চেবু শহরের উদ্দেশে বিমানে চড়ে বসেন।

একটা সময় তিনি চেবুতে পৌঁছাতে সক্ষম হন। এরপর চেবু থেকে তাকলোবান হয়ে তানাউয়ান শহরে পৌঁছান। যেখান থেকে বাড়ি আরও ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণের একটি শহরে। শেষপর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়িতে করে তিনি তার বাড়িতে পৌঁছাতে সক্ষম হন এবং তার পরিবারকে খুঁজে পান।

ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, টাইফুন হাইয়ান আঘাত হানার আগের দিন ওদের সঙ্গে আমার শেষবারের মতো কথা হয়েছিল। আমার স্বামী আমাকে বলেছিল, কোন চিন্তা করো না। আমাদের কিছুই হবে না। এ সময় তিনি কাদতে কাদতে বলেন, ওদের সঙ্গে এটাই ছিল আমার শেষ কথা।

আমি ওদের সেখান থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু আমার স্বামী জানত না যে, টাইফুন হাইয়ান এত ভয়াবহ হবে। আমি জানি না তারা অন্যত্র চলে গিয়েছিল কিনা। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারিনি।

তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার স্বামী এবং মেয়ের মোবাইলে কল দিয়েছি। কেউ আমার কল ধরেনি। এমনকি শুক্রবার বিকেলের পর থেকে মোবাইলে ওদের আর পাওয়া যাচ্ছিল না।

আমি ফিলিপাইনে, আমার প্রতিবেশী এমনকি পরিচিত কারও কাছ থেকেও ওদের কোন খবর পাচ্ছিলাম না। এরই মধ্যে কয়েকদিন পর হংকংয়ে ফিলিপাইন কনস্যুলেটও আমার পরিবারের খোঁজ দিতে ব্যর্থ হয়।

আমি আমার বাড়িতে গিয়ে দেখি, সেখানে আর কোনও কিছুই অবশিষ্ট নেই। আমার স্বামী ধ্বংসাবশেষের মধ্যে একটা অস্থায়ী কুড়ে ঘরের মতো তৈরি করে বসবাস করছে। তবে ওরা আমাকে দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। ওরা ভাবতেও পারেনি যে ওদের সাথে আমার আবার দেখা হবে। ওরা আমাকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলে। বাচ্চারা বুঝতে পারছিল না, ওদের কেমন অনুভূতি হচ্ছিল। আমি অনেক সৌভাগ্যবান কারণ আমি ওদের খুঁজে পেয়েছি।

টাইফুন হাইয়ান আঘাত হানার সময় জিনার স্বামী, সন্তান এবং তার শ্বশুর-শাশুড়ি ঘরের ছাদের উপর একটি বৈদ্যুতিক তারের সাহায্যে ঝুলে ছিল। চারদিক থেকে বাড়িঘরের বিভিন্ন সামগ্রী বাতাসে উড়ে এসে ওদের শরীরে লাগছিল। কিন্তু তাদের চারপাশে যে ধরনের তাণ্ডবলীলা ঘটেছে সেই তুলনা সে আঘাত খুবই সামান্য।

কয়েকজন প্রতিবেশী তাদের শুকনো কাপড় এবং একদিন পর একজন তাদের কিছু খাবার ও পানি দেয়। যখন জিনা বাড়ি পৌঁছায় তখন ওদের কাছে আর কোন খাবারই অবশিষ্ট ছিল না। জিনা তার সঙ্গে করে আনা খবর তার পরিবারের সদস্যদের দেয় এবং সবাইকে নিয়ে তাকলোবানের উদ্দেশে রওনা দেয়। সেখান থেকে তারা চেবুর উদ্দেশে একটি প্লেনে চড়ে বসে।

এরপর সেখান থেকে ম্যানিলা হয়ে তারা জিনার মায়ের বাড়ি লুজানের দিকে রওনা দেয়। জিনা বলেন, বাচ্চারা খুব ভয় পেয়েছিল। ওরা ঘুমের মধ্যে না, না বলে চিৎকার করে উঠছিল।

একটু আর্থিক সচ্ছলতার জন্য বিদেশ পাড়ি জামানো শত শত নারীর মত জিনাও একজন। তবে ফিলিপাইনে হাইয়ান আঘাত হানার পর তিনি ভাবতেও পারেননি যে, তার পরিবারের সঙ্গে আবারও তিনি মিলিত হতে পারবেন।

কিন্তু জিনার সামনে এখন অনেক কাজ। কারণ সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হবে। তাই আবারও তিনি হংকংয়ে তার কর্মস্থলে ফিরে যাচ্ছেন। আর পেছনে ফেলে যাচ্ছেন তার পুরো পরিবার।

(দিরোপর্ট/আদসি/এমএআর/নভেম্বর ২০, ২০১৩)