সুফিয়া কামাল
দিরিপোর্ট ডেস্ক : বাংলাদেশের অন্যতম প্রথিতযশা মহিলা কবি, লেখিকা, নারীবাদী ও নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ‘সুফিয়া কামাল’ এর ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকী বুধবার। ২০ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে ঢাকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম।
নারী জাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব কবি সুফিয়া কামালের মৃত্যুদিবসে সবার পক্ষ থেকে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সুফিয়া কামালের জন্ম ১৯১১ সালের ২০ জুন মামার বাড়ি শায়েস্তাবাদে। তার পিতার নাম সৈয়দ আবদুল বারী। পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবী। তার মাতার নাম সাবেরা বেগম। তার পৈত্রিক নিবাস কুমিল্লার (বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার) শিলাউর গ্রামে।
সুফিয়া কামাল যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেন তখন বাঙ্গালি মুসলিম নারীদের গৃহবন্দি জীবন কাটাতে হতো। কোনো মেয়ের স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ ছিল না। পরিবারে বাংলা ভাষার প্রবেশ এক রকম নিষিদ্ধ ছিল। সাধারণভাবেই সুফিয়া কামালও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো সুযোগ পাননি। মা সাবেরা বেগমের কাছে পড়তে শেখেন।
সুফিয়া কামালের বারো বছর বয়সেই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে প্রথম বিয়ে হয়। বিয়ে পরবর্তী জীবনে স্বামী নেহাল হোসেনই তাকে সাহিত্য পাঠে আগ্রহী করে তোলেন।
১৯৩২ সালে স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে তাকে আর্থিক সংকটের মুখে পড়তে হয়। আর্থিক সমস্যা সমাধানে তিনি শিক্ষকতার পেশা বেছে নেন। ১৯৩২ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত কলকাতা কর্পোরেশন প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন তিনি।
১৯৩৯ সালে কামালউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। সুফিয়া নামের সঙ্গে যুক্ত হয় স্বামী কামাল নামের অংশ বিশেষ। তখন থেকেই সুফিয়া কামাল নামে তার নতুন পরিচিতি ঘটে।
১৯২৩ সালে তিনি প্রথম গল্প রচনা করেন ‘সৈনিক বধূ’। যা বরিশালের তরুণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৬ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ প্রকাশিত হয়। ১৯২৯ সালে তিনি বেগম রোকেয়ার ‘আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম’ এ যোগ দেন। ১৯৩১ সালে বেগম সুফিয়া কামাল মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম ইন্ডিয়ান মহিলা ফেডারেশনের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। যার ভূমিকা লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থ পড়ে নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রশংসা করেছিলেন।
বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে। তিনি যাবতীয় অন্যায়, দুর্নীতি ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার এক সমাজসেবী ও নারীনেত্রী ছিলেন। বাংলার মানুষ তাকে ‘জননী সাহসিকা’ উপাধিতে ভূষিত করে।
কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি স্বপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে নারীদের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি তিনি নিজেও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবি জানান। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারকর্তৃক রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। ওই বছরেই তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন, পাকিস্তান সরকারকর্তৃক ইতিপূর্বে প্রদত্ত তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক বর্জন করেন।
১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে নারীজাগরণ আর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, কার্ফ্যু উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেছেন। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।
তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে- সাঁঝের মায়া, মায়া কাজল, মন ও জীবন, শান্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী, দিওয়ান, মোর জাদুদের সমাধি পরে প্রভৃতি। গল্পগ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’। ভ্রমণকাহিনী ‘সোবিয়েত দিনগুলি’। স্মৃতিকথা ‘একাত্তুরের ডায়েরি’।
সুফিয়া কামাল ৫০টিরও অধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। তার মধ্যে বাংলা একাডেমি, সোভিয়েত লেনিন, একুশে পদক, বেগম রোকেয়া পদক, জাতীয় কবিতা পুরস্কার, স্বাধীনতা দিবস পদক উল্লেখযোগ্য।
(দিরিপোর্ট/এমএইচও/এমএআর/নভেম্বর ২০, ২০১৩)