প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলের একদম শুরু থেকেই দুই ভাগে বিভক্ত ফুটবল বিশ্ব। একদিকে লাতিন আমেরিকা অন্যদিকে ইউরোপ। দুই ঘরানার ফুটবলের দর্শনটা একদমই বিপরীতমুখী। লাতিনরা ঐতিহ্যগতভাবে মুক্তছন্দের কবিতার মতো। ফুটবলাররা খেলার মাঠে যেন পাখি হয়ে উড়তে চায়। বল পায়ে পড়লেই ছড়িয়ে দিতে থাকে নান্দনিক সৌন্দর্যের সৌরভ। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝলক দিয়ে জয় করে নেয় ফুটবল অনুরাগীদের হৃদয়। আক্রমণ গড়ে তোলে অনায়াস দক্ষতায়। নিজের খেলাটাই খেলে মনের আনন্দে। প্রতিপক্ষের কৌশল ও চাতুর্যতা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। যে কারণে কাউন্টার অ্যাটাকে বিপদেও পড়ে যায়। এটাকে তারা আমল দিতে রাজি নয়। লাতিনদের জাতিগত বৈশিষ্ট্যই এমন। যা কিছু করে হৃদয় দিয়ে করে। আবেগটাকে সংবরণ করতে পারে না। সহজাতভাবেই ফুটবল মাঠে তার প্রতিফলন দেখা যায়।

পক্ষান্তরে, ইউরোপের ফুটবলটা হচ্ছে হিসাবি খেলা। এখানে মনের কোনো কারবার নেই। শৃঙ্খলা মেনে মেপে মেপে খেলতে হয়। খেলার পরিমাপ করা হয় জয়-পরাজয় দিয়ে। জয়ের জন্য সব রকম কৌশলই প্রয়োগ করতে দ্বিধা করে না। প্রতিপক্ষকে অবাধে ছুটে চলার কোনো রকম সুযোগই দিতে চায় না। দলগত ক্রীড়াশৈলী দিয়ে খেলায় আধিপত্য বিস্তার করে। এত বেশি সতর্কতা, এত বেশি সাবধানতা অবলম্বন করে, খেলাটাই হয়ে উঠে যান্ত্রিক। তারা মনে করে, জিততে হলে আবেগ কিংবা হৃদয়ের মতো বায়বীয় ব্যাপারকে মোটেও পাত্তা দেওয়া যাবে না। জাতিগতভাবেই ইউরোপীয়রা এমন। আর এ কারণে দুনিয়াকে তারা বরাবরই রাখতে পেরেছে হাতের মুঠোয়।

ফুটবলের অনেক বিবর্তন হলেও ঘরানা কিন্তু খুব একটা বদলায়নি। যদিও উভয় ঘরানায় সংমিশ্রণ ঘটেছে। অবশ্য বিশ্বায়নের এ যুগে এই সংমিশ্রণ হতেই পারে। লাতিন ঘরানার ফুটবলাররা ইউরোপীয় দেশের বিভিন্ন লিগে নিয়মিত খেলেন। তাদের খেলায় ইউরোপীয় মেজাজ-মর্জির ছাপ পড়াটা অস্বাভাবাবিক নয়। পক্ষান্তরে লাতিন ফুটবলারদের সঙ্গে খেলতে খেলতে ইউরোপীয় ফুটবলারদের খেলায় তার প্রভাব পড়ে থাকে। এ কারণে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো লাতিন ঘরানার প্রধান দলগুলোকে এখন রক্ষণভাগকে আঁটসাঁট করার দিকে মনোযোগ দিতে দেখা যায়। আর স্পেন, হল্যান্ডের মতো ইউরোপীয় দেশগুলো আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে সৌন্দর্যপিয়াসীদের মন জয় করে নিতে পেরেছে। এমনকি জার্মানির মতো গোঁড়া ও রক্ষণশীল দলকেও দেখা যায় এ ধরনের ফুটবল চর্চা করতে। সময়ের দাবিতে যুগপৎভাবে দুই ঘরানায় লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া।

পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলেও লাতিন এবং ইউরোপীয় ঘরানার মধ্যে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা বরাবরই চলে আসছে। আর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার হিসেব-নিকাসটা বেশি হয় বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে। এযাবৎ অনুষ্ঠিত ১৯টি বিশ্বকাপে সাফল্যের পাল্লা ভারি ইউরোপের। ইউরোপীয়রা ১০ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ইতালি ৪, পশ্চিম জার্মানি ৩, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও স্পেন ১ বার করে। লাতিন আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ৯ বার। ব্রাজিল ৫, আর্জেন্টিনা ২ ও উরুগুয়ে ২ বার। রানার্স-আপ হওয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের আধিপত্য একচেটিয়া। ইউরোপ ১৫ এবং লাতিন আমেরিকা ৪ বার। ইউরোপীয় কোনো দেশ ফাইনালে খেলেনি, এমন ঘটনা ঘটেছে মাত্র ২ বার। সেটাও অতীতের ঘটনা। ১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপে স্বাগতিক উরুগুয়ে-আর্জেন্টিনা এবং ১৯৫০ সালে চতুর্থ বিশ্বকাপে উরুগুয়ে-স্বাগতিক ব্রাজিল ফাইনালে খেলে। অথচ অল-ইউরোপীয় ফাইনাল খেলা হয়েছে ৮ বার। বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলা ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে আছে ইতালি, জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, হল্যান্ড, এক সময়ের চেকোশ্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, সুইডেন। আর লাতিন আমেরিকার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে। এই ৩ দেশ ছাড়া আর কোনো দেশ ফাইনালে উঠেনি। উরুগুয়ে তো হারানো গৌরবের স্মৃতি নিয়েই পড়ে আছে। ইউরোপের সঙ্গে টেক্কাটা দিতে হচ্ছে প্রধানত ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাকেই।

বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের দিক দিয়েও এগিয়ে আছে ইউরোপ। স্বাগতিক হয়েছে ১০ বার। লাতিন আমেরিকা হিসেবে অনেক বেশি পরিচিত দক্ষিণ আমেরিকা ৫ বার, উত্তর ও মধ্য আমেরিকা ৩ বার, এশিয়া ও আফ্রিকা ১ বার করে। ইউরোপীয়রা মূলত নিজেদের মাটিতে দাপট দেখিয়েছে বেশি। গতবার দক্ষিণ আফ্রিকায় ছাড়া অন্য কোনো মহাদেশ থেকে বিশ্বকাপ জিততে পারেনি। কিন্তু লাতিনরা নিজেদের মহাদেশ ছাড়াও উত্তর ও মধ্য আমেরিকা, এশিয়া এমনকি ইউরোপ থেকেও শিরোপা জয় করে নিয়ে গেছে। এবার যেহেতু ব্রাজিলে বিশ্বকাপ হচ্ছে, সেক্ষেত্রে লাতিন ঘরানার দেশগুলো অনেক বেশি আশাবাদী হতেই পারে। প্রথম রাউন্ডের খেলা শেষে লাতিনদের আধিপত্যও চোখে পড়ার মতো। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে উঠে এসেছে আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, চিলি, উরুগুয়ে এবং উত্তর ও মধ্য আমেরিকা থেকে কোষ্টারিকা, মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্র।

যদিও লাতিন আমেরিকা থেকে ইউরোপ শিরোপা জয় করতে পারেনি। তা ছাড়া অল-লাতিন ফাইনাল হয়েছে যে দু’বার, তার সর্বশেষটি হয়েছে এই ব্রাজিলের মাটিতে। এতে পুলক অনুভব করতে পারে লাতিনরা। তবে এ সব অবশ্য ইতিহাসের কথা। ইতিহাস তো ভিন্ন ধারায়ও বয়ে চলে। ইউরোপের বাইরে গতবার দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে প্রথম সাফল্য বয়ে আনে স্পেন। এটা ইউরোপীয়দের জন্য একটি বড় অনুপ্রেরণা। সবচেয়ে বড় উৎসাহ হতে পারে, ১৯৫৪ সাল থেকে এমন কোনো বিশ্বকাপ নেই, যেখানে ইউরোপীয় কোনো দেশ ফাইনাল খেলেনি। সেই ইতিহাসের ধারাক্রম যদি বজায় থাকে, তাহলে এবারের ফাইনালে অন্ততপক্ষে যে কোনো একটি ইউরোপীয় দলের খেলাটা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু ইতিহাস দিয়ে তো আর ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারিত হয় না। তাহলে হিসাবের বাইরে কোনো কিছু ঘটত না।

এবারের বিশ্বকাপে অল-লাতিন ফাইনাল অর্থাৎ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনাল দেখতে চাওয়াটা ফুটবল রোমান্টিকদের স্বপ্ন। যদিও অতীতে এমনটি কখনও ঘটেনি। তবে এবার তেমন সম্ভাবনা আছে, যদি দল দু’টি তাদের জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে পারে। আবার অল-ইউরোপ ফাইনালও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে ১৯৭৪ সালের ফাইনালের পুনরাবৃত্তি হতে পারে অর্থাৎ জার্মানি-নেদারল্যান্ডসের মুখোমুখি হওয়া। এ ছাড়াও লাতিন-ইউরোপ ফাইনালের সমূহ সম্ভাবনাও রয়েছে। সেক্ষেত্রে ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হতে পারে জার্মানি কিংবা নেদারল্যান্ডস। শিরোপাটা শেষের এই চার দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার সম্ভাবনাই বেশি। এর বাইরে আর কোনো দেশ শেষ চারে পৌঁছাবে না, এমন দিব্যিও কেউ দেয়নি। তবে সম্ভাবনার দিয়ে তো আর খেলার ফল নির্ধারিত হয় না। তাহলে তো সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি, স্পেন, ইংল্যান্ডের মতো শিরোপা প্রত্যাশী দলগুলো প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নেওয়ার কথা না। চিলি, কোষ্টারিকা, কলম্বিয়া, গ্রীসের মতো দেশগুলোও চমক সৃষ্টি করতে পারত না। তবে এখন যে সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে, সেটা প্রথম রাউন্ডে দলগুলোর ক্রীড়াশৈলী পর্যবেক্ষণ করে। এই পর্যবেক্ষণকে কেউ হালকা করে দেখতে পারেন, আবার কেউ সিরিয়াসলিও নিতে পারেন।

সব কথার শেষ কথা হলো, এবার বিশ্বকাপ কার ঘরে যাবে? ইউরোপ না লাতিন? লড়াইটা জমিয়ে তুলতে হলে লাতিনদের জিততেই হবে। তাহলে শিরোপার সংখ্যা ইউরোপের মতো লাতিনদেরও হবে ১০। তা ছাড়া দুইবারের বেশি লাতিনরা কখনও শিরোপা থেকে দূরে থাকেনি। সেই হিসাবেও এবার তো লাতিনদের শিরোপা জয় করার কথা। তাই না?

(দ্য রিপোর্ট/ডিএম/এএস/আরকে/জুন ২৮, ২০১৪)

dulalmahmud@yahoo.com