‘ম্যাভেরিক’ সুয়ারেজ, ‘কিং’!
ইংল্যান্ড যখন নিজের মাঠে শ্রীলঙ্কার কাছে নাকাল হচ্ছে, তখন কেভিন পিটারসেন কোথায়? বিশ্বকাপ ফুটবল দেখছেন, কাউন্টি ক্রিকেটে ব্যস্ত, নাকি বান্ধবীকে নিয়ে মালদ্বীপে ছুটি কাটাচ্ছেন? তার অনুপস্থিতিতে ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের হেডিংলিতে খাবি খেতে দেখে আফসোস করবেন- এমন লোক তিনি নন। স্রোত যেমন কারও জন্য অপেক্ষা করেনা, পিটারসেনও স্রোতের দিকে তাকিয়ে উল্টোদিকে পাল তুলতে হবে বলে আফসোস করেন না। অ্যাশেজে, ৫-০ ড্রাবিংয়ের মধ্যে তারই সবচেয়ে বেশি রান ছিল। তবুও দেশে ফিরে কোচ, অধিনায়ক সবাই বললেন, ও খেললে আমরা নেই। এর আগে টেক্সটগেট কেলেংকারি, পিটার মুরসের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে অধিনায়কত্ব হারানো, বিতর্ক আর কেভিন যেন নারায়ণগঞ্জে সন্ত্রাসের মতো সহজাত। মুশকিল হল, এমন প্রতিভাকে দলের বাইরে রাখতে কার মন চায়? ইংল্যান্ড কম চেষ্টা করেনি। শেষ পর্যন্ত বাঘ আর পোষ মানলোনা। ৯০-এর দশকে এরিক ক্যান্টোনাকে বহু কৌশলে ব্যবহার করতে হয়েছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে। ‘হি ওয়াজ ট্যু গুড ট্যু বি ড্রপড। হি ওয়াজ টু হট ট্যু বি হ্যান্ডেলড !’ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন ছিলেন বলেই হয়ত ফরাসি এই অমিয় প্রতিভাধর ফুটবলার কয়েক মৌসুমে সাফল্যের সঙ্গে ইংলিশ লিগে খেলতে পেরেছেন। পশ্চিমা বিশ্বগুলোতে ‘হাউ টু কন্ট্রোল ম্যাভেরিকস (মেধাবী কিন্তু একটু রগচটা অথবা বেখেয়লী)’ - এর উপর অহর্নিশ গবেষণা হয়। একেকজনকে সামলানোর রেসিপি একেক রকম। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ‘ম্যাভেরিকস’-হ্যান্ডেল করার কৌশল ব্যক্তিবিশেষের ওপরও বিশেষভাবে নির্ভরশীল। জন রাইট আর সৌরভের কেমিস্ট্রিতে কখনও গোলমেলে লবণ দেখা যায় নি। গ্রেগ চ্যাপেল আসতেই সহসা আগুন। শেষ পর্যন্ত ড্রেসিংরুম পুড়েই গেল ! সে আগুন নেভাতে ভারতের তখন পর্যন্ত ইতিহাস সেরা অধিনায়ককে দলচ্যুত করল বিসিসিআই। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জয়ী কোচ হিসেবে যতটুকু, এরচে বেশি সম্মান পান কার্লোস বিলার্ডো ম্যারাডোনার মেন্টর হিসেবে।
রবার্টো মানচিনির মত ঝানু ম্যানেজার বালোতেল্লির দস্যিপনার কাছে শেষ পর্যন্ত অসহায় হযে গেলেন- ‘ইনাফ ইজ ইনাফ। আমি শেষ। আর নয়। ওকে ঠিক রাখতে হলে প্রতিদিন ওর সাথে কথা বলতে হবে। এবং তা করলে শেষ পর্যন্ত আমি পাগল হয়ে যাব।’ ২০১২ সালে ম্যানসিটি ছেড়ে দিল এই পাগলাটে স্ট্রাইকারকে। লুই সুয়ারেজের জন্য কতটুকু হোমওয়ার্ক করেন ব্রেন্ডন রজার্স? নিশ্চয়ই অনেক। মার্কো ভ্যান বাস্তেন তো রীতিমতো আতঙ্কে থাকতেন। ওকে নিয়ন্ত্রণ করা অসাধ্য কর্ম। মাঝে মাঝে মনে হয় সে চেষ্টা করারই দরকার নেই। ও নিজের মত করেই দুর্দান্ত।’ আয়াক্সেও হয়ে ৩ মৌসুমে ৮১ গোল (১১০ ম্যাচ), ২ বার লিগ শিরোপা। বাস্তেন এমন বলতেই পারেন। পিএসভি’র ওটমান বাকালকে কামড় (ফুটবল মাঠে সুয়ারেজের প্রথম কামড়) দিয়ে ৯ ম্যাচ সাসপেন্ড, হজম করলেন বাস্তেন। সোনার ডিম দেয়া হাস বলে কথা। লিভারপুল যখন ২৩ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে ওকে অ্যানফিল্ডে নিয়ে এলো- ইংলিশ মিডিয়ায় ফিসফাস- ওকে সামলানো যাবে তো? না, সামলানো যায়নি, যখন তখন প্রতিপক্ষের গায়ে হাত, পেটে লাথি- পরিণতিতে অবধারিত লালকার্ড, কালোদের কালো বলে গাল দেয়া, মিডিয়ার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ - সুয়ারেজ সার্কাস চলতে থাকল পুরোদমে, ষোলকলা পূর্ণ হলো চেলসির ইভানোভিচকে কামড়ে। ১০ ম্যাচের সাসপেনশন। হজম করল লিভাপুল। না করে উপায় নেই। মাইকেল ওয়েনের পর আরেকজন হিটম্যান পেল অ্যানফিল্ড যার হাত ধরে বড় বেশি অপরিচিত হয়ে যাওয়া প্রিমিয়ার লিগের শিরোপাটা হয়ত জেতা যাবে। প্রমাণ হাতে নাতে। ৫ ম্যাচ কম খেলেও এ মৌসুমে লিগ সর্বোচ্চ ৩১ গোল, অধরা ট্রফিটা একদম হাতের নাগালে চলে এসেছিল রজার্সের।
এখন কি করবে উরুগুয়ে? ৬৪ বছর আগে ঘিঘিয়া শেষবার শিরোপা জয়ের আনন্দে ডুবিয়েছিল তাদের। এরপর আর সে উচ্চাশা পোষণের সুযোগই হয়নি। এবার কাভানি আছেন, চাইলেই ফোরলানের সাহায্যে পাওয়া যাবে, পেছনে গডিনের মত ইউরোপ সেরা ডিফেন্ডার। প্রতিবেশীর মাঠে খেলা। সবচেয়ে বড় শঙ্কা ছিল যাকে নিয়ে তিনি নিজেই ইংল্যান্ডকে বিধ্বস্ত করে উড়িয়ে দিয়েছেন সেটা। চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠল উরুগুয়ে। সেই মহারণের একফাঁকে একদম অযথা, আমাদের বিরোধী দলরা যেমন হরতাল ডাকে, তেমনি খেয়ালবশত চিয়েল্লিনির ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে দিলেন সুয়ারেজ। রেফারি বুঝতে পারেনি, লাইন্সম্যানও না। কিন্তু রিপ্লে দেখে আর সবাই বুঝে গেল, ডিসিপ্লিনারি কমিটি অ্যাকশনে নামবে এবং সুয়ারেজবিহীন বিশ্বকাপ একপ্রকার নিশ্চিত। তাই অনেক উল্লাসের মাঝেও অস্কার তাবারেজের কপালে কিছু ভাজ বড় বিরক্তিকরভাবে খেলা করে গেল। কেন করলেন এটা সুয়ারেজ? সেদিন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুজন সমর্থক তার এক ছবি নিয়ে হাজির। ছবিতে সুয়ারেজের মাথায় মুকুট। নিচে লেখা ‘গড সেভ আওয়ার কিং।’ গড তাদের প্রার্থনা রাখলেন। ম্যাচ শেষে রাজার মতই মাঠ ছাড়লেন সুয়ারেজ। চারদিন বাদে কি খেয়াল হল রাজার, তীর ধনুক ফেলে অবৈধ ছুরি-চাকু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রতিপক্ষের ওপর। ফলাফল! ফলাফল আমরা সবাই জানি। এখন এই ’মূর্খ’ রাজাকে কি করবে প্রজারা? কোথায রাখবে তাদের দুঃখ? এই রাজাকে তারা এত ভালবাসে যে তার সমালোচনা সম্ভব নয়, কটুবাক্য তো নয়ই। অথচ কি অবহেলায় উরুগুয়ানদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। হতবাক তার সতীর্থ, সমব্যথীরাও। অ্যান্ডি মারে বলেছেন, ‘ও সম্ভবত সে সময় এ জগতে ছিল না।’ মাইকেল ওয়েন সুয়ারেজকে দারুণ পছন্দ করেন। এই সাবেক ইংলিশ স্ট্রাইকার বাইটি এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছেন না- কেন এমন করল সুয়ারেজ? মনোবিদ বলেছেন, ‘ওর এই সমস্যা যাওয়ার নয়। ছোটবেলা কেটেছে দারুন দারিদ্র্যে। ৯ বছর বয়সে বাবা-মা আলাদা হয়ে যায়। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত সুয়ারেজ, খেলত আর মারামারি করত। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা আর দুর্বৃত্তপরায়ণতা তার মজ্জাগত। কাউন্সেলিং করেও কোন লাভ হবে না।’ এত বড় মন্দ কথা। শঙ্কার কথা। উরুগুয়ের পক্ষে সর্বোচ্চ ৪১ গোল করা লিভারপুলের রোনালদো মেসি হয়ে ওঠা এমন একজন ক্ষণজন্মা স্ট্রাইকারের এ কোনো অপব্যাধি যার কোনো চিকিৎসা নেই। হায় খোদা ! ঠিক এই মুহূর্তে উরুগুযে আর বিশ্বব্যাপী সুয়ারেজ সমর্থকদের কথা ভাবুন। ওয়াল্টার ফেরেইরার অবস্থা কি ? নিজের ক্যান্সার। প্রতিনিয়ত কেমোথেরাপি নিচ্ছেন। তবুও রাতদিন এক করে বিশ্বকাপের জন্য সুয়ারেজকে সুস্থ করে তুলেছিলেন এই ফিজিওথেরাপিস্ট। তাকে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতে ব্রাজিল পর্যন্ত উড়ে এসেছেন। অথচ …। আমি নিশ্চিত, এখন সুয়ারেজের চোখে জল। ও নিজের দলকে ভালবাসে। এই সেই ছেলে যে গত বিশ্বকাপে নিশ্চিত লালকার্ড ও পরের ম্যাচের সাসপেনশন জেনেও হাত দিয়ে ঘানার গোল ঠেকিয়ে দিয়েছিল। এই সেই দস্যু যে জাতীয় দল কি ক্লাব, যার হয়েই খেলুক না কেন, প্রতিপক্ষের বুকে শেল বিধিয়ে দিতে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত ঢেলে দেয়। এই তো কদিন আগে চেলসির কাছে হেরে যেদিন লিভাপুলের শিরোপাস্বপ্ন বিলীন হয়ে গেল, পরদেশী দলটির জন্য সে কি কান্না তার! সেই পরদেশকেই বিশ্বকাপে বিধ্বস্ত করে আবারও কাঁদলেন ছোট্ট শিশুর মত। রাগ, অভিমান, কান্নাময় এক সরল শিশু যেন সুয়ারেজ যে অসুস্থ জেনেও খেলাচ্ছলে মার বুকে লাথি মেরে বসে। একটু পরই আবার চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় মার কপাল, চিবুক। ধৈর্য্য ধরো উরুগুয়ে। সুয়ারেজ তোমাদের দুঃখ ভুলিয়ে দিবে- ‘দ্য কিং উইল বি ব্যাক।’
(দ্য রিপোর্ট/এএস/এনআই/জুন ২৮, ২০১৪)