অ্যাডিওস স্পানা!
বিশ্বকাপের খেলা দেখা এবার শারীরিকভাবে বেশ কষ্টকরই হয়ে যাচ্ছে। রাত জেগে খেলা দেখে পরদিন নৈমিত্তিক কাজগুলো ঠিকঠাক মত করতে পারাটা বেশ একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু- `The greatest shwo on earth’-এর মজা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করাটা যুক্তিসঙ্গত হবে না- এই চিন্তাটা এখনও বদলায়নি। খুব গুরুতর কিছু না ঘটলে আশা করি বদলাবে না। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য অসুবিধাজনক হলেও দেখা যাচ্ছে এই রাতের খেলাই এদেশে অনেকের জন্য বাড়তি আমোদের উপলক্ষ হয়ে এসেছে। পাড়ায় পাড়ায় জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখার আয়োজন করা হয়েছে। বাজি টাজিও ফুটছে। দিনে হলে এই ব্যাপারটা একেবারেই জমত না। সেদিন টিভিতে দেখলাম আমাদের বিনোদন জগতের তারকাদের অনেকে বাড়িতে সবান্ধব খেলা দেখার সাথে জম্পেশ আড্ডার আয়োজন করেছেন। ছোট বড় মিলিয়ে অনেক তারকাই এসব আড্ডায় নিয়মিত হাজির হচ্ছেন। কাঁথা-বালিশ বিছিয়ে টিভির সামনে তারা বেশ একটা গ্যালারির মত তৈরি করেছেন। প্রিয় দলের জার্সি গায়ে দিয়ে খেলা দেখার পাশাপাশি দলের সমর্থনে গলাবাজি কিংবা ঝগড়াঝাটিও করছেন। দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলবার মত একটা মানসিক অবস্থা হল আমার। আমাদের মত কট্টর পেশাজীবী মানুষের এতখানি স্বাধীনতা কোথায়!
গ্রুপ পর্যায়ে নিজেদের দ্বিতীয় খেলায় চিলির বিপক্ষে মাঠে নেমেছিলো স্পেন। স্পেনের এই খেলাটা দেখার চিন্তা বেশ আগে থেকেই ছিল। প্রথমটা ভুল দেখেছিলাম কিনা- তা যাচাই করে নেওয়া দরকার বলে মনে হচ্ছিল। নেদারল্যান্ডসের কাছে ৫-১ গোলে বিধস্ত হওয়ার পর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা কীভাবে ঘুরে দাঁড়ায়, সেটার সাক্ষীও হতে চেয়েছিলাম। প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য কয়েকদিন ধরেই মাথার ভেতরে খচখচ্ করে যাচ্ছিল। নেদারল্যান্ডসের সাথে ম্যাচের ফলটা ছিল স্পেনের জন্য গত ৬০ বছরের মধ্যে সবচাইতে খারাপ। এর চাইতে খারাপ ফল তারা করেছিল যাদের বিপক্ষে সেই দলটার নামও চমকপ্রদ- স্কটল্যান্ড- Believe it or not। এবারের এই ফলটাও কোন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলের জন্য খারাপ ফলের সবচাইতে বাজে দৃষ্টান্ত। এসব তথ্য আমাদের খুঁজে বের করতে হয়েছে, ধারাভাষ্যকারদের মুখে কিছু কিছু শোনাও গেছে, কিন্তু স্পেন দলটা যারা চালাচ্ছেন এবং দলে যারা খেলছেন, তাদের জন্য নিশ্চিভাবেই এটা খোঁজাখুঁজির কোনো বিষয় নয়। এসব তারা জানতেন। অতএব তারা এটাও জানতেন যে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে টিকে থাকার জন্য যা দরকার করতে হবে তাই, দিতে হবে মরণ কামড়। তাদের জন্য তথ্যগত কোন প্রেরণার প্রয়োজন যদি হয়েই থাকে- তো সেটা এই- ২০১০ বিশ্বকাপেও তারা প্রথম খেলায় হেরেছিল। কিন্তু তাতে শিরোপা জিততে অসুবিধা হয়নি।
আমার একটু দেরি হয়েছিল টিভির সামনে আসতে। টিভি খুলতেই দেখি ফল ১-০ এবং অবিশ্বাস্যভাবে তা স্পেনের বিপক্ষে। কিন্তু তখনও বিস্তর সময় বাকি। টিকি-টাকা কাজ করলে যে কোন কিছুই হয়ে যেতে পারে। কিন্তু হায়! স্পেন যা খেলছিল তাকে আর টিকি-টাকা বলা সঙ্গত মনে হচ্ছিল না। দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি এসে হতাশ আমি এই খেলার নাম দিলাম ’টিকি-ভুল-টাকা-ভুল’এবং খানিকটা পরেই আর এক ধাপ নেমে ’টিকি-ভুল-টাকা-ভুল, টিকিটাকা ভুল-ভুল’। কেননা তখন ইনিয়েস্তার পাসগুলোও টিকি থেকে টাকা না হয়ে টিকি-ভুল হয়ে থেমে যাচ্ছিল। এদিন দেল বস্ক দলে পরিবর্তন এনেছিলেন। জাভি, পিকেকে ডাগ-আউটে আবিষ্কার করে বেশ বড়সড় পরিবর্তনের সম্ভাবনাই মনে এসেছিলো, খুঁজছিলাম ক্যাসিয়াসকে। কিন্তু নেই। মাঠে স্পেনের গোল পোস্টের নিচে যে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে তাকে চেনা যাচ্ছিল না। নড়াচড়া ক্যাসিয়াস-সুলভ নয়, জার্সিটাও না। অনেকক্ষণ ধরে কোন ক্লোজ-আপ শট না আসাতে আমি ধরেই নিলাম-ওটা ক্যাসিয়াস নয়। ভুলটা ভাঙলো কেবল দ্বিতীয় গোলটা হবার পর। ডি বক্সের ঠিক বাইরে থেকে নেয়া একটা ফ্রি কিক ফিস্টট করে ফিরিয়েছিলেন। ফিরতি বলটা চিলির আক্রমণ ভাগের একজন খোলোয়াড় ডি-বক্সের ভেতর থামালেন একেবারে বলের ওপর বুটটা রেখে। ক্যাসিয়াসসহ স্পেনের রক্ষণ ভাগ খেলা দেখছে। এরপর বুটের অগ্রভাগ দিয়ে একেবারে জায়গায় দাঁড়িয়ে ওই খেলোয়াড় জোরালো যে শটটা নিলেন, সেটি হালকা বাঁক নিয়ে সরে যেতে যেতে পোষ্টের দিকে যাচ্ছিল। স্পেনের রক্ষণভাগ তখনও দেখছিল। ক্যাসিয়াস শূন্যে ভাসালেন নিজেকে- বাঁ দিকে। তার প্রসারিত বাঁ-হাতের আঙ্গুল বলটাকে ছুঁতে পারল কি পারল না ঠিক বোঝা গেল না। কিন্তু বল জালের কোণায় তার জায়গা খুঁজে নিল। গোল করে চিলির ওই খেলোয়াড় যে লাফটি দিলেন- এনবিএ’র বিখ্যাত স্লাম-ডাঙ্কের জন্যও সেটি যথেষ্ট কঠিন হত। স্পেনের সমর্থক নই, তবু এই খেলা শেষ হতে হতেই আমি স্পেনের পক্ষে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। চিরকাল নির্যাতিতের পক্ষে আমি- অন্তত নৈতিক অবস্থান থেকে। আর এবারের বিশ্বকাপের স্পেনকে যদি একটি শব্দে বর্ণনা করতে হয়- তো আমার মতে সেই শব্দটি হবে ওটাই- নির্যাতিত! নিপীড়িত!
স্পেন-চিলির ম্যাচ শেষ হতে রাত প্রায় তিনটে বেজে গিয়েছিল। রিমোট টিপে টিভি অফ্ করব হঠাৎ দেখি গ্যালারির ক্লোজ-আপ। এক দর্শকের হাতে একটা প্ল্যাকার্ডের ওপর গিয়ে পড়ল ক্যামেরা। সেখানে লেখা-ADIOS SPANA। আমি স্প্যানিশ বা পর্তুগীজ ভাষার এক বর্ণও বুঝি না। কিন্তু ঐ শব্দগুলোর মানে বুঝতে আমার একটুও কষ্ট হল না।
ঐদিনের প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া খেলেছিল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। এই অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে দু’কথা না বললেই নয়। অস্ট্রেলিয়াও শেষমেশ স্পেনের পরিণতিই বরণ করেছে- মানে লাগাতার দু’ম্যাচ হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু তাদের ব্যাপারে স্পেনের ঠিক উল্টো মূল্যায়নটাই সঠিক বলে মনে করছেন বোদ্ধারা। বিশেষ করে দ্বিতীয় ম্যাচে সকারুসরা নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে যা খেলল, তাতে তারা মাথা উঁচু করেই এখন দেশে ফিরতে পারেন। দূর থেকে উড়িয়ে বক্সের ভেতরে ফেলা একটা বল থেকে সরাসরি ভলিতে টিম কাহিল যে গোলটা করেছিলেন তা তো অনেকদিন ধরেই চোখে লেগে থাকবে।
গ্রুপ পর্বের খেলা শেষ। ব্রাজিল তাদের দ্বিতীয় ম্যাচে পয়েন্ট খুঁইয়েছিল মেক্সিকোর কাছে। অনেকের মতে, মেক্সিকোর গোলরক্ষকের কাছে। প্রথমার্ধে নেইমারের জোরালো একটা হেডার সাইডবারের সামান্য ভেতর দিয়ে ঢোকার মুখে অবিশ্বাস্য দক্ষতায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মেক্সিকান গোলরক্ষক। তার আগ পর্যন্ত আধো ঘুম আধো জাগরণে খেলা দেখছিলাম। ব্রাজিলের খেলা দেখতে দেখতে ঘুম এসে যাচ্ছে- দোষটা খেলার নাকি আমার শারীরিক ক্লান্তির বুঝতে পারছিলাম না। কেননা, দুপুরে ব্যস্ততার কারণে বিশ্রাম নেয়া হয়নি। শরীরের দোষ দেয়া যায় না। তবে নেইমারের ওই দুর্দান্ত হেডার আর মেক্সিকোর গোলকিপারের অধিকতর চমকপ্রদ সেভ যখন আমাকে শোয়া অবস্থা থেকে প্রায় দাঁড় করিয়ে দিল তখন বুঝলাম দোষটা শরীরের ছিল না। দোষটা ব্রাজিলের অব্রাজিলসুলভ খেলার। শরীর তার ক্লান্তি নিয়েও যে কোন উত্তেজনায় সাড়া দেবার জন্য তখনও প্রস্তুত। দুঃখের বিষয় প্রথমার্ধের বাকি সময়ে তেমন উত্তেজনার উপলক্ষ আর এলো না। আমিও কখন যেন ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে নেট খুলে দেখলাম দ্বিতীয়ার্ধে মেক্সিকোর গোলরক্ষকের অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের কাছে মুখথুবড়ে পড়েছে ব্রাজিলের সব আক্রমণ। কোন গোল ছাড়াই ম্যাচ ড্র হয়েছে। মেক্সিকান গোলরক্ষকের ’ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ’ নির্বাচিত হওয়াটা প্রাপ্যই ছিলো, তবে ব্যাপারটা যে নেইমার, ফ্রেড আর অস্কারদের জন্য এক ধরনের রক্ষাকবচও হয়ে উঠবে তা বোধ হয় তারাও ভাবেননি।
‘জোগো বনিতো’ বলে একটা শব্দযুগল ব্রাজিলের ফুটবল সম্পর্কে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। এর আভিধানিক অর্থ- দ্য বিউটিফুল গেম। বলা বাহুল্য, ব্রাজিলের সমর্থকরা ব্রাজিলের খেলায় সব সময় এই ‘জোগো বনিতো’ই দেখতে চান। এবার ব্রাজিলের খেলায় যা অনুপস্থিত। এ নিয়ে আফসোস করছেন অনেকেই। এই হতাশাবাদীদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের লোকজনই বেশি। আমি আমাদের দেশের ফুটবল বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনা বেশ মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করি এবং প্রায়ই তাদের সঙ্গে একমত হবার মত উপাদান খুঁজে পাই। সেদিন ’জোগো বনিতোর ব্রাজিল কোথায়’ শিরোনামের একটা লেখার শুধু শিরোনামটুকু পড়েই মনে হলো- তাইতো, ব্রাজিলের সেই ধ্রুপদী ফুটবল তো দেখা যাচ্ছে না এখন। তবে সেই হতাশা মনে রেখেও একথা বোধ হয় বলা যায় যে ক্যামেরুনের বিপক্ষে গ্রুপ পর্যায়ে নিজেদের শেষ খেলায় ব্রাজিল অধিকতর কার্যকর একটা খেলা খেলেছে। ফিনিশিং নিয়ে একটা সমস্যা মাঝে মাঝেই প্রকট হয়ে উঠে ব্রাজিলের খেলায়। আমার মনে হয়েছে এদিন অন্তত এই দিকটাতে দশের মধ্যে আট পাওয়ার মতো খেলেছে ব্রাজিল। নেইমারের গোল দু’টি তো নিখুঁত ফিনিশিং এর অনন্য দৃষ্টান্ত। এদিন ৪টা গোল করেছে ব্রাজিল। হতে পারত আরও বেশি। অবশেষে গোল পেয়েছেন ফ্রেড। যদিও তা অফসাইড থেকে বলেই মনে হয়েছে। নকআউট পর্বের খেলায় শক্তিশালী নেদারল্যান্ডসকে এড়ানো গেছে গোল ব্যবধানে মেক্সিকোর চাইতে এগিয়ে থেকে। সেখানে প্রতিপক্ষ এখন চিলি। কোচ স্কলারি নাকি এড়াতে চাইছিলেন এই চিলিকেই। চিলি চমৎকার ফুটবল খেলছে এই মুহূর্তে। অতএব ব্রাজিলের শুভাকাঙ্ক্ষি সবাই এ কথা মেনে নিচ্ছেন যে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করতে হলে ব্রাজিলকে আরও অনেক উন্নতি করতে হবে।
এবার ইংল্যান্ড, ইতালি আর উরুগুয়ে এক গ্রুপে পড়ে যাওয়াতে এটাকে বলা হচ্ছিল-গ্রুপ অফ ডেথ। গ্রুপের চতুর্থ দল হিসেবে ছিল পুঁচকে কোস্টারিকা। স্বভাবতই ওটাকে আগে ছেঁটে ফেলে বাকি তিন দলের কোন দু’টো নক-আউটে যাচ্ছে- সব গবেষণা তাতেই কেন্দ্রীভূত ছিল। আমাদের বিশেষজ্ঞরা খুব সাহসী বা ঝুঁকিপূর্ণ কোন বিশ্লেষণ বা ভবিষ্যদ্বাণীর ভেতরে সাধারণত যান না। যদি যেতেন তাহলে হয়ত তারা কোস্টারিকার সম্ভাবনার কথাও আলোচনা করতেন। তো মোটামুটি সবার নজর এড়িয়ে যাওয়া সেই কোস্টারিকাই যখন তাদের বিশ্বকাপ শুরু করল দু’বারের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়েকে ৩-১ গোলে হারিয়ে, তখনও সেটাকে দুর্ঘটনাই ভেবেছিলেন সবাই। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচে যখন তারা তিনবারের চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে হারিয়ে সবার আগে নকআউট পর্ব নিশ্চিত করল, তখন সবাই নড়েচড়ে বসল। কোস্টারিকা গ্রুপ পর্বে তাদের শেষ ম্যাচে ইংল্যান্ডের কাছেও হারেনি। তাদের অদম্য এই পারফরম্যান্সের মানে দাঁড়াল এই যে, ৫ বার বিশ্বকাপ শিরোপা ভাগ করে নেয়া দু’টো দল ইতালি (৩ বার) ও উরুগুয়ের (২ বার) যেকোনো একটিকে গ্রুপপর্ব থেকেই বিদায় নিতে হবে। ইংল্যান্ডের বিদায়ের পথ আগে থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল যখন তারা তাদের প্রথম দু’ম্যাচে ইতালি ও উরুগুয়ের কাছে পরাজয় বরণ করেছিল দলটি।
এই পরিস্থিতিতে গ্রুপের শেষ তাৎপর্যপূর্ণ ম্যাচে মুখোমুখি ইতালি- উরুগুয়ে। ড্র হলেই চলে উরুগুয়ের। তবে ইতালির জয় চাই-সমীকরণটা এরকম। গোল খাওয়া যাবে না- সতর্কতার এই বাড়াবাড়িতে প্রথমার্ধে খেলা যা হলো তাকে ঠিক নিষ্প্রাণ বলা যাবে না। খেলায় প্রাণ অবশ্যই ছিল- তবে খেলাটা আমেরিকান ফুটবল (রাগবি) কিনা, মাঝেমাঝেই সেই বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছিল। বালোতেল্লি একবার এক প্রতিপক্ষের ঘাড়ে চড়ে বসলেন (পরিণতি হলুদ কার্ড), ইতালির আরেক খেলোয়াড় বলের তোয়াক্কা না করে বুট চালিয়ে দিলেন উরুগুয়ের একজনের হাঁটু বরাবর (ফল লাল কার্ড), সুয়ারেজ তার কামড়াকামড়ির স্বভাবটাকে আরও একবার নবায়ন করে নিলেন এবং রেফারির নজর এড়িয়ে যাওয়ায় অবিশ্বাস্যভাবে পার পেয়ে গেলেন! একই অপরাধে গত মৌসুমে ৮ ম্যাচ সাসপেন্ড হয়েছিলেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুলে খেলা এই স্ট্রাইকার। খেলার একমাত্র গোলটি আসতে সময় লাগল ৮২ মিনিট- সুয়ারেজ, কাভানি নয়- হেড থেকে গোল করলেন উরুগুয়ের অধিনায়ক দিয়েগো গডিন। আর তাতেই নিশ্চিত হলো উরুগুয়ের নকআউট পর্বে খেলা এবং ইতালির বাড়ির পথ ধরা। শেষ দশ মিনিটে মরিয়া হয়ে খেলেছিল ইতালি। গোলরক্ষক বুফন শেষ দু’মিনিট গোলপোস্ট ছেড়ে এসে পুরোদস্তুর স্ট্রাইকার হিসেবেই খেলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাতে বদলালো না কিছুই। খেলা শেষে ইতালির কোচ সিজার প্রাণদেল্লি সহাস্যে হাত মেলালেন উরুগুয়ের কোচ অস্কার তাবারেজের সঙ্গে। বলা বাহুল্য, তিনিও হাসছিলেন।
প্রথম সপ্তাহের পর্যালোচনায় আর্জেন্টিনা সম্পর্কে বলেছিলাম- দলটির অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে মেসি যাদু অব্যাহত থাকতে হবে। ইরানের বিপক্ষে তাদের দ্বিতীয় খেলায় এবং নাইজেরিয়ার সঙ্গে শেষ খেলায় এই মেসি যাদু না হলে কী ঘটতো বলা মুশকিল। জমাট রক্ষণভাগের কৌশল নিয়ে মাঠে নামা ইরানের ছককে কে যেন দেখলাম ১-৫-৫ বলে বর্ণনা করেছেন। আমি সেই বর্ণনায় এই কৌশলের ব্যাপারে লেখকের কিছুটা তীর্যক মনোভাব লক্ষ্য করলাম। আমার মনে হলো আর্জেন্টিনার বিপক্ষে যদি ইরানের মত দল ১-১০-০ ছক নিয়েও মাঠে নামে- তো তাদেরকে দোষ দেয়া যায় কীভাবে! তো ১-৫-৫ এর সেই ইরান দু’বার বিশ্বকাপ জয়ী আর্জেন্টিনাকে ৯০ মিনিট ঠেকিয়ে রেখেছিল। উল্টো কাউন্টার অ্যাটাক থেকে গোল পেয়ে যেতে পারত তারাই। পায়নি যে, সেজন্য আর্জেন্টিনা ধন্যবাদ জানাতে পারে তাদের গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরোকে। খেলা ইনজুরি টাইমে গড়িয়েছে এমন সময় ফিরে এলো মেসির সেই জাদুকরী মুহূর্ত। ডান পাশে বল পেয়ে বড় ডি বক্সের বাইরে দিয়ে ড্রিবল করে ডান থেকে বাঁ দিকে এলেন। তারপর ডি-বক্সের বাইরে থেকেই বাঁ-পায়ে রংধনুর মত বাঁকানো যে শটটি নিলেন- পুরো খেলায় দুর্দান্ত খেলা ইরান গোলরক্ষকের সাধ্য ছিল না তা আটকাবার। তার প্রসারিত হাতের একটু বাইরে দিয়ে বাঁক নিয়ে বল জালে ঢুকলো। পুরোপুরি শূন্যে ভাসমান ইরান গোলরক্ষকের ছায়াটাকে ক্যামেরার স্লো- মোশানে অসাধারণ দেখাল। কিন্তু মুহূর্তকাল পরেই উচ্ছ্বসিত আর্জেন্টিনা শিবিরের উল্টো দিকে মৃতপ্রায় ইরানী খেলোয়াড়দের দেখে এটাও মনে হলো- খেলাটা কখনও কখন্ও বেশ নিষ্ঠুর!
(দ্য রিপোর্ট/এএইচএমবি/জেডটি/এনআই/জুন ২৮, ২০১৪)