সেরা হওয়ার সমীকরণ সহজিয়া কোনো কাজ নয়। সেরা হওয়াটা অনেক কঠিন। বিশেষ করে বিশ্বকাপের মতো আসরে। আর সেখান থেকে সেরা ১০ গোল বাছাই করা তো আরও কঠিনতম কাজ। ১৯৩০ সালে শুরু হওয়া বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরের পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সেরা ১০টি গোল বেছে নেয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবুও এই কাজটি করেছেন ফিফার শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তিরা। অনেকে আবার এই তালিকাকে বিতর্কিত বলেও অভিহিত করে থাকেন। সেরা ১০ গোল নিয়ে ফুটবল ভালোবাসা মানুষের আগ্রহের কোনো শেষ নেই। ফিফার সূত্র ভর করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

এক. পেলে, ১৯৫৮

এই ম্যাচে ব্রাজিল ২-১ গোলে জয়লাভ করেছিল। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে মাত্র ১৭ বছরের পেলের ঝলক সারা ফুটবল দুনিয়ার মানুষই দেখেছিল। ম্যাচের ৫৫ মিনিটে অনন্য সাধারণ এক গোল করে নিজের আগমনী বার্তা জানিয়েছিলেন। পেনাল্টি এরিয়া থেকে বেশ কয়েকজনকে কাটিয়ে গোল করেন পেলে। পাসিং করা বল হেড দিয়ে ঠেকিয়ে বুকে নিয়ে সজোরে শট করে গোল করেন তিনি। সুইডিশ গোলকিপার কার্ল সভেনসন শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলেন একজন লিজেন্ডের মনকাড়া গোল করার দৃশ্য।

দুই. কার্লোস আলবার্তো, ১৯৭০

এই বিশ্বকাপের ফাইনালে অনেকটা একপেশে লড়াইয়ে ইতালিকে ৪-১ ব্যবধানে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে ব্রাজিল। পেলে ডানে ও বামে সমানতালে খেলে নিজেকে সেরাদের সেরাতে পরিণত করেছিলেন। ফাঁকা বুঝে ডানদিক থেকে আলবার্তোকে বল জোগান দেন পেলে। তারপর সঠিক স্কোয়ার পাসে বল নিয়ে প্রতিপক্ষ সীমানায় হানা দেন আলবার্তো। বিগত ২৫ বছরের মধ্যে এমন গোল হজম করতে হয়নি ইতালিয়ান গোলরক্ষক এনরিকো আলবার্তোসিকে।

তিন. এরি হান, ১৯৭৮

১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপে ইতালির বিপক্ষে করা এই পাওয়ারফুল গোলটি এখনও এরি হানের কাছে সেরাদের সেরা হয়ে আছে। ডাচদের বিপক্ষে করা এই গোলটি তাদের ৪০ বছরের ফুটবল ইতিহাসে সেরাদের সেরা হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে। ইতালির বিপক্ষে করা এই গোলটিতে সে সময়কার বিশ্বসেরা গোলরক্ষক দিনো জফের চেয়ে চেয়ে দেখা ছড়া আর কিছুই করার ছিল না। কারণ একেবারে মাপা শটে ক্রসপিসের পর বলটি জালে জড়ায়।

চার. আরচি জেম্মিল, ১৯৭৮

১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপে স্কটম্যান আরচি জেম্মিলের গোলে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৩-২ গোলের সারপ্রাইজিং জয় পায়। এই ম্যাচে ৬৮ মিনিট পর্যন্ত ২-১ গোলে এগিয়েও ছিল তার দল। মিডফিল্ড থেকে বল নিয়ে তিনজন ডাচ ডিফেল্ডারকে কাটিয়ে পেনাল্টি এরিয়ার বাইরে থেকে বল নিয়ে গোল করেন তিনি। এ সময় বাকি ডিফেল্ডাররা তার বলের নাগালই পাননি। উল্টো ডাচ গোলরক্ষক ইয়ান জনগ্লোবড পরাস্ত হয়ে দেখেন বল জালে জায়গা করে নিয়েছে।

পাঁচ. ডিয়াগো ম্যারাডোনা, ১৯৮৬

কোনো ফুটবলারের একক নৈপুণ্যে ভাস্বর কোনো বিশ্বকাপের কথা যদি বলতে হয় তাহলে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের কথাই বলতে হবে। ম্যারাডোনা রীতিমতো একাই বিশ্বকাপের শিরোপা জিতিয়েছেন দলকে। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার করা হাত দিয়ে ‘হ্যান্ড অব গোলই’ বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা গোল হিসেবে অভিহিত হয়ে আছে। শুধু এই গোলই নয়, অনন্য সাধারণ একটা ম্যাচের কারণেও এই ম্যাচটি অনেকেরই মনের কোণে জায়গা করে আছে। এই ম্যাচটা অনেকটাই ইংল্যান্ডের সঙ্গে ম্যারাডোনার ম্যাচ হয়ে রয়েছিল। ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটনকে বোকা বানিয়ে হাত দিয়ে আলতো করে বল জালে জড়িয়ে দেন। শিলটন কিছুটা বুঝতে পারলেও রেফারি আর দর্শক ছিল অনেকটা বোকার ভূমিকায়।

ছয়. ডিয়াগো ম্যারাডোনা, ১৯৮৬

একক নৈপুণ্যের মাধ্যমে কোনো দল যদি বিশ্বকাপের শিরোপা জিততে পারে তাহলে সেটা ১৯৮৬ সালে করেছিলেন ডিয়াগো ম্যারাডোনা। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা ১০ গোলের মধ্যে একই বিশ্বকাপে তিনি করেছেন দুটি সেরা গোল। সেমিফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে মাত্র তিন দিন আগে একক নৈপুণ্যে দলকে জেতানোর পর অবিশ্বাস্য এই গোলটি করেন ম্যারাডোনা। তিনজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে বাঁ-পায়ের শটে গোল করেন। এই গোলটি হওয়ার সময় শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলেন বেলজিয়ামের খেলোয়াড়রা।

সাত. ডেনিস বার্গক্যাম্প, ১৯৮৮

ডাচ মাস্টার হিসেবে খ্যাত ডেনিস বার্গক্যাম্প এই একটি গোলের কারণে নিজেকে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে করা ৮৯ মিনিটের এই গোলটি তারপরও ৫০ বছর আগের ফ্রাঙ্ক ডি বোয়েরের কথা মনে করিয়ে দেয়। ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তে আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার রবার্তো আয়ালার ভুলে গোলরক্ষক কার্সোস রোয়াকে বোকা বানিয়ে বল জালে জড়িয়ে নেন। কারণ গোলবারে থেকে রোয়ার তখন কিছুই করার ছিল না।

আট. রবার্তো ব্যাজ্জিও, ১৯৯০

ইতালিয়ানদের জন্য ১৯৯৪ সালের যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বকাপে পেনাল্টি মিসের ঘটনাটি অনেকদিন তাড়িয়ে বেড়াবে। আর এই মিসটি করেছিলেন তখনকার সুপারস্টার ফুটবলার রবার্তো ব্যাজ্জিও। সেই ব্যাজ্জিওই আগের বিশ্বকাপে চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে করা গোলটি একজন পুরোদস্তুর ক্লাস খেলোয়াড়ের ঐতিহ্যকে বুঝিয়ে দিয়েছিল। প্রথম রাউন্ডের এই ম্যাচে মাঝমাঠ থেকেই বল নিয়ে যাচ্ছিলেন ব্যাজ্জিও। তারপর একে একে তিনজনকে কাটিয়ে পেনাল্টি এরিয়ার বাইরে থেকেই বল গোলের নিশানা খুঁজে পান। ডানপ্রান্ত দিয়ে করা এই গোলটি এখনও ইতালিয়ানদের কাছে সেরাদের সেরা হয়েই আছে।

নয়. এস্টিবান ক্যাম্বিয়াসো, ২০০৬

গত বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে সার্বিয়া মন্টেনেগ্রোকে ৬-০ গোলে পরাজিত করেছিল আর্জেন্টিনা। দক্ষিণ আফ্রিকান ফ্লেয়ার আর জার্মান প্রিসিশনে এই গোলটি করেন ক্যাম্বিয়াসো। মিডফিল্ডার হুয়ান রোমান রিকুলেমের বাড়ানো পাস থেকে হার্নান ক্রেসপোর টোকায় বল পান ক্যাম্বিয়াসো। ক্রেসপোর বেক হেডেড পাস থেকে ক্যাম্বিয়াসো সার্বয়ান গোলকিপারকে এমনভাবে পরাস্ত করেন যা ইতিহাসে ঠাঁই করে নেয়।

দশ. সাঈদ ওয়াইরান, ১৯৯৪

ফুটবলে সৌদি আরবের একটা ঐতিহ্য রয়েছে। আর এই দেশটি ১৯৯৪ সালে তাদের সেরা সময়টাই কাটিয়েছিল। বেলজিয়ামের বিপক্ষে করা তার এই গোলটি ১৯৮৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনার করা গোলের সঙ্গেই তুলনা করা হয়ে থাকে। ওয়াইরান চমৎকার গোল করলেও তার শুরুটা ছিল কিছুটা শ্লথগতির। সৌদি আরবের মিডফিল্ডার শুধু ওয়াইরানকে বলটাই দিয়েছিলেন তারপরের যা কাজ করার সবটাই করেছিলেন এই স্ট্রাইকার। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চারজন বেলজিয়ামকে কাটিয়ে অবশেষে গোলকিপার মাইকেল প্রিউডহোমকে বোকা বানিয়ে বল জালে জড়িয়ে নেন।

(দ্য রিপোর্ট/এসকে/এএস/এএল/জুন ২৯, ২০১৪)