দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবারের প্রকৃত বাসস্থান ছিল বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে। তার বাবা ভগবান চন্দ্র বসু সেসময় ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এছাড়া তিনি ব্রাহ্মণ সমাজের একজন বিশিষ্ট নেতাও ছিলেন।

ইংরেজ সরকারের অধীনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থাকা সত্বেও তিনি আর সবার মতো নিজের ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করাননি। জগদীশ চন্দ্রের প্রথম স্কুল ছিল ময়মনসিংহ জিলা স্কুল। পরে তিনি ১৮৬৯ সালে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। এরপর কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা করে ১৮৭৫ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৮৭৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে ভর্তি হন ১৮৮০ সালে। অসুস্থতার কারণে বেশিদিন পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। এরপর কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজ থেকে ট্রাইপস পাশ করেন। প্রায় একই সঙ্গে বিএসসি সম্পন্ন করেন।

দেশে ফিরে ১৮৮৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের অস্থায়ী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ভারতীয় হওয়ায় সেখানে তার বেতন নির্ধারণ করা হয় ইউরোপীয় অধ্যাপকদের বেতনের অর্ধেক। এই অন্যায়ের প্রতিবাদে দীর্ঘদিন তিনি কোনো বেতন না নিয়েই শিক্ষকতা করেন। অন্যদের চেয়ে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেন। এতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে তিন বছরের পাওনা বেতন পরিশোধ করে দেয়। তার চাকরিও স্থায়ী করা হয়। তখন থেকেই ইউরোপীয় ও ভারতীয় অধ্যাপকদের বেতনের বৈষম্য দূর হয়।

ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার প্রথম আঠারো মাসে জগদীশ যে সকল গবেষণা করেছিলেন তা লন্ডনের রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। ওই গবেষণা পত্রগুলোর সূত্র ধরেই ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন ১৮৯৬ সালের মে মাসে তাকে ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে। একই গবেষণার জন্য ইংল্যান্ডের লিভারপুলে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন তাকে আমন্ত্রণ জানায়। ওই বক্তৃতার সাফল্যের পর তিনি বহু স্থান থেকে বক্তৃতার নিমন্ত্রণ পান। এর মধ্যে ছিল রয়েল ইন্সটিটিউশন, ফ্রান্স ও জার্মানি।

১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি ও কোনো তার ছাড়া একস্থান থেকে অন্যস্থানে তা প্রেরণে সফলতা পান। ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞনী হের্‌ৎস প্রত্যক্ষভাবে বৈদ্যুৎতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। এ নিয়ে ররও গবেষণা করার জন্য তিনি চেষ্টা করছিলেন যদিও শেষ করার আগেই তিনি মারা যান। জগদীশচন্দ্র তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার ‘তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট’ তরঙ্গ তৈরি করেন। এ ধরনের তরঙ্গকেই বলা হয়ে অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাউক্রোওয়েভ। আধুনিক রাডার, টেলিভিশন ও মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলত এর মাধ্যমেই বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদান-প্রদান ঘটে থাকে।

এছাড়াও তার আবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম হলো- উদ্ভিদের বৃদ্ধিমাপক যন্ত্র ক্রেস্কোগ্রাফ, উদ্ভিদের দেহের উত্তেজনার বেগ নিরূপক সমতল তরুলিপি যন্ত্র রিজোনাস্ট রেকর্ডার অন্যতম।

উপমহাদেশে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ভিত্তি তার হাতেই সূচিত হয়। তিনি উপমহাদেশের একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমেরিকান প্যাটেন্টের অধিকারী। তার আবিষ্কৃত বেতার তরঙ্গের ভিত্তিতে মার্কনি রেডিও আবিষ্কার করেন।

বাঙালিরাও যে বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নিউটন-আইনস্টাইনের চেয়ে কম যায় না তিনি তা প্রমাণ করেন। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন জগদীশ চন্দ্র বসু সম্পর্কে নিজেই বলেছিলেন-‘জগদীশ চন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।’

তার লেখা্ উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে রেসপন্সেস ইন দ্য লিভিং অ্যান্ড নন-লিভিং (১৯০২), প্লান্ট রেসপন্সেস এজ এ মিনস অব ফিজিওলজিক্যাল ইনভেস্টিগেশনস (১৯০৬), কম্পারেটিভ ইলেকট্রপিজিওলজি (১৯০৭), নার্ভাস মেকানিজম অব প্লান্টস (১৯২৫), কালেক্টেট ফিজিক্যাল পেপার্স (১৯২৭), মটর মেকানিজম অব প্লান্টস (১৯২৮) ও গ্রোথ এন্ড ট্রপিক মুভমেন্ট ইন প্লান্টস (১৯২৯)। বাংলায় ছোটদের জন্য চমৎকার গদ্যে লিখেছেন ‘অব্যক্ত’ নামে একটা বই।

তিনি জীবদ্দশায় অনেকগুলো সম্মাননা লাভ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাইটহুড (১৯১৬) ও রয়েল সোসাইটির ফেলো (১৯২০)। তিনি লিগ অফ নেশন্‌স কমিটি ফর ইনটেলেকচুয়াল কো-অপারেশনের সদস্য ছিলেন। এছাড়া ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সাইন্সেস অফ ইন্ডিয়ার (বর্তমানে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সাইন্স একাডেমি) প্রতিষ্ঠাতা ফেলো। বাংলা ভাষায় প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখেন তিনি।

তার কৃত্তিমান ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, দেবেন্দ্রমোহন বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ও জ্ঞান মুখোপাধ্যায়।

তাকে নিয়ে বাংলায় অনেক বই রচিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফরহাদ মজহারের ‘জগদীশ’।

বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু ১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর ভারতের ঝাড়খণ্ডের গিরিডিতে পরলোক গমন করেন।

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/এমএইচও/নভেম্বর ২৩, ২০১৩)