মধ্যবিত্তের গণ্ডি অতিক্রম করা কিন্তু সহজ নয়। কেউ যে পারে না, তা নয়। কেউ কেউ পারে। কেউ কেউ পারে না। পারছে না মেক্সিকো। প্রতিবারই আশার পিদিম জ্বালিয়ে বিশ্বকাপে ফুটবলে অংশ নেয় দেশটি, ‘নিম্নবিত্ত’ থেকে সামাজিক মর্যাদায় ‘মধ্যবিত্ত’ হয়ে উঠে। এরপর আর এগিয়ে যেতে পারে না। বিশ্বকাপ ফুটবলের সঙ্গে এই দেশটির সখ্য একদম শুরু থেকেই। প্রথম বিশ্বকাপে অভিষেক হওয়ার পর এ পর্যন্ত কোয়ালিফাই করেছে ১৫বার। ১৯৯৪ সাল থেকে একটানা খেলেছে ‘রাউন্ড অব সিক্সটিন’-এ। ব্রাজিল আর জার্মানি ছাড়া এই কৃতিত্ব আর কারো নেই। অথচ দলটির সর্বাধিক সাফল্য ১৯৭০ এবং ১৯৮৬ সালে নিজের মাঠে কোয়ার্টার-ফাইনাল খেলা। ১৬ বছরের মধ্যে দুইবার বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করার গৌরব একমাত্র মেক্সিকোর। আর এটি সম্ভব হয়েছে ফুটবলের প্রতি মেক্সিকানদের নিবেদন আর ভালবাসায়।

ফুটবল খেলাটাকে একান্তই আপন করে নিয়েছে আজটেক সভ্যতার দেশ মেক্সিকো। ফুটবল নিয়ে এ দেশটিতে উন্মাদনার একটুও কমতি নেই। বরং এ ক্ষেত্রে তারা অন্য সবাইকে টেক্কা দিতে পারে। ফুটবলের হিপ্পি যদি কাউকে বলা যায়, সেক্ষেত্রে মেক্সিকানদের কথাই সবার আগে মনে আসে। ফুটবল মাঠকে রূপে, রঙে ভরিয়ে তুলতে তাঁদের জুড়ি মেলা ভার। ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে দর্শকদের বিচিত্র বেশভূষা ও সাজ-সজ্জার যে বাহার ও মাধুর্য দেখা যায়, সেক্ষেত্রে মেক্সিকানরা অতুলনীয়। দেশটিতে আদিবাসীদের বৈচিত্রের কারণে ফুটবল মাঠের গ্যালারিতে তার প্রতিফলন দেখা যায়। ফুটবল গ্যালারি মাতিয়ে তুলতেও মেক্সিকানরাই সবচেয়ে বেশি পারঙ্গম। এ কারণেই ফুটবল মাঠে জন্ম নিয়েছে ‘মেক্সিকান ওয়েভ’ কথাটি। স্প্যানিশ ভাষায় যাকে বলা হয়, ‘লা ওলা’। একই তালে, একই সুরে, একই ছন্দে পুরো স্টেডিয়ামের দর্শকরা হাতে হাত ধরে টেউয়ের মতো করে দুলে উঠেন। এর যে সৌন্দর্য, যে শোভা, যে মাদকতা, তার কোনো তুলনা হয় না। আর মেক্সিকানরা যখন এটা করে, তখন মনে হয়, নেচে উঠছে সবুজ বনভূমি। ১৯৮৬ সালে মেক্সিকো বিশ্বকাপ ফুটবলে বিশ্ববাসী প্রথম প্রত্যক্ষ করেন ‘মেক্সিকান ওয়েভ’। এরপর এটি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। গ্যালারিও যে ফুটবল বিনোদনের অংশ, এই দর্শন প্রচলনের কৃতিত্ব মেক্সিকানদের দেওয়া যেতে পারে। আর এখন ফুটবল মাঠের দর্শক আর গ্যালারিও যে হয়ে উঠে সৌন্দর্যের নন্দনকানন, তার পথপ্রদর্শকও বলা যেতে পারে প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী মেক্সিকানদের।

ফুটবল খেলা নিয়ে মেক্সিকানদের এত আচ্ছন্নতা, এত আবিষ্টতা, এত ভালবাসা, আর তাঁদেরই কিনা প্রতিবারই ফিরতে হয় একবুক হতাশা আর কান্না নিয়ে। এবারও সেই ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি। স্বাগতিক ব্রাজিলকে কাঁপিয়ে দিয়ে আর নেদারল্যান্ডসকে ছন্নছাড়া করে দেওয়ার পরও পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ফিরে গেছে মেক্সিকো। এ যেন নিয়তির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ। আসলে নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে হলে প্রথা ভাঙার সাহস, শক্তি ও অদম্য মনোবল থাকতে হয়। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস। সেটা বোধকরি মেক্সিকোর ফুটবল দলে নেই। না হলে দীর্ঘ দিন ধরে একই বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ার কথা নয় ফুটবলের এই বাউলদের।

(দ্য রিপোর্ট/ডিএম/এএস/ওআইসি/এনআই/জুন ২৯, ২০১৪)

dulalmahmud@yahoo.com