ফারহান জাহাঙ্গীর, অতিথি লেখক : ‘আমি যদি শত-সহস্র বছর ফুটবল খেলি তবুও ম্যারাডোনার কাছাকাছি যেতে পারব না। সেটা আমি চাইও না। সে সর্বকালের সেরা।’-কথটা বলেছেন বর্তমান সময়ের আর্জেন্টাইন ফুটবল জাদুকর লিওনেল মেসি। ফরাসি ফুটবল কিংবদন্তি মিশেল প্লাটিনি বলেছেন, ‘আমি ফুটবল নিয়ে যা করতে পারি, সে কমলালেবু দিয়ে তা করতে পারে!’

কখনও হাত দিয়ে গোল করেছেন, কখনও পৃথিবীর শত কোটি মানুষকে ১ কোটি বিস্ময় উপহার দিয়ে এক বাঁ পা দিয়েই ইতিহাসের গর্ভে তুলে দিয়েছেন অনিন্দ্যসুন্দর গোল। একক ণৈপুণ্যে বিশ্বকাপ জিতেছেন, ব্রাজিলের মতো পরাশক্তিকে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে ফেলেছেন মুহূর্তের এক জাদুতে। আবার কোকেইন, এফিড্রিন খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে ফিরেছেন নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে। বাঁ পায়ে তার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর ট্যাটু, ডান হাতে চে গুয়েভারার। ক্যাপিটালিজমের ঘোরতর শত্রু তিনি। জর্জ বুশকে সবার সামনে ‘খুনি’বলেছেন, ব্রাজিল ফুটবল গ্রেট পেলেকে বলেছেন, ‘মিউজিয়ামের বস্তু’। প্রেম করেছেন, বিয়ে হয়েছে, সন্তানও হয়েছে, আবার ডিভোর্সও হয়েছে। এরপর আবার প্রেম, আবার বিয়ে। প্রায় মৃত্যুপথ যাত্রী হয়ে হাসপাতালে গিয়েছেন, হাসতে হাসতে ফিরেও এসেছেন। নেপলস, উরুগুয়ের বিচ, বুয়েন্স আইরিসের বস্তি, ভেনিসের দ্বীপ শহরের কোথাও না কোথাও তার কোকেন ব্যবহারের সরঞ্জাম পড়ে রয়েছে। মুড ভালো নেই তো গুলি করে দিয়েছেন ফটো সাংবাদিককে। আর যদি মন বেশি ভালো তাহলে অনেক ফুর্তি-ওয়েল, ড্রেসিংরুমে একপ্রস্ত নাচ হয়ে যাক জন্মদিনের পোশাকে। ‘ডালমা আর জিয়ানিনা আমার বৈধ সন্তান। অন্যরা টাকা আর ভুলের ফসল’। এই হলেন ‘দিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা’।

আমেরিকান সংবাদপত্র হিউজটন ক্রনিকল সুন্দর লিখেছে- ‘আর্জেন্টিনার ওপর ম্যারাডোনার ছায়া কতটা বিশাল সেটা বুঝতে হলে বেব রুথের (মার্কিন বেসবল সুপারস্টার, ১৯২৪-১৯৩১) ক্ষমতা, মাইকেল জর্ডানের (বাস্কেটবল তারকা) অ্যাথলেটিসিজমের সঙ্গে মাইক টাইসনের অপরাধ প্রবণতা মিলিয়ে একটি হৃদয় তৈরি করুণ। তার মাথায় ঝাঁকড়া কালো চুল বসিয়ে দিলে তবেই হবে এল দিয়েগো-শতকোটি লোক যাকে আদর করে ডাকে “D10S”। তার জার্সি নাম্বারের (১০) আগে পেছনে যে দুটি অক্ষর তার অর্থ স্প্যানিশ ভাষায় গড।

‘আমি গোল করি। প্রতিদিন ভুল করি। সবকিছুর বিপক্ষে লড়াই করার মতো বিশাল এক হৃদয় আছে আমার। সারা জীবন পরিশ্রম করেছি। যারা বলে সবকিছু সহজেই পেয়ে গেছি, দে ক্যান কিস মাই অ্যাস।’-মন্তব্য ম্যারাডোনার। শেষের লাইনটুকু বাংলায় অনুবাদ করার প্রয়োজন আছে কি? একই ফ্রেমে বন্দি পেলে, ম্যারাডোনা ও জিদান। ‘আমি সাদা, নয়ত কালো। মাঝামাঝি কোনো অবস্থানে নেই। ভালোবাসুন আর ঘৃণা করুন, আমি এমনই, এল দিয়েগো!’

মাত্র ১০ বছর বয়সে তার মেধা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন ফ্রান্সেসকো কর্নেজো। ‘যখন আর্জেন্টিনা জুনিয়র্সে ডিয়েগো ট্রায়াল দিতে এসেছিল, ওর মেধা দেখে আমরা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলা না যে ছেলেটির বয়স ৮। ওর আইডি কার্ড পর্যন্ত দেখতে চেয়েছিলাম। সে বলেছিল, ওটা সঙ্গে নেই। বাচ্চা ছেলে, এতটুকু শরীর, অথচ ফুটবল নিয়ে কি পরিণত কসরত! তখনই আমরা সিদ্ধান্ত নেই এই ছেলের ওপর সবকিছু বিনিয়োগ করতে হবে।’

১৯৭৯ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে অপরিমেয় মেধা আর প্রাণশক্তি নিয়ে টোকিওতে হাজির হয়েছিলেন দিয়েগো। সেবার সোভিয়েত রাশিয়াকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ‘অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্বকাপ’ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। গোল্ডেন বল জিতেছিলেন ম্যারাডোনা বিন্দুমাত্র বিতর্ক ছাড়াই। সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখেছিল আর্জেন্টাইন ফুটবলের ভবিষ্যৎকে। ‘সবাই ম্যারাডোনা সম্পর্কে নিজের অভিমত প্রকাশ করতে চায়। ১৯৮৬-তে তার ঐতিহাসিক ওই গোল এবং অসাধারণ পারফরম্যান্স সারাজীবন মনে থাকবে। সত্যি বলতে কি ১৯৭৯ সালে টোকিওতে ওর খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি এবং বাকি সবাই। বাকি জীবনে ওর মেধা দিয়ে সে আমাদের আরও আনন্দ দেবে এই কামনা করি।’ ম্যারাডোনার ৫০তম জন্মদিনে কথাগুলো বলেছেন ফিফা সভাপতি সেপ ব্ল্যাটার।

১৯৭৮-এ অর্ডিলেস, প্যাসারেলা, ক্যাম্পেসদের সঙ্গে ম্যারাডোনাকে বিশ্বকাপ দলে নেয়ার জন্য কোচ সিজার লুই মেনোত্তির ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। শুধু তার নাম মেনোত্তি বলেই এই চাপ একপাশে ঠেলে তিনি ম্যারাডোনাকে স্কোয়াডের অন্য পাশে রেখেছিলেন। ক্যাম্পেসের ৬ গোল (ফাইনালে দু’টিসহ) এবং অর্ডিলেস, রুজেরিদের দারুণ পারফরম্যান্সে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জেতায় এ নিয়ে আর বিতর্ক হয়নি। ১৯৮২-তে স্পেনে যখন বিশ্বকাপের দ্বাদশতম আসর বসল তখন আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার নাম ম্যারাডোনা। বার্সেলোনার সঙ্গে তখন সবে মাত্রই ৫ মিলিয়ন পাউন্ডের (বিশ্বরেকর্ড) চুক্তি করেছিলেন ম্যারাডোনা। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ছোট্ট এক ফুটবল জাদুকরকে দেখতে। যদিও জাদু আর দেখা হলো না, উল্টো ‘সাদা পেলে’ জিকোর বুকে লাথি মেরে লালকার্ড দেখে বহিষ্কার ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনাও ঝরে পড়ল দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে।

মেক্সিকো ’৮৬। রুমেনিগে, ম্যাথিয়াস, ভোলার, বার্থোল্ড-শক্ত দল জার্মানি। রয়েছে প্লাটিনির ফ্রান্সও। সঙ্গে রসি, ডোনাডোনির ইতালি। সবার ওপরে ব্রাজিল- সক্রেটিস, সিজার, ফ্যালকাউ, কারেকাদের নিয়ে গড়া দল।

আর্জেন্টিনা ওই আসরে কেবলই ম্যারাডোনাসর্বস্ব। এক ভ্যালেডোনা খেলেন রিয়াল মাদ্রিদে আর প্যাসারেলা ফিউরেন্টিনায়। প্রথম ম্যাচে দ. কোরিয়ার বিপক্ষে সহজেই জিতেছিল আর্জেন্টিনা। ভ্যালেডোনার পর জোড়া গোল করেছিলেন রুজেরি। তবে ওই ম্যাচের পোস্টার হয়ে গিয়েছিলেন দিয়েগো ম্যারাডোনা-তার পা থেকে বল কেড়ে নিতে ৬/৭ জন কোরিয়ান ফুটবলার ওঁৎ পেতে আছে। ঢাকায় তখন ২ টাকায় পাওয়া যেত এই পোস্টার। পরের ম্যাচে ইতালির সঙ্গে ১-১ ড্র। প্রথম গোল পেলেন দিয়েগো। বুলগেরিয়ার বিপক্ষে আবার স্কোরশিটে ভ্যালেডোনা, সঙ্গে বুরুচাগার গোলে সহজ (২-০) জয়। দ্বিতীয় রাউন্ডে আর্জেন্টিনা। পাসকোলির একমাত্র গোল বিদায় করে দিল উরুগুয়ের এঞ্জো ফ্রান্সেসকোলিদের। কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। যে ম্যাচ নিয়ে ফিফার স্কোরশিটে লেখা রয়েছে আর্জেন্টিনা ২-১ ইংল্যান্ড। কি নিরীহ চেহারা! এই স্কোর লাইনের কি সাধ্য ঐ ম্যাচের মাহাত্ম্য বোঝায়?

ফুটবল ইতিহাসে এই ম্যাচের চেয়ে আলোচিত, নিন্দিত এবং অবশ্যই নন্দিত আর কোনো ম্যাচ নেই এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। ৫১ মিনিটে ম্যারাডোনার তৈরি করা আক্রমণ থেকে বক্সের বাইরে বল পেয়ে ফ্লিক করেছিলেন জজ ভ্যালেডোনা। বল নিয়ন্ত্রণে নিতে এগিয়ে এসেছিলেন ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটন, এগিয়ে গিয়েছিলেন ম্যারাডোনাও। শেষ মুহূর্তে লাফিয়ে উঠেছেন তিনি। কোথায় যেন বল ছোঁয়া পেল-শিলটনকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল জালে। ইংলিশ খেলোয়াড়রা দেখেছিলেন, রিপ্লেতে পুরো বিশ্বও দেখেছিল-মাথা নয় হাত দিয়ে গোল করেছেন ম্যারাডোনা! রেফারি দেখতে পাননি, কি করা! ফুঁসে উঠেছিল ইংলিশরা, ঝড় বয়ে গিয়েছিল কমেন্ট্রি বক্সে, ‘চিটিং! দিস ইজ নট ফেয়ার!’ তবে চার মিনিট পরই গোটা বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। বল পেয়েছিলেন নিজেদের সীমানায়। কুইক মুভ আর সেমি ব্যাকহিলে বেয়ার্ডসলিকে বোকা বানিয়ে একই সঙ্গে বলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন, একটু এগিয়েও গিয়েছিলেন। এরপর গুণে গুণে আরও ৯টি টাচ (মোট ১১টি), বুচার, ফেনউইক, হজ একে একে পেছনে পড়েছিলেন আর অসহায়ের মতো দৌড়াতে লেগেছিলেন ম্যারাডোনার পিছু পিছু। যোগ দিয়েছিলেন বিয়ার্ডসলি, রিডও। এগিয়ে এসেছিলেন শিলটনও। কাজ হয়নি। শিলটন বক্সে পড়েছিলেন, পাঁচজন ইংলিশ ডিফেন্ডার কোমড়ে হাত দিয়ে হতচকিত, ম্যারাডোনা দৌড়ে চলেছেন কর্নার ফ্লাগের দিকে, ফকল্যান্ড যুদ্ধে হারের জ্বালা মেটাতে এর চেয়ে চমৎকার ছবি আর কি হতে পারে!

মাঝমাঠ থেকে সাপের মতো এঁকেবেঁকে যে গতি নিয়ে পোস্ট পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন ম্যারাডোনা, ওই দৃশ্য ’৮৬-এর টিভি ক্যামেরা দিয়ে ফ্রেমবন্দি করার কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। ‘কাজটি কঠিন ছিল। তবে এরচেয়ে আনন্দের কাজ জীবনে আর করিনি। মনে হয় না আবার সুযোগ হবে।’ পরে বলেছিলেন ওই ক্যামেরাম্যান। ‘ছোট জোঁকের মতো ঘুরলেন ম্যারাডোনা, বাঁধা পেছনে ফেলে। লিটল স্কোয়াট ম্যান... কাম ইনসাইড

বুচার অ্যান্ড লিভস হিম ফর ডেড, আউটসাইড ফেনউইক অ্যান্ড লিভস হিম ফর ডেড অ্যান্ড পুটস দ্য বল অ্যাওয়ে... এবং এজন্যই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় ম্যারাডোনা।’ বিবিসি রেডিওতে ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন ব্রায়ান বাটলার। ওই পাঁচ মিনিট যেন ‘ডেভিল অ্যান্ড অ্যাঞ্জেল’ ম্যারাডোনার পুরো জীবনের প্রতীকী ছবি হয়ে গিয়েছিল। আর্জেন্টিনার দু’গোলের বিপক্ষে একটি শোধ করেছিলেন গ্যারি লিনেকার। সর্বোচ্চ ৬ গোল দিয়ে ওই আসরের গোল্ডেন বুট জেতা লিনেকার পরে বলেছেন ‘যখন দিয়েগো আমাদের বিপক্ষে দ্বিতীয় গোলটি করেছিল, সত্যি বলছি মনে মনে প্রশংসা করেছিলাম আমি। ওটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ছিল শুধু এ কারণে নয়, এত সুন্দর গোল করা অসম্ভব। নিঃসন্দেহে ম্যারাডোনাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়। বাকিরা বহুদূরে!’

ম্যাচশেষে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘আমার মাথা আর ঈশ্বরের হাত ছিল প্রথম গোলের পেছনে!’ এর প্রায় ১৯ বছর পর ২০০৫ সালের ২২ আগস্ট ম্যারাডোনা স্বীকার করেছেন, ‘ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই গোলটি হাত দিয়ে করেছিলাম।’ ‘হ্যান্ড অফ গড’ কথাটি চিরদিনের জন্য ফুটবল ইতিহাসের ‘মিথ’ হয়ে গেছে।

সেমিতে এঞ্জো সিফোর বেলজিয়াম আর্জেন্টিনার সামনে দাঁড়াতেই পারেনি, একাই ম্যারাডোনা করেছিলেন দু’গোল। এর একটি ওই ঐতিহাসিক গোলের প্রায় কাছাকাছিই ছিল। ফাইনালে ম্যারাডোনাকে কঠোর মার্কিংয়ে রেখেছিল জার্মানি। মাঝমাঠ থেকে খেলা পরিচালনা করেছিলেন ম্যারাডোনা। ২৩ মিনিটে ডিফেন্ডার ব্রাউনের দুর্দান্ত হেডার, ৫৫ মিনিটে ভ্যালেডোনার চমৎকার প্লেসমেন্ট, কাঁপতে শুরু করেছিল জার্মানি। তবে বহুবারের মতো এবারও হতাশাকে শক্তিতে পরিণত করে মাত্র ৬ মিনিটের ব্যবধানে ২ গোল শোধ করে ’৭৪-এর চ্যাম্পিয়নদের ম্যাচে ফিরিয়েছিলেন রুমেনিগে, ভোলার। অতঃপর ম্যারাডোনার সেই বিখ্যাত পাস, বরুচাগার কুল ফিনিশিং-মেক্সিকো বিশ্বকাপ আর্জেন্টিনার।

‘বিশ্বকাপের আগে ম্যারাডোনাকে যখন অধিনায়ক করেছিলাম তখন অনেকেই সমালোচনা করেছিল। এক মাস পরের চিত্রটা একেবারে ভিন্ন। যাকে বলে ‘কমপ্লিট ডমিনেন্স’। তার মেধা ও পরিশ্রমের যোগ্য পুরস্কার ছিল বিশ্বকাপ’-বলেছেন ’৮৬-এর আর্জেন্টিনা কোচ কার্লোস বিলার্ডো। ১৯৮৬-র বিশ্বকাপ যে একহাতে জিতেছেন ম্যারাডোনা এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই। নেপোলি যে তাদের ৯০ বছরের ইতিহাসে মাত্র দু’বার স্কুডেট্রো জিতেছে তাও এই ‘বদ’ ছেলের বাঁ পা দিয়েই। উয়েফা কাপ, ইতালিয়ান কাপের সঙ্গে সিরি ‘এ’-তে দু’টি রানার আপ ট্রফি-৫ বছরে ম্যারাডোনা এক চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ছাড়া সবই দিয়েছেন নেপোলিকে। ম্যারাডোনা চলে গেলে নেপোলিও আবার ঢাকা লিগের আরামবাগেই পরিণত হয়েছিল।

বিশাল গোল ভাণ্ডার আর তিনটি বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়েও শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে ম্যারাডোনার সামনে খাবি খেতে হয় ‘কালো মানিক’ পেলেকে। ১৯৬২-তে পেলেকে ছাড়াই দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জিতেছিল গ্যারিঞ্চা, আমারিল্ডোরা।

১৯৭০-এ রিভেলিনো, জোয়ারজিনহো, টোস্টাও, আলবার্তোদের সঙ্গ পেয়েছিলেন পেলে। ১৯৯৯ সালে ফিফা শতাব্দী সেরা ফুটবলারের নির্বাচনে প্রথমে কেবল সাধারণ মানুষের ভোটের ওপরই নির্ভর করেছিল। সেখানে পেলের ১৮.৫৩ শতাংশ ভোটের বিপরীতে ম্যারাডোনা পেয়েছিলেন ৫৩.৬ শতাংশ। অবস্থা বেগতিক দেখে সাংবাদিকদের ভোট ও জুরিবোর্ডের সিদ্ধান্তে পেলেকে বিকল্প একটি পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল ফিফা। ‘আমাকে সবাই সেরা নির্বাচিত করেছে। অথচ ফিফা বলছে পেলের সঙ্গে পুরস্কার ভাগাভাগি করতে। আমি তা করব না’- বলেছিলেন ম্যারাডোনা।

১৯৯০ বিশ্বকাপেও ছিলেন দিয়েগো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফাইনালে উঠেছিল আর্জেন্টিনা। ব্রেহমের বিতর্কিত পেনাল্টি গোলে ’৮৬-এর প্রতিশোধ নিয়েছিল জার্মানি। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়েছিলেন ম্যারাডোনা। কেঁদেছিলেন পৃথিবীর লক্ষ-কোটি সমর্থকও। পরের দিন বিভিন্ন দেশের পত্রিকায় খবর ছাপানো হয়েছিল-ম্যারাডোনার দুঃখ সইতে না পেরে কেউ হার্টফেল করেছে, কেউ বা সুইসাইড। দিস ইজ ম্যারাডোনা!

১৯৯১-তে নেপোলি এবং ’৯৪-তে ফিফা ১৫ মাসের জন্য ফুটবল থেকে বহিষ্কার করে ম্যারাডোনাকে। অপরাধ-ডোপটেস্টে পজিটিভ। নেপোলিতে খেলার সময় কর ফাঁকির অভিযোগ উঠেছিল তার বিপক্ষে। বর্তমানে ইতালিয়ান সরকার ৩৭ মিলিয়ন ইউরো ট্যাক্স পায় ম্যারাডোনার কাছে। ’৯০-এর বিশ্বকাপ সেমিতে আর্জেন্টিনার কাছে ইতালি টাইব্রেকারে হেরে যাওয়ার পর নেপোলিতে ম্যারাডোনার জনপ্রিয়তায় সামান্য ভাটা পড়ে। ভাটা পরে আর কতটুকু কমবে? নেপোলির মানুষ ম্যারাডোনা বলতে পাগল। এখন যাদের বয়স ৫০ কিংবা ৪০ তারা স্মৃতি রোমন্থনে বলেন, ‘ওটা একটা পাগল করা সময় ছিল। নেপোলির প্রতিটি বিলবোর্ড, বড় দেয়াল, ব্রোশিয়ার কিংবা যে কোনো গ্যাজেট-সব জায়গায় ম্যারাডোনার ছবি। তার মতো চুল রাখতাম। তার নামে গান বানাতাম। প্রতি শনিবার দল বেঁধে মাঠে যেতাম, গান গাইতাম। আর ম্যারাডোনা একেক দিন প্যান্ডোরার বক্স খুলে বিস্ময়কর জাদু দেখাত। দরিদ্র, বেকার নেপোলিয়ান যুবকরা দিয়েগোর খেলা দেখে এবং পরের দিকে শুধু নাম শুনেই ঝেরে ফেলতো সব হতাশা। নাইজেরিয়া, নেপালের মত জায়গায় মানুষ ইতালি নাম শুনলে বলত, ওহ্ ম্যারাডোনা, নেপোলি! সে বিশ্বে আমাদের পরিচিত করেছে।’

ম্যারাডোনার জন্য নেপলসের মানুষ অনেকগুলো ফ্যানপেজ খুলেছে। তার একটিতে লেখা আছে, পেলের চেয়েও অনেক বড় ফুটবলার ম্যারাডোনা। সবার নিচে খেয়াল করলে দেখবেন কিছু শব্দ নিয়ে থম মেরে আছে একটি বাক্য ‘নেপলসের তিনটি জিনিস আছে। সাগর, ভিসুভিয়াস আর ম্যারাডোনা!’ ১৯৯১ সালে ক্লাব ছাড়ার পর নেপোলি যে চিরজীবনের জন্য ১০ নম্বর জার্সিটাকে অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছে তাতে আর অবাক হওয়ার কি আছে!

ম্যারাডোনাই একমাত্র ফুটবলার যিনি দু’বার ট্রান্সফার ফি’র বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। বার্সা সভাপতি জোসেফ লুই গোমেজের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে কাতালুনিয়া ছেড়েছিলেন ম্যারাডোনা। ৬.৯ মিলিয়ন পাউন্ডে তাকে দলে ভিড়িয়েছিল নেপোলি। বার্সেলোনায় সংক্ষিপ্ত সময়ে ৫৮ ম্যাচে ৩৮ গোল করা দিয়েগো কোপা দেল রে-তে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে বার্নাব্যুতে প্রথম প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় হিসেবে পেয়েছিলেন ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’-যে সম্মান পরবর্তীতে শুধুমাত্র ব্রাজিলিয়ান প্লেমেকার রোনালদিনহোর কপালে জুঁটেছিল।

২০০০ সালে ‘আই অ্যাম দ্য দিয়েগো’ নামে আত্মজীবনী বের হয় ম্যারাডোনার। আর্জেন্টিনায় বেস্ট সেলার ছিল বইটি। দেশের বিখ্যাত সব সঙ্গীত শিল্পীই গান করেছেন ম্যারাডোনাকে নিয়ে। রোজারিওতে (যেখানে শৈশব কাটিয়েছেন দিয়েগো) ‘চার্চ অব ম্যারাডোনা’ নামে একটি প্যারোডি রিলিজিয়ন আছে যার ‘ফান্ডিং’ সদস্য ১০০ জন। ইন্টারনেটে সদস্যপদ গ্রহণ করেছেন লক্ষাধিক মানুষ। সেখানে খ্রিস্টানদের অনেক ধর্মীয় নিয়ম-কানুন ঘটা করে পালন করা হয়।

আর্জেন্টাইনদের কাছে ম্যারাডোনা কি, এই বিষয়ে ১৯৮৬-এর বিশ্বকাপ সতীর্থ জর্জ ভ্যালেডোনার স্মরণাপন্ন হওয়া যাক-‘ম্যারাডোনা যখন ফুটবল থেকে অবসর নেন তখন বামপন্থীদের সৃষ্ট নানা সমস্যায় জর্জরিত আর্জেন্টিনা। কয়েকটি মিলিটারি একনায়কতন্ত্রের ছায়া তখনও জনগণের পিছু ছাড়েনি। ম্যারাডোনার কথা ভেবে, তার খেলা দেখে মানুষ বেঁচে থাকার, লড়াই করার শক্তি পেত, ঝেরে ফেলত সামগ্রিক হতাশা। এ জন্যই মানুষ তাকে ভালবাসে। আর্জেটাইনদের কাছে সে স্বর্গীয় দূত। পেলে, বেকেনবাওয়াররা শুধুই ফুটবলার। ম্যারাডোনা একটি প্রতিবাদী কণ্ঠ, আজন্ম বিপ্লবী, ক্যাপিটালিজম ও মার্কিন রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো অনমনীয় এক সেনা- যার ভয় নেই, ডর নেই, আওয়াজ ওঠানোর সময় নিজের স্বার্থ ও অবস্থানের কথা বেমালুম ভুলে যান। মনে রাখার প্রয়োজনও অনুভব করেন না। ফিদেল ক্যাস্ট্রো তার বন্ধু। কিউবায় মাদকবিরোধী চিকিৎসা নেয়ার সময় প্রেসিডেন্টের বিশেষ অতিথি ছিলেন তিনি।’

‘দিয়েগো একজন মহান মানুষ, আমার বন্ধু। চমৎকার ক্রীড়াবিদও। সব সময় কিউবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করেছে, নিজের স্বার্থের কথা চিন্তাও করেনি।’-বলেছেন কিউবান প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো। নিজের আত্মজীবনীর কিউবান সংস্করণের রয়ালটি ক্যাস্ট্রোর তহবিলে দান করেছেন ম্যারাডোনা। বইটি উৎসর্গ করেছেন ক্যাস্ট্রো ও তাঁর বিপ্লবী সতীর্থদের। বইয়ের ওপর লিখেছিলেন-‘ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে এবং তাঁর মাধ্যমে কিউবার সকল জনগণকে।’

মার্কিনবিরোধী সবার সঙ্গে ম্যারাডোনার খাতির। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ইরানের জনগণকে সমর্থন করে এমন একটি বাক্য লেখা টি শার্টে সই করেছিলেন ম্যারাডোনা। জার্সিটি পরে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়েছিল। হুগো শ্যাভেজ ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ২০০৫ সালে প্রয়াত ভেনেজুয়েলিয়ান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল ম্যারাডোনার। ‘আমি ভেবেছিলাম একজন মহান নেতার সঙ্গে দেখা হবে। কিন্তু শ্যাভেজ এরচেয়েও বড় কিছু। আমি তাকে বিশ্বাস করি। আমি একজন শ্যাভিস্টা। ফিদেল ও শ্যাভেজ যা করে তাই আমার কাছে সেরা।’ পরে বলেছিলেন দিয়েগো। ২০০৭ সালে আবার ভেনেজুয়েলা গিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একটি টিভি শোতে হাজির হয়ে বলেছিলেন, ‘আমেরিকা থেকে যা কিছু আসে সবকিছু আমি ঘৃণা করি। ঘৃণা করি সর্বশক্তি দিয়ে’। ২০১৩-এর এপ্রিলে শ্যাভেজের সমাধিস্থল পরিদর্শন করেছেন ম্যারাডোনা এবং তাঁর উত্তরসূরি নিকোলাস মাদুরাকে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার জন্য অনুরোধ করেছেন ভেনেজুয়েলাবাসীকে। মাদুরার চূড়ান্ত নির্বাচনী প্রচারণার দিনও হাজির ছিলেন ম্যারাডোনা। কারাকাসের রাস্তায় র‌্যালিতে‌ অংশ নিয়েছিলেন,ফুটবলে সই করে ভক্তদের বিতরণ করেছিলেন। মাদুরাকে আর্জেন্টাইন জাতীয় দলের একটি জার্সিও দিয়েছিলেন।

‘দিয়েগোর সঙ্গে কথা বলা ছিল বিশেষ কিছু, কারণ কমান্ডার শ্যাভেজ তাকে ভালোবাসতেন।’ বলেছেন নিকোলাস মাদুরা। এভাবেই ফুটবলার ম্যারাডোনাকে ছাড়িয়ে গেছেন তৃতীয় বিশ্বের একজন নিঃস্বার্থ সমর্থক ম্যারাডোনা।

সার্বিয়ার ছবি নির্মাতা আমির কুস্তোরিকা ‘ম্যারাডোনা’ নামে একটি তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন। তিনি সম্ভবত এই গ্রেট ফুটবলার সম্পর্কে সবচেয়ে যথাযথ উক্তিটি করেছেন,‘আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি এই লোকটি কে? কে এই ফুটবলের জাদুকর, আন্তর্জাতিক ফুটবলের সেক্স পিস্টল, যে কিনা কোকেইনের স্বীকার, আবার লাথি মেরে এই অভ্যাস পরিত্যাগ করেছে, স্পেগহেট্টির মত নরম! যদি অ্যান্ডি ওয়ারহল (মার্কিন চিত্রশিল্পী) বেঁচে থাকতেন, তাহলে নিশ্চিত করেই মাও সেতুং ও মেরিলিন মনরোর পাশে বসাতেন ম্যারাডোনাকে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ফুটবলার না হলে দিয়েগো বিপ্লবী হতেন!’

ক্লাব ক্যারিয়ার (সিনিয়র)

সাল ক্লাব ম্যাচ গোল

১৯৭৬-৮০ আর্জেন্টিনা জুনিয়র্স ১৬৭ ১১৫

১৯৮১-৮২ বোকা জুনিয়র্স ৪০ ২৮

১৯৮২-৮৪ বার্সেলোনা ৫৮ ৩৮

১৯৮৪-৯১ নেপোলি ২৫৯ ১১৫

১৯৯২-৯৩ সেভিয়া ২৯ ৮

১৯৯৩-৯৪ নিউয়েলস ওল্ড বয়েজ ৫ ০

১৯৯৫-৯৮ বোকা জুনিয়র্স ৩১ ৭

মোট ৫৮৯ ৩১১

জাতীয় দল

সাল দেশ ম্যাচ গোল

১৯৭৭-৯৪ আর্জেন্টিনা ৯১ ৩৪

ম্যানেজার : রেসিং, আর্জেন্টিনা, করিন্টেস, আল ওয়াসলি।

অর্জন

বোকা জুনিয়র্স :

আর্জেন্টাইন লীগ, ১৯৮১।

বার্সেলোনা :

কোপা ডেল রে, লিগ কাপ।

স্প্যানিশ সুপার কাপ, ১৯৮৪।

নেপোলি :

ইটালিয়ান লিগ, ১৯৮৭, ’৯০।

ইটালিয়ান কাপ, ১৯৮৭।

উয়েফা কাপ, ১৯৮৯।

ইটালিয়ান সুপার কাপ, ১৯৯০।

আর্জেন্টিনা :

যুব বিশ্বকাপ - ১৯৭৯ (চ্যাম্পিয়ন)।

বিশ্বকাপ - ১৯৮৬ (চ্যাম্পিয়ন)।

বিশ্বকাপ - ১৯৯০ (রানার আপ)।

ব্যক্তিগত অর্জন

বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় - ১৯৮৬।

যুব বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় - ১৯৭৯।

আর্জেন্টিনার বর্ষসেরা ফুটবলার - ১৯৭৯, ’৮০, ’৮১, ’৮৬।

দঃ আমেরিকার বর্ষসেরা ফুটবলার - ১৯৭৯, ’৮৬।

ইউরোপিয়ান কাপে সর্বোচ্চ স্কোরার - ১৯৮৭, ’৮৮।

ওয়ার্ল্ড সকার বর্ষসেরা ফুটবলার - ১৯৮৬।

ফিফা শতাব্দী সেরা ফুটবলার - ২০০০।

অন্তর্ভুক্তি : ফিফা সর্বকালের সেরা একাদশ, ওয়ার্ল্ড সকার শতাব্দী সেরা একাদশ, ফিফা ড্রিম টিম।

দিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা

জন্ম : ৩০ অক্টোবর, ১৯৬০।

জন্মস্থান : বুয়েন্স আইরিস, আর্জেন্টিনা।

উচ্চতা : ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি।

পজিশন : অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার, স্ট্রাইকার।

(দ্য রিপোর্ট/এফজে/এএস/সিজি/এনআই/জুলাই ১, ২০১৪)