১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ টিভিতে দেখিয়েছিল। ঢাকা শহরে তখন ১০ তলা বিল্ডিং আর টেলিভিশনের সংখ্যা প্রায় সমান। যে ম্যাচে ব্রাজিলকে একাই ধ্বংস করে দিলেন পাওলো রসি; গভীর রাতে সে ম্যাচটি বাড়িওয়ালার বাসায় দেখেছিলাম কি-না মনে নেই। আবছা, আবছা রসির চেহারা তবু মনে আসে। পরে বাবা বলেছেন, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে একটা ছেলে বিশ্বকাপটাই জিতে নিল। ১৯৮৬ সালে আমাদের প্রজন্ম দুরন্ত কিশোর। ম্যারাডোনার নাম শুনি, বড় ভাইরা বলেন, এবার বিশ্বকাপ ব্রাজিলের। দলে আছে জিকো, সক্রেটিস, ফ্যালকাও, আরও আছেন জুনিয়র, অ্যালেমাও, কারেকা। তারা সবাই তারকা। একঝাঁক হলুদ মৌমাছি যেন, যাকে পাবে তাকেই হুল ফোটাবে।

যথাসময়ে টুর্নামেন্ট শুরু হল। কিছু ম্যাচ দেখার সৌভাগ্য হয়, কিছু না দেখার যন্ত্রণা। এর মধ্যেই মাইকেল লুড্রাপ, এমিলিও বুট্রাগুয়েনোদের চিনে ফেলেছি। আলো ছড়াতে শুরু করেছেন ম্যারাডোনা। সক্রেটিস-ফ্যালকাওরা সাম্বাছন্দে মুগ্ধ করে চলেছেন সবাইকে। কিন্তু আমাদের অনেকের চোখ আটকে গেল সাধাসিধা ‘কিউট’ চেহারার এক ভদ্রলোকের ওপর। ঝাঁকড়া গুয়ামুড়ি চুল, পানপাতার মতো মুখ। বুকে মোরগের ছাপ। জার্সিটা শর্টসের ওপর ঝুলে থাকে, কি মায়াময় হাসি। আমার তো মনে হলো একে হলিউডের নায়ক বানানো যাবে। আরও জানলাম প্লাতিনি তার নাম। পদে মিডফিল্ডার, প্রায়ই লজ্জা দেন স্ট্রাইকারদের। তখনও ইতালিয়ান ফুটবলে তার কাণ্ডকীর্তির গল্প জানি না। পরাশক্তি হিসেবে ফুটবলে দানব গোত্রীয় কিছু নয় ফ্রান্স। তারপরও লা ব্লুজদের সমর্থক হয়ে গেলাম। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে ২-০ গোলে হারাতে বেগ পেতে হয়নি একদম। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের সঙ্গে হলো দারুণ এক ম্যাচ। কারেকার গোলের জবাবে প্লাতিনির সমতাসূচক- পুরো ম্যাচে এই দুটিই ফিল্ড গোল। তবুও নিঁখুত পাসিং, অসাধারণ ড্রিবলিং আর মুহুর্মুহু আক্রমণে ফুটবলের লাল, নীল, বেগুনি সব রঙ মেলে ধরলো জিকো-জিরেসরা। অ্যালান জিরেস, জ্যাঁ টিগানা আর লুইস ফার্নান্ডেজকে নিয়ে প্লাতিনির ‘ম্যাজিক স্কয়ারে’র বিপরীতে সক্রেটিস-ফ্যালকাও আর অ্যালেমাও পুরো মাঠকে অহিংস রণাঙ্গন বানিয়ে ফেললেন। ম্যাচের শেষদিকে জিকো পেনাল্টি মিস করলেন। কেউ হারলো না। টাইব্রেকারে ব্রাজিল আউট। স্পটকিক মিস করলেন প্লাতিনি। একই দশা ব্রাজিলের ডাক্তারেরও (সক্রেটিস)। ততদিনে আরও জানলাম জার্মানি, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের মতো এই বিশ্বকাপে ফেভারিট হিসেবেই নাম লিখিয়েছে ফ্রান্স। ব্যাকগ্রাউন্ড? ব্যাকগ্রাউন্ড ১৯৮৪-এর ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ আর এই যে মিষ্টি ছেলেটি প্লাতিনি। আরও জানলাম, ক্রুয়েফ, বেকেনবাওয়ার আর জর্জ বেস্টের বিদায়ের পর ইউরো ফুটবলের কর্তৃত্ব এখন পুরোপুরি তার হাতে। জুভেন্তাসে ফুটবল খেলার নামে তিনি যা করেন তাকে জাদু তো বলাই যায়, এরচেয়েও শিল্প বলতে আগ্রহ সর্বকূলের। ঠিক সময়ে ঠিক পাস, খেলা সম্পর্কে অসাধারণ জ্ঞান, খেলা শুরু করেন মাঝমাঠে, কিন্তু সারাক্ষণই ওপরে থাকেন। ডেড্বল স্ট্রাইকে ‘নুমেরো ওয়ান’। দূর থেকে, বক্সের ভেতর থেকে, সাইড থেকে অনায়াসে গোল করেন। ফ্রি কিক থেকে যে চাইলেই গোল করা যায়, বছরের পর বছর তা প্রমাণ করে চলেছেন। বেকহ্যাম, জুনিনহো, এখন রোনালদো, মেসি, এরও আগে ব্রাজিলের জোয়ারজিনহো এই কর্মটিতে যথেষ্ট পাকা ছিলেন। কিন্তু বড় হয়ে প্লাতিনির ভিডিওগুলো দেখার পর এ বিষয়ে তার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে এতটুকু কষ্ট হয়নি। ইউরো ১৯৮৪-তে যাওয়ার আগে একটু শুনি প্লাতিনি সম্পর্কে পেলে কি বলেন, ‘ক্রুয়েফের মতো দৌড়াতে পারে না সে। শরীরের ওপর নির্ভরশীল নয়। আমি অবাক হই তার মগজের প্রয়োগ দেখে। সব সময় মাথা দিয়ে খেলে প্লাতিনি। ফ্রান্স ও জুভেন্তাসের হয়ে সে যা করেছে, সঙ্গে ফ্রি-কিকের বিষয় যদি বলেন, মানতেই হবে আশির দশকে ইউরোপের সেরা ফুটবলার সে।’ ডেনমার্কের বিপক্ষে জয়সূচক গোল দিয়ে প্লাতিনির ইউরো (১৯৮৪) অভিযান শুরু। এরপর বেলজিয়ামের বিপক্ষে পারফেক্ট হ্যাটট্রিক। সেমিফাইনালে পর্তুগালের সঙ্গে যখন ২-২ স্কোরলাইন, পুরো ফ্রান্স নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে গেছে, তখন আবারও প্লাতিনি জাদু। অতিরিক্ত সময়ের গোলে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পরে পর্তুগাল। সারাজীবন অনেক ডেডলি ফ্রিকিক নিয়েছেন প্লাতিনি। সেবার ফাইনালে যেটা নিলেন, তাতে গতি, বাক তেমন কিছুই ছিল না, কিন্তু প্লাতিনির ফ্রি-কিক! এটা তো গোল হবেই- সম্ভবত এই নার্ভাসনেস থেকে মারাত্মক ভুল করে বসেন স্প্যানিশ কিপার লুইস অ্যাকরোনাডা। টুর্নামেন্টের ৯ নাম্বার গোল পেয়ে যান প্লাতিনি। পরে ব্রুনো বেলোনি দ্বিতীয় গোল করলে ম্যাচে ফেরার সব পথ বন্ধ হয়ে যায় স্পেনের। প্রথমবার বড় কোনো শিরোপা জিতল ফ্রান্স। জাতীয় দলে প্লাতিনির প্রভাব কত তীব্র ছিল তা বোঝা যায় তার অবসরের পর। ১৯৯০-৯৪ তে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বই টপকাতে পারেনি ফ্রান্স। অথচ ১৯৮৬-তে শিরোপা জিতলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। তবে ফ্রান্সের ফাইনালে যাওয়া উচিত ছিল। সম্পূর্ণ খেলার ধারার বিপরীতে প্রথমে ব্রেইমে (৯ মিনিট), পরে ভোলারের গোলে জয় নিয়ে ফাইনালে ওঠে যায় জার্মানি। অভিমান করে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ খেলতে নামেননি প্লাতিনি। বিশ্বকাপ নিয়ে হালকা অভিমান আছে। কিন্তু ক্যারিয়ার নিয়ে আফসোস নেই। ‘আই গেভ এভরিথিং। সো আই ডোন্ট হ্যাভ অ্যানি রিগ্রেটস।’ অবসরের পর বলেছেন মিশেল প্লাতিনি। প্রায় একই সময়ে জুভেন্টাসে যোগ দেন বনিয়েক ও পাটিনি। সন্ধ্যের ম্যাচগুলোতে বনিয়েকের চমৎকার খেলা দেখে তৎকালীন জুভে প্রেসিডেন্ট জিওভান্নি অ্যাগনেল্লিএই পোলিশ মিডফিল্ডারের নাম দিয়েছিলেন ‘বেলো ডি নোট্টি’। মানে ‘বিউটি অ্যাট নাইট’। পরের তিন বছর প্লাতিনির পাশে বনিয়েকের মতো খেলোয়াড় এতই ম্রিয়মান ছিলেন যে, অনেকের মনেই থাকে না একসময় জুভেন্তাসে খেলতেন বনিয়েক। জুভেন্টাসের হয়ে সবই জিতেছেন প্লাতিনি। দু’বার ইতালিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, ইতালিয়ান কাপ, উয়েফা কাপ, ইউরোপিয়ান সুপার কাপ এবং ‘জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন’-ইউরোপিয়ান কাপ। ১৯৮৫ সালে লিভারপুলের বিপক্ষে ব্রাসেলসের হেইসেল স্টেডিয়ামের ইউরো ফাইনালটি যদিও ফুটবল ইতিহাসের করুণ এক কাহিনী হয়ে আছে। ম্যাচ শুরুর আগেই সমর্থকদের মধ্যে তীব্র দাঙ্গা শুরু হয়। মারা যায় ৩৯ জন, আহত ৬ শতাধিক। ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেন প্লাতিনি, পেনাল্টি থেকে। গোলের পর তার উল্লাস পরবর্তীতে অনেকের সমলোচনা কুড়িয়েছে। ‘আসলে মাঠ থেকে আমি ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতে পারিনি।’ আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছেন প্লাতিনি। মেনে নিয়েছে সবাই। কারণ, অন্যকে দুঃখ দেওয়া, অহংকার, অনৈতিক কর্মকাণ্ড, অহমিকা কখনোই জায়গা পায়নি প্লাতিনির অভিধানে। ১৯৮৩-৮৫ সাল; টানা তিনবার ব্যালন ডি অ’র (ইউরো বর্ষসেরা ফুটবলার) জেতা মিশেল- ১৯৮৩ ও ১৯৮৫ সালে ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা ফুটবলারও। তারপরও পা মাটিতেই থাকতো তার। এ বিষয়ে প্রায় একযুগ জুভেন্তাসের গোলবার পাহারা দেওয়া স্টেফান টাকোনির মন্তব্যটা স্মরণে নেওয়া যেতে পারে- এত এত সাফল্য পেলে একটি ঝুঁকি সব সময় থেকে যায় অন্তিম সময়ে না পদস্খলন (স্টুপিডিটি বলেছেন টাকোনি) হয়- যেমনটি হয়েছিল ম্যারাডোনার। কিন্তু মিশেল ছিল ধীরস্থির ও বন্ধুভাবাপন্ন। কখনোই ওপরের দিকে তাকাতো না। এ জন্যই সে সবার থেকে আলাদা।

১৯৮৬ বিশ্বকাপের পর অবসরের আগে আরও এক বছর জুভেন্তাসে ছিলেন প্লাতিনি। নাপোলি যেমন ম্যারাডোনার, রোমের টট্টি আর মিলানের মালদিনি তেমনি তোরিনোর অতি আদরের, আবেগের আর আপন ছিলেন ফরাসি উইজার্ড। বিদায়ের দিনে ক্লাব প্রেসিডেন্ট অ্যাগনেল্লি বলেছিলেন, ‘আজ বড় দুঃখের দিন। আরেকটি উপহার, যে কিনা স্বর্গ থেকে আমাদের কাছে এসেছিল, এখন চলে যাচ্ছে। জুভেন্টাসের সর্বকালের সেরাদের একজন হয়ে আমাদের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবে প্লাতিনি।’

তার কাছে ফুটবল ছিল সহজ- ‘আমার কাছে ফুটবল হলো সঠিক সময়ে সঠিক পাস দেওয়া।’ টানা তিনবার (১৯৮৩, ৮৪ এবং ৮৫) ইতালিয়ান লিগে সর্বোচ্চ স্কোরার কিন্তু অতিরিক্ত অনুশীলনের বিপেক্ষ ছিলেন। তাকে ‘কোট’ করে সাবেক জুভ ও ইতালিয়ান কোচ জিওভান্নি ত্রাপাত্তোনি বলেছেন ‘ফিটনেস ট্রেনিংয়ের বিষয়ে মিশেলের অত বাড়াবাড়ি ছিল না। সে বলত, আমরাতো অলিম্পিকে ৫ হাজার মিটারে দৌড়াতে যাচ্ছি না! আমাদের শুধু পা দিয়েই খেলতে হবে।’ ফন্টেইন (১৯৫৮ বিশ্বকাপে রেকর্ড ১৩টি গোল করেছিলেন) রেমন্ড কোপা আর পন্টিয়ানোদের ছাপিয়ে একসময় ফরাসি ফুটবলের-আলটিমেট স্টেটমেন্ট হয়ে উঠেন মিশেল প্লাতিনি। বড় উদাসী ভঙ্গিতে জিনেদিন জিদান পর্দায় হাজির হওয়ার পর, ফ্রান্সকে আরেকটি ইউরোপিয়ান কাপ এবং চিরআরাধ্য বিশ্বকাপ জেতানোর পর অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নটা উঠেই যায়। এখন কে সেরা? সারা বিশ্বের সাংবাদিকরা জিদানকে গত ৫০ বছরের ইউরোপ সেরা হিসেবে নির্বাচিত করার পর তর্কটা মিলিয়েও যায়। তবে এ বিষয়ে জিদানের একটা মন্তব্য না উল্লেখ করে পারছি না।‘কে সেরা আমি জানি না। তবে ছোট বেলায় খেলার সময় বন্ধুদের আগেই বলেনিতাম, আমি কিন্তু প্লাতিনি, এবার তোমরা যা ইচ্ছে হও’। মানে, পেলে, ক্রুয়েফ, ম্যারাডোনা! প্লাতিনির মাহাত্ম এখানেই সবচেয়ে বেশি। জিদানের মতো ফুটবলারকে শৈশবে স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি!

মিশেল ফ্র্যাঙ্কো প্লাতিনি

জন্ম : ২১ জুন, ১৯৫৫

জন্মস্থান : জয়া, ফ্রান্স

উচ্চতা : ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি

পজিশন : অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার

ক্লাব ক্যারিয়ার (সিনিয়র)

সাল ক্লাব ম্যাচ গোল

১৯৭২-৭৯ ন্যান্সি ১৮১ ৯৮

১৯৭৯-৮২ সেন্ট এটিনি ১০৪ ৫৮

১৯৮২-৮৭ জুভেন্টাস ১৪৭ ৬৮

মোট ৪৩২ ২২৪

জাতীয় দল

সাল দেশ ম্যাচ গোল

১৯৭৬-৮৭ ফ্রান্স ৭২ ৪১

১৯৮৮ (প্রদর্শনী ম্যাচ) কুয়েত ১ ০

অর্জন

সেন্ট এটিনি

লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ : ১৯৮১

জুভেন্তাসের পরিসংখ্যান

ইতালিয়ান লিগ : ১৯৮৪, ১৯৮৬

ইউরোপিয়ান সুপার কাপ : ১৯৮৪

ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ : ১৯৮৪

ইউরোপিয়ান কাপ : ১৯৮৫

ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ : ১৯৮৫

ইটালিয়ান কাপ : ১৯৮৩

জাতীয় দলে ক্যারিয়ার

ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ১৯৮৪

বিশ্বকাপ (তৃতীয়) ১৯৮৬

অন্তর্ভুক্তি : ফিফা ড্রিম টিম, ফিফা সর্বকালের সেরা একাদশ,

ওয়ার্ল্ড সকার শতাব্দীর সেরা একাদশ।

(দ্য রিপোর্ট/এফজে/এএস/সিজি/আরকে/জুলাই ২, ২০১৪)