হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির রোগীদের রমজান
ডা. আবুল হাসান মুহম্মদ বাশার : অসুস্থ মুসলমান ভাইবোনেরা রমজান আসলেই এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করেন। রোজার কারণে রোগের অবনতি হবে কিনা বা বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে কিনা- এ সব দুর্ভাবনা তাদের ভেতরে কাজ করে। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম রোজা তারা সারা জীবন বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে পালন করে এসেছেন। এখন রোগের কারণে পারছেন না বা করতে ভয় পাচ্ছেন- তাদের মানসিক অবস্থাটা বুঝা কঠিন নয়। সে জন্য প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন দীর্ঘ সময়ের উপবাস যাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে চিকিৎসক মনে করছেন তাদের জন্য রোজা বাধ্যতামূলক নয়। হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির রোগীদের জন্যও এ কথা প্রযোজ্য। তবে একই সঙ্গে আরও জানিয়ে রাখা যায়, এ ধরনের অধিকাংশ রোগী ওষুধপত্র ও খাদ্যাভ্যাসে সামান্য পরিবর্তন এনে অশেষ বরকতময় সিয়াম সাধনা করতে পারেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনাচরণ বদলে যাচ্ছে। মানুষ দিন দিন অধিকতর বিজ্ঞানমনস্কই শুধু নয়, রীতিমত বিজ্ঞাননির্ভর হয়ে উঠছে। মানুষের ভেতরে জানার আগ্রহ আবহমানকাল থেকেই ছিল, এখন তা যেকোনো সময়ের চাইতে বেশি। জীবনাচরণের বৈজ্ঞানিক দিক খুঁজে দেখা বোধহয় এ অনুসন্ধিৎসারই বহির্প্রকাশ। এখন ইসলামের অন্যতম ধর্মীয় বিধান রোজাকেও বিজ্ঞানের নিক্তিতে মাপা হচ্ছে। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি এর প্রয়োজন দেখি না। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। সামগ্রিকতার বিচারে এর সমস্ত আদেশ নিষেধ কেবলমাত্র মানবসমাজের কল্যাণের জন্যই- একজন মুসলমান হিসেবে এ বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। বিজ্ঞানের সঙ্গে তার ঐক্য বা বিরোধ কোনোভাবেই মুখ্য হওয়া উচিত নয়। তবে বিজ্ঞানমনস্কতার যুগে কেউ যদি রোজার মত গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচরণের ভালোমন্দ বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করে নিতে চান তাকে বোধহয় দোষও দেওয়া যায় না।
সাধারণভাবে এ কথা বলা যায়, হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির যে সব রোগ স্থিতিশীল অবস্থায় আছে তাদের ওপর রোজার ক্ষতিকর কোনো প্রভাব নেই। এমনকি হার্ট ফেইলিওরের অধিকাংশ রোগীও এর অন্তর্ভুক্ত। হার্ট ফেইলিওরের তীব্রতা নির্ধারণের জন্য নিউইয়র্ক হার্ট অ্যাসোসিয়েশন কতৃক প্রণীত যে চারটি ধাপ বা পর্যায় রয়েছে- তার প্রথম তিন ধাপের রোগীদের ওপর রোজার ক্ষতিকর কোনো প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে মারাত্মক হার্ট ফেইলিওরের রোগীদের (চতুর্থ পর্যায়) ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য নয়। হার্ট ফেইলিওরের রোগীদের ক্ষেত্রে রোগের অবনতির কারণে যেকোনো সময় হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে। তবে দেখা গেছে, এ ব্যাপারে রোজা রাখা ও না রাখার মধ্যে পরিসংখ্যানগত কোনো পার্থক্য নেই। বিজ্ঞান সাময়িকীর ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব কার্ডিওলজি’র ২০০৪ সালের আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে এ তথ্য জানানো হয়ে। নতুন করে হার্ট অ্যটাক বা ওই জাতীয় দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও রোজা রাখা ও না রাখার মধ্যে পরিসংখ্যানগত কোনো তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে বাড়তি কোলেস্টেরল ও শারীরিক স্থুলতায় ভুগছেন মধ্যবয়সী এমন রোগীদের ওপর রোজার প্রভাব নিয়ে এক গবেষণা ‘জার্নাল অব ক্লিনিকাল ডায়াগনসিস অ্যান্ড রিসার্চ’ সাময়িকীতে ২০১৪ সালের মার্চে প্রকাশিত হয়। এতে দেখানো হয়েছে, সিয়াম সাধনায় রক্তচাপ ও শরীরের ওজন কমেছে। এ রকম আরও অনেক গবেষণায় হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির রোগের ঝুঁকিতে আছেন- এমন রোগীদের ওপর রোজার উপকারিতা দেখানো হয়েছে। ১০ বছরের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় রোজায় রক্তচাপ, ক্ষতিকর কোলেস্টেরল (এলডিএল) ও বাড়তি ওজন হ্রাস এবং উপকারী কোলেস্টেরল (এইচডিএল) বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া গেছে। গবেষণাটি ‘নিউট্রিশনাল জার্নাল’ নামক বিজ্ঞান সাময়িকীর ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
মস্তিষ্কের রোগ স্ট্রোকের ওপর রোজার প্রভাবের বিষয়টিও বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। ‘সিঙ্গাপুর মেডিকেল জার্নাল’র ২০০৬ সালের মে সংখ্যায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক গবেষণায় দেখানো হয়, রমজান মাসে স্ট্রোকের কারণে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা বছরের অন্য মাসগুলোর তুলনায় বেশি নয়। হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির রোগের ঝুঁকিতে আছেন এমন রোগীদের ওপর পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, রোজা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। রোজা রাখার কারণে স্ট্রোকের সঙ্গে সম্পর্কিত রক্তের দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কমে যায়- হাই সেনসিটিভিটি সি রিঅ্যাকটিভ প্রোটিন ও প্লাজমিনোজেন অ্যাকটিভেটর ইনহিবিটর-১। ফলে স্ট্রোকের ঝুঁকিও কমে। গবেষণাটি ‘দ্য ইন্টারনেট জার্নাল অব কার্ডিওভাস্কুলার রিসার্চ’-এ ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়।
হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির একজন রোগী ওপরে উল্লিখিত তথ্য-উপাত্ত থেকে কি বার্তা নিতে পারেন?
বার্তাটি হতে পারে এ রকম- খুব অসুস্থ রোগীদের কথা বাদ দিলে হৃদরোগীদের অধিকাংশের পক্ষেই রোজা রাখা সম্ভব। তবে মনে রাখতে হবে প্রত্যেক রোগীই আলাদা। একজন রোগীর উচিত রোগের অবস্থা সম্পর্কে নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রোগীর ধর্মীয় অনুভুতিকেও যথাযথ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে সক্ষম। তাই রোজা রাখা বা না রাখার ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া উত্তম।
রোজা রাখছেন এমন হৃদরোগীদের জন্য ওষুধের সময় এবং মাত্রায় কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে। এটিও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক করা উচিত। হৃদরোগের অধিকাংশ ওষুধ দিনে একবার বা দুইবার খেতে হয়। ইফতার ও সাহরির সঙ্গে ওষুধ সেবনের সময় মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে নাইট্রেট জাতীয় ওষুধের কথা বলা যায়। সাধারণত এ ওষুধ দিনে দুইবার খেতে হয়- এমনভাবে যেন মাঝখানে একটা লম্বা সময় ‘নাইট্রেটমুক্ত’ হিসেবে পাওয়া যায়। সেই বিবেচনা থেকে ইফতার এবং সাহরিতে নাইট্রেট খেলেও দিনের একটা লম্বা সময় শরীর নাইট্রেট-মুক্ত থাকবে। রক্ত পাতলা রাখার জন্য অ্যাসপিরিন জাতীয় যে ওষুধ সাধারণত দুপুরে ভরা পেটে দেওয়া হয়ে থাকে, সেটা ইফতারের পর বা সাহরির পর খেতে অসুবিধা নেই। আবার বুকে ব্যথা হলে প্রয়োজনে জিহ্বার নিচে নাইট্রেট ট্যাবলেট বা স্প্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে রোজার ক্ষতি হয় না। বলা বাহুল্য, ওষুধপত্রের এ সব পরিবর্তনের সঙ্গে খাবারের নিয়মগুলোও আগের মতোই মেনে চলতে হবে, যেমন- বাড়তি লবণ, লাল মাংস ও অতিরিক্ত তেল বা মশলাযুক্ত খাবার পরিহার এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি, শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া।
হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির রোগীদের একটা বড় অংশ ডায়াবেটিসে ভুগে থাকেন। রমজানে ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণও অত্যন্ত জরুরি। এ ব্যাপারে রমজান শুরুর আগেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শক্রমে ওষুধের সময় ও মাত্রা ঠিক করে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সব ধরনের ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য রোজা রাখা নিরাপদ নাও হতে পারে।