রোজা পালনে অভ্যস্তরা রোগাক্রান্ত হন কম
এ.কে.এম মহিউদ্দীন, দ্য রিপোর্ট : পবিত্র রমজানের পঞ্চম দিন শুক্রবার। হাদিসে উল্লেখ আছে রোজা মানুষের জন্য ঢালস্বরূপ। পৃথিবীর অনেক ধর্মে উপবাস বা রোজা রাখার বিধান রয়েছে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মুসলমানদের রোজার পার্থক্য হলো এই যে, মুসলমানরা রোজা থাকার জন্য সেহরি গ্রহণ করে, অপরপক্ষে অন্যান্য আহলে কিতাবধারীরা সেহরি গ্রহণ করে না। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, সেহরিতে পর্যাপ্ত বরকত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও সেহরি কল্যাণকর। রোজাদারগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইফতারি ও সেহরি তাৎপর্যপূর্ণ ও ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে।
পবিত্র রমজান মাসে পেপটিক আলসার বা গ্যাস্ট্রিক আলসার হতে পারে এ আশঙ্কায় কেউ কেউ রোজা রাখেন না।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, দেহের বেশিরভাগ রোগের সৃষ্টি হয় প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের ফলে। এমনকি আমাদের গৃহীত খাদ্যদ্রব্যের ২৫ শতাংশ বা ততোধিক অংশ অপ্রয়োজনীয়। আমাদের জন্য এ বাড়তি খাদ্যদ্রব্যাদি স্বাস্থ্য রক্ষায় বিপদের কারণ হয়ে থাকে। অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, সর্বক্ষণ আহার, সীমাতিরিক্ত ভোজন ও দূষিত খাদ্য খাওয়ার কারণে শরীরে এক প্রকার বিষাক্ত উপকরণ ও উপাদানের সৃষ্টি হয় এবং জৈব বিষ জমা হয়। যে কারণে দেহের নির্বাহী ও কর্মসম্পাদক অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো বিষাক্ত উপকরণ ও জৈব বিষ দমনে সক্ষম হয় না। ফলে জটিল ও কঠিন রোগের জন্ম হয়। দেহের মধ্যেকার এহেন বিষাক্ত ও দূষিত উপাদানগুলো অতি দ্রুত নির্মলকরণের নিমিত্তে পরিপাক যন্ত্রকে মাঝে মধ্যে খালি করা একান্ত প্রয়োজন। কিছুদিন সিয়াম সাধনার মাধ্যমে পাকস্থলীকে খালি রাখার কারণে দেহের অপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সারাংশ ও সঞ্চিত বিষাক্ত রস নিঃশেষ হয়ে যায়। সুতরাং ওই বিষাক্ত রস শরীরের ভেতর কোনো ক্ষতিসাধনে সক্ষম হয় না। রোজার সময় উপবাস থাকাকালীন পেটের মধ্যে কোনো খাদ্য সাময়িকভাবে মজুদ না থাকার ফলে শরীরের পরিপাক যন্ত্রের সাহায্যে বিষাক্ত রোগ জীবাণু বা রস জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিঃশেষ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা ছাড়া খাদ্যদ্রব্য হজম ও খাদ্যপ্রাণ তৈরি করে বিভিন্ন স্থানে পাঠানোর ব্যাপারে দেহের শক্তি প্রচুর পরিমাণে ব্যয় হয়। আর ওই জমাকৃত শক্তি দেহের অভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্ন সমতা, উন্নয়ন ও নবায়নের কাজে বিরাট সুযোগ পায়। এভাবে দেহের বাড়তি ওজন, রস, চর্বি ইত্যাদি হ্রাস পেয়ে চলাফেরা, কাজকর্মে গতি বৃদ্ধি পেতে পারে।
বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. গোলাম মোয়াজ্জেম তার গ্রন্থে লিখেছেন, রোজা দ্বারা শরীরের মেদ কমাতে রোজা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের খাদ্যনিয়ন্ত্রণ অপেক্ষা অধিক কার্যকর।
পাকিস্তানের প্রখ্যাত প্রবীণ চিকিৎসক ডা. মুহাম্মদ হোসেন বলেন, যারা নিয়মিত রোজা পালনে অভ্যস্ত সাধারণত তারা বাতরোগ, বহুমূত্র, অজীর্ন, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত কম হন।
পাশ্চাত্যের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. কাইভ বলেন, সিয়াম সাধনার বিধান স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞানসম্মত। সেহেতু ভারত, জাপান, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ নাইজেরিয়াতে অন্যসব এলাকার তুলনায় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় রোগ-ব্যাধি অনেক কম দেখা যায়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের পথিকৃৎ হিসেবে খ্যাত ডা. হিপেপাক্রেটিস অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন যে রোগাক্রান্ত দেহকে যতই পুষ্ট করার চেষ্টা করা হোক, তাতে স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকবে।
চিন্তাবিদ ডক্টর ডিউই উপবাস থাকা প্রসঙ্গে বলছেন, ‘রোগজীর্ণ এবং রোগক্লিষ্ট মানুষটির পাকস্থলি থেকে খাদ্যদ্রব্য সরিয়ে ফেল, দেখবে রুগ্ন মানুষটি উপবাস থাকছে না, সত্যিকাররূপে উপবাস থাকছে রোগটি।'
রাশিয়ার অধ্যাপক ডি এন নাকিটন বলেছেন, ‘তিনটি নিয়ম পালন করলে শরীরের বিষাক্ত দ্রব্যাদি বের হয়ে যাবে এবং বার্ধক্য থামিয়ে দেবে।' তার বর্ণিত নিয়ম তিনটি হলো অধিক পরিশ্রম, অধিক ব্যায়াম এবং মাসে কমপক্ষে একদিন উপবাস।
প্রখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ইবনে সিনা তার রোগীদের কখনো কখনো তিন সপ্তাহ ধরে উপবাস থাকতে নির্দেশ দিতেন।
ডা. অ্যালেক্স হেইগ বলেন, ' রোজা হতে মানুষের মানসিক শক্তি এবং বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়।’
রোজা রাখার কারণে মানবদেহে পরিপাক ক্রিয়া ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কারণ রোজা পালনকালে মানবদেহে স্ট্রেস হরমোন করটিসোলের নিঃসরণ হ্রাস পায়। অপরদিকে রোজা রাখার কারণে কর্মউদ্দীপনা ও মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধি পায়। এর অন্যতম কারণ হলো রোজা রাখলে মস্তিষ্কের মেরিবেলাম ও লিমরিক সিস্টেমের ওপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়। রোজা এদিক থেকে সুস্থ দেহ ও মনের জন্য সহায়ক। এ কারণে একজন খ্যাতনামা চিকিৎসা বিজ্ঞানী বলছেন, রোজা সুস্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক হলেও শুধু রোজা রাখলে যে স্বাস্থ্য সুস্থ থাকবে তা নয়। রোজায় স্বাস্থ্যকে নীরোগ রাখতে হলে ইফতার, রাতের খাবার ও সেহরি স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে। রোজা পালন শেষে ভাজা জাতীয় খাদ্য অত্যধিক গ্রহণের প্রবণতা কখনো পেটে প্রদাহ বা গ্যাস্ট্রাইটিস সৃষ্টি করতে পারে। এ জন্য ইফতারি বা সেহরি খাদ্য সহজপাচ্য হওয়া আবশ্যক।
এ ব্যাপারে মহনবী (সা.) এর বাণী স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি খিদে লাগলে খেতে বলেছেন এবং খিদে থাকতেই খাওয়া বন্ধ করার জন্য উপদেশ দিয়েছেন, যা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানসম্মত।
খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে এই নীতিমালা অনুযায়ী পেটের তিন ভাগের অন্তত একভাগ অংশ খালি রেখে খাদ্য গ্রহণ করলে অনেক সময় স্বাস্থগত দিক থেকে নিরাপদ থাকা যায়।
(দ্য রিপোর্ট/একেএমএম/এইচএসএম/জুলাই ০৪, ২০১৪)