চট্টগ্রামে বেড়েছে গুপ্তহত্যা
চট্টগ্রাম অফিস : নগরীতে খুন, অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যা বেড়ে গেছে। এতে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে নগরবাসী। সম্প্রতি বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী অপহরণ, খুন ও নিপীড়নের ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মধ্যেও চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
অপরদিকে নগরীতে মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য চরমভাবে বেড়ে যাওয়ায় যুব সমাজ যেমন অধপতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তেমনি মাদকের অর্থ যোগানের জন্য খুন, অপহরণ, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরধামূলক ঘটনা ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
সিএমপির সূত্র মতে, নগরীতে গত সাড়ে তিন বছরে খুন হয়েছে ৩০৭ জন। একই সময়ে ১০৬ জন অপহরণের অভিযোগে থানায় মামলা হয়েছে। চলতি বছরের গত পাঁচ মাসে খুন হয়েছেন ৫৯ জন।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) আওতাধীন নগরীর ১৬টি থানাতেই কমবেশি খুন, অপহরণ, গুম, গুপ্তহত্যা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
সিএমপি সূত্রে জানা গেছে, শুধু গত মে মাসেই নগরীর বিভিন্ন অপরাধে থানায় ৪৪৭টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে খুনের মামলা ১০টি, অপহরণের মামলা ২টি, নারী নির্যাতনের মামলা ৩৯টি।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশন) বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। অপহরণের সঙ্গে জড়িত অনেককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আর যেসব অজ্ঞাতপরিচয় মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো অন্যস্থানে হত্যা করে এখানে এনে ফেলে রাখা হচ্ছে।’
চলতি বছরের গত পাঁচ মাসে অজ্ঞাতপরিচয় মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে ১৪১টি। একই সময়ে ২৬ ব্যক্তি অপহরণের শিকার হয়েছেন। অপহৃত অধিকাংশ ব্যক্তির এখনও খোঁজ পাননি স্বজনরা। তবে এ হিসেব সিএমপির তালিকা অনুযায়ী মে মাস পর্যন্ত। গত জুন মাসেও নগরীতে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটে। এমনকি জুলাই মাসের প্রথম দিন রাতেও নগরীর মাদরবাড়ি এলাকার শুভপুর বাস স্টেশনের কাছে এক কিশোরী খুনের ঘটনা ঘটে।
সিএমপির হিসাব অনুযায়ী, সাড়ে তিন বছরে নগরীর থানাগুলোতে বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৪ হাজার ৫৯৭টি। নগরীতে একের পর এক খুন-গুমের ঘটনা ঘটলেও পুলিশ কিছুই করতে পারছে না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউআইটিএসের ছাত্র কায়সারুল ইসলাম নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদী থেকে উদ্ধার করে সদরঘাট থানা পুলিশ। কিন্তু এখন পর্যন্ত কায়সারের মৃত্যু রহস্য উদঘাটন করা যায়নি। গত ১০ জুন দুপুরে পাহাড়তলী থানার সমুদ্র উপকূলীয় ঝাউতলা এলাকা থেকে সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ীর মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার করেন। কি কারণে ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়েছে তারও রহস্য বের করতে পারেনি পুলিশ। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে খোঁজ মিলছে না নগরীর চকবাজার এলাকার সোনা ব্যবসায়ী দুলাল ধরের।
গত এক সপ্তাহে নগরীতে কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটে। মাদারবাড়ি এলাকায় ভাঙ্গারী মনিরকে খুন করে তার দেহ টুকরা টুকরা করা হয়। পাহাড়তলীর মৌসুমী আবাসিক এলাকায় এক মহিলাকে খুন করে প্লাস্টিকের ড্রামে ফেলে রাখা হয়। গত মঙ্গলবারও নগরীর মাদারবাড়িস্থ শুভপুর বাসস্টেশন থেকে বস্তাবন্দি এক কিশোরীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
সিএমপি সূত্র জানায়, নগরীতে গত সাড়ে তিন বছরে খুন হয়েছে ৩২০ জন, নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৮২৭ জন, অপহরণের শিকার হয়েছেন ১০৬ জন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৬৬ জন নারী ও শিশু। ওই সময়ে নগরীর থানাগুলোতে অন্যান্য অভিযোগসহ মামলা দায়ের হয়েছে ১৪ হাজার ৫৯৭টি।
এ ছাড়া চলতি বছরের গত ৫ মাসে খুন হয়েছে অন্তত ৪৯ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১৫, ফেব্রুয়ারিতে ৬, মার্চে ৬, এপ্রিলে ১২ ও মে মাসে ১০ জন। ওই পাঁচ মাসে অপহরণের ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে ৩১টি। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১৩২টি। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৮ নারী শিশু। পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সী লোকজন নিখোঁজের ঘটনায় নগরীর থানাগুলোতে প্রতিমাসে ২০ থেকে ২৫টি করে হারানো ডায়েরি করা হচ্ছে। নিখোঁজ ও অপহরণের শিকার অধিকাংশের বছরের পর বছর ধরে সন্ধান মিলছে না।
অন্যদিকে, আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম নগরীতে পাঁচ মাসে অজ্ঞাতপরিচয় মৃতদেহ দাফন করেছে ১৪১টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২৫টি, ফেব্রুয়ারিতে ২৯টি, মার্চে ২৮টি, এপ্রিলে ২০টি ও মে পর্যন্ত ২০টি। নগরীতে প্রতি সপ্তাহে একটি কিংবা দুটি করে ঘটছে অপহরণ, খুন ও গুপ্তহত্যার ঘটনা।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি কোতোয়ালি থানাধীন ফিরিঙ্গি বাজার এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবককে। গত ২৫ মার্চ আগ্রাবাদ এলাকায় বাসায় ঢুকে খুন করা হয় মা রিজিয়া খাতুন ও মেয়ে নাজনীন নিশাতকে। আলোচিত এ খুনের ঘটনায় পুলিশ দুইজনকে গ্রেফতার করলেও আর কারা জড়িত রয়েছে এ ব্যাপারে পুলিশ কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। গত ৬ মার্চ পাহাড়তলী কৈবল্যধামের নিজবাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় রাজীব শীল ও তার স্ত্রী সঙ্গীতা শীলের মৃতদেহ। রাজীব চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালিত একটি স্কুলের শিক্ষক ও সঙ্গীতা খাগড়াছড়ির খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। পরিবারের দাবি ওই দম্পতিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ১৬ মার্চ নগরীর ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকার একটি নির্মাণাধীন ভবনের সেপটিক ট্যাংক থেকে দুই বন্ধু এমইএস কলেজছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই হত্যাকাণ্ডেরও কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।
সিএমপির হিসাব অনুযায়ী গত মে মাসে নগরীর বিভিন্ন থানায় মোট ৪৪৭টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০৩টি মাদক আইনে মামলা ও অন্যান্য অপরাধে ১৪৪টি মামলা দায়ের করা হয়। তবে উদ্বেগজনক হলো- মে মাসে ১০টি খুনের মামলা, ২টি অপহরণের মামলা, ৩৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা, ১টি ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংগঠক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সরকারের বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা যদি ভাড়ায় গুম-খুনে জড়িয়ে পড়ে তাহলে গুম-খুন কখনও বন্ধ হবে না। বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা যাতে এসব অপরাধে সম্পৃক্ত হতে না পারে সে জন্য বাহিনীতে সংস্কার আনা জরুরি। আর সরকার যদি সংস্কারে আগ্রহী না হয় তাহলে বিশেষ ফোর্সের (র্যাব) সংঘটিত দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। সংস্কারের জন্য সরকার চাইলে বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত দক্ষ কিছু ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করতে পারে। কমিশন থেকে যে সব সুপারিশ আসবে সরকার চাইলে তা আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল ফারুক বলেন, ‘গুম-হত্যা জঘন্য অপরাধ। সঠিক তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছতার মাধ্যমে গুম-হত্যা দূর করা সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে পুলিশকে আরও সক্রিয় হতে হবে। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন এবং বিচার হলে এ ধরনের অপরাধ অবশ্যই কমে আসত।’
চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ বলেন, ‘রাজনীতিতে প্রতিহিংসা বেড়ে যাওয়ায় খুন-গুমের মতো ঘটনা বেড়ে গেছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে এসব অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার খবরও আমরা শুনছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব সদস্য শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আর যে সব অপরাধ ভাড়াটে সন্ত্রাসী করে থাকে সে সব খুন-গুম বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে।’
এ ব্যাপারে সিএমপির সদর সহকারী কমিশনার মাহমুদা বেগম বলেন, ‘পুলিশ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ লক্ষ্যে গত সোমবার নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোকে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাসহ প্রযুক্তি নির্ভর আরও দুটি প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অপরাধীদের পৃথকভাবে চেহারা শনাক্ত, চুরিসহ যে কোনো অপরাধীকে দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হবে। আশা করি এর মাধ্যমে নগরীতে অপরাধ কমে আসবে।’
(দ্য রিপোর্ট/কেএইচএস/এমসি/এইচ/জুলাই ০৪, ২০১৪)