ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনাল?
বিশ্বকাপ ফুটবল উস্কিয়ে দেয় আমাদের কল্পনাশক্তিকেও। এই মহোৎসবকে নিয়ে আমরা কত কিছু কল্পনা করি। বুকের মধ্যে আল্পনা আঁকি। এই কল্পনা আর আল্পনা দিয়ে কত হিসেব-নিকেশ, কত আঁকাবুকি করি। সবটাই সত্য হয়ে যায় না। আবার সবটাই মিথ্যে হয় না। কিছু মেলে। কিছু মেলে না। এবারের বিশ্বকাপ নিয়েও তেমনটি হচ্ছে। অনেকেই কল্পনা করছেন এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল খেলবে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা।
অতীতে কখনও মুখোমুখি হয়নি ফুটবলের প্রবল প্রতিপক্ষ এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু কিছু সমীকরণ যদি মিলে যায়, এবারের তেমন একটা উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। সেটা যদি হয়, তাহলে উল্লসিত হবেন ফুটবল অনুরাগীরা। ফুটবল দুনিয়ার সমর্থকগোষ্ঠী মূলত এই দু’টি দেশকে কেন্দ্র করে বিভক্ত। এই দুই দেশের যত সমর্থক ও অনুরাগী আছে, আর কোনো দেশের সেটা নেই। তৃতীয় বিশ্বে এই দুই দেশের একচেটিয়া জনপ্রিয়তা। আমাদের দেশে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বায়ন হলেও এখনও ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনাকে ছাড়িয়ে যাওয়া দূরে থাকুক, তাদের কাছাকাছিও যেতে পারেনি কোনো দেশ।
লাতিন আমেরিকার এই দুই দেশকে সমর্থন দেওয়াকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে কত কিছুই না ঘটে। এমনকি মনোমালিন্য, তা থেকে তীব্র রেষারেষি পর্যন্ত হচ্ছে। অবশ্য রেষারেষিটা ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার মধ্যেও কম নেই।
ফুটবলের দুই পরাশক্তি ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার মধ্যে রেষারেষির ইতিহাস অনেক পুরনো। দু’দেশের খেলাকে কেন্দ্র করে অনেক ঘটনাই ঘটেছে। কোনোটা আলোচিত। কোনোটা বিতর্কিত। প্রতিবেশী এই দুই দেশের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে অভিহিত করা হয় ‘ব্যাটল অব দ্য সাউথ আমেরিকানস’।
অবশ্য উভয় দেশে ফুটবল খেলা জনপ্রিয় হওয়ার অনেক আগে থেকেই সূত্রপাত ঘটে বৈরিতার। সেটা মূলত রাজনৈতিক কারণে। এই বিরোধ সংক্রামিত হয় খেলার মাঠে। বিশেষ করে ফুটবল মাঠে এর ঝাঁজ অনেক বেশি টের পাওয়া যায়। ফুটবলের কোনো প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জনের চেয়ে বড় হয়ে উঠে এই দুই দেশের মধ্যকার ম্যাচে জয়-পরাজয়। একে অপরকে হারাতে পারলেই সেটাই তাদের কাছে বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৪৬ সালে বুয়েনস আয়ার্সের একটি ঘটনায় এই দুই দেশ একে অপরের সঙ্গে ১০ বছর খেলেনি। সেবারের দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপে দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে রীতিমতো মল্লযুদ্ধ হয়। তাতে জড়িয়ে পড়েন পুলিশ ও দর্শকরাও।
১৯১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ফুটবল মাঠে প্রথম মুখোমুখি হয় ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা। এরপর উভয় জাতীয় দল খেলেছে ৯৫টি ম্যাচ। আর্জেন্টিনা ৩৬ এবং ব্রাজিল ৩৫ ম্যাচে জয়ী হয়। অমীমাংসিত থাকে ২৪টি ম্যাচ। বিশ্বকাপ বাদ দিলে সাফল্যের দিক দিয়ে এগিয়ে আর্জেন্টিনা। দুইবার অলিম্পিক স্বর্ণ পেলেও একবারও পায়নি ব্রাজিল। কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা ১৪ এবং ব্রাজিল ৮ বার শিরোপা জয় করে। তবে কনফেডারেশন কাপে ব্রাজিল ৪ এবং আর্জেন্টিনা ১ বার বিজয়ী হয়। অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ৬ এবং ব্রাজিল ৫ বার শিরোপা জয় করে। অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে ব্রাজিল ৩ বার চ্যাম্পিয়ন হলেও একবারও জিততে পারেনি আর্জেন্টিনা। এ ছাড়া ব্রাজিলকে বিশ্বকাপের দল বললে অত্যুক্তি হবে না। আর্জেন্টিনা যেখানে দুইবার শিরোপা জয় করে, সেখানে সর্বাধিক পাঁচবার জিতেছে ব্রাজিল। বিশ্বকাপে এই দুই দেশের লড়াইয়েও এগিয়ে আছে ব্রাজিল। বাছাইপর্বের ৬ বারের মধ্যে ব্রাজিল ৩ এবং আর্জেন্টিনা ২ বার জয়ী হয়। একটি ম্যাচ ড্র হয়। এ ছাড়া ৪ বার চূড়ান্তপর্বে দেখা হয় দুই দেশের। ব্রাজিল ২ এবং আর্জেন্টিনা ১ বার জয়ী হয়। ড্র হয় একবার।
১৯৭৪ সালে পশ্চিম জার্মানিতে দ্বিতীয় রাউন্ডে প্রথমবারের মুখোমুখিতে দুই তারকা ফুটবলার রিভেলিনো ও জইরজিনহোর গোলে আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারায় ব্রাজিল। একটি গোল পরিশোধ করেন মিগুয়েল ব্রিনদিসি। ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনায় দ্বিতীয় রাউন্ডে দু’দেশের ম্যাচটি গোলশূন্য ড্র হলেও এটি ‘দ্য ব্যাটল অব রোজারিও’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে আছে। এ বিশ্বকাপে পাতানো ম্যাচ খেলে ব্রাজিলকে টপকে গোল এভারেজে আর্জেন্টিনার ফাইনালে খেলার অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১৯৮২ সালে স্পেনে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওয়ান টাচ পাসিং ফুটবল খেলে আর্জেন্টিনাকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দেয় ব্রাজিল। জিকো, সার্জিনহো ও জুনিয়র গোল করার পর একটি গোল পরিশোধ করেন দিয়াজ। এ ম্যাচে হতাশ হয়ে খেলার শেষ মুহূর্তে ডিয়েগো ম্যারাডোনা ব্রাজিলের বাতিস্তাকে লাথি মেরে লাল কার্ড দেখেন। ১৯৯০ সালে ইতালিতে অনুষ্ঠিত ম্যাচটি ‘দ্য হলি ওয়াটার স্ক্যান্ডাল’ হিসেবে পরিচিত। ‘রাউন্ড অব সিক্সটিন’-এ ম্যারাডোনার পাস থেকে খেলার ৮০ মিনিটে একমাত্র গোলটি করেন ক্লদিও ক্যানেজিয়া। খেলা শেষে ব্রাজিলের ডিফেন্ডার ব্রাংকো অভিযোগ করেন, আর্জেন্টিনার ট্রেনিং স্টাফ তাকে ঘুমের ওষুধ মিশানো এক বোতল পানি দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে আর্জেন্টিনার এক টেলিভিশন শোতে ম্যারাডোনা এ ঘটনা প্রকাশ করে দেন।
এরপর অবশ্য এই দুই দেশ আর বিশ্বকাপের চূড়ান্তপর্বে পরস্পরের মুখোমুখি হয়নি। উভয় দেশের খেলাকে কেন্দ্র করে যেমন উত্তাপের সঞ্চার হয়, তেমনিভাবে দুই দেশের দুই কিংবদন্তি ফুটবলার ব্রাজিলের পেলে আর আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনাকে নিয়ে জমে উঠে তর্ক-বিতর্ক। কে সর্বকালের সেরা ফুটবলার, এ নিয়ে চলে অন্তহীন কচকচানি। সর্বকালের সেরা দুই ফুটবলারের মধ্যেও চলে বাক-বিতণ্ডা। তবে এক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন ম্যারাডোনা। সুযোগ পেলেই তিনি পেলেকে খোঁচা মারতে ছাড়েন না। এ সব কারণে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনাকে নিয়ে আলোচনা আর সমালোচনায় সরগরম থাকেন ফুটবল সমর্থকরা।
এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনায় উদ্বেলিত ফুটবল দুনিয়া। একদিকে আছেন লিওনেল মেসি এবং অন্যদিকে নেইমার। দু’জনই নিজ নিজ দলের প্রধান অবলম্বন। ইতোমধ্যে দেখা গেছে, এ দু’জনকে ছাড়া এই দুই দলের গত্যন্তর নেই। এই দুই ফুটবলার একসঙ্গে লা লিগায় খেলেন বার্সেলোনায়। দু’জনের মধ্যে বিরোধও নেই। কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবলে এবারই তাঁরা প্রথম মুখোমুখি হতে পারেন একে অপরের। আলোচিত এই দুই ফুটবলারের লড়াই দেখার অপেক্ষায় ফুটবল অনুরাগীরা। সেক্ষেত্রে দু’জনকে পাড়ি দিতে হবে কোয়ার্টার-ফাইনাল আর সেমি-ফাইনালের কঠিন পথ। এই পথ অতিক্রম করতে পারলেই ফুটবল দুনিয়া ৬৪ বছর পর দেখতে পাবে অল-লাতিন ফাইনাল। (অবশ্য কলম্বিয়া এবং কোস্টারিকারও সেই সুযোগ আছ।) আর বিশ্বকাপ ফুটবলের ৮৪ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার দেখতে পাওয়া যাবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফাইনাল। ফুটবল অনুরাগীদের এই কল্পনা কি সত্যি হবে?
(দ্য রিপোর্ট/ডিএম/এএস/সিজি/সা/জুলাই ০৪, ২০১৪)
dulalmahmud@yahoo.com