‘কর নয়তো মর’
এই ব্রাজিলিয়ানদের ভেতরে থাকে সবসময় প্রাণপ্রাচুর্য। আছে জীবনকে উপভোগ করবার একটা সাবলীল সংস্কৃতি। খাওয়া দাওয়া, গান বাজনা, হৈ-হুল্লোড়, খেলাধুলা সবকিছুর যেন মানে একটাই জীবনকে উপভোগ কর। এবারের বিশ্বকাপেও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা এক ব্রাজিলকেই বিশ্ববাসী দেখছে।
আয়তন ও জনসংখ্যার বিচারে ব্রাজিল পৃথিবীর বড় দেশগুলোর একটা, ব্রাজিলকে দ্রুত বর্ধিষ্ণু ও সম্ভাবনাময় এক অর্থনীতি বলা হয়ে থাকে। তবে সে সব নয় ব্রাজিল মানে আসলে ফুটবল। ঊনবিংশ শতকের শেষদিক থেকে শুরু হয়ে ব্রাজিলে ফুটবলের এই সংস্কৃতিটা এখন এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে, দেশটার পরিচিতিই বদলে গেছে। ফুটবল ছাড়া ব্রাজিলকে চেনা যায় না, যেমন লেজ দেখে চেনা যায় বাঘ!
নকআউট পর্বের প্রথম খেলায় ব্রাজিল মুখোমুখি হয়েছিল চিলির। মানসিকভাবে চিলি যেন অনেকখানি এগিয়ে ছিল। ব্রাজিলের খেলায় ছন্দ বলতে কিছু খুঁজে পাওয়া গেল না। তারপরও প্রথম গোল ব্রাজিলই পেল। নেইমারের কর্ণার কিক থেকে ৬ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতার থিয়াগো সিলভা মাথার পেছন দিয়ে হেড করে বল ফেলেছিলেন দ্বিতীয়বারে। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন ডেভিড লুইজ। হুট করেই সেখান থেকে বল ঢুকে গেল জালে। কার দোষে, কার গুণ খুব পরিষ্কার বুঝা গেল না, কিন্তু গোলটাকে ব্রাজিল ডিফেন্ডার ডেভিড লুইজের প্রথম আন্তর্জাতিক গোল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হল। এই গোলের পর ব্রাজিলের খেলা যেন গর্তের ভেতরে ঢুকে যেতে লাগল। ফলে প্রথমার্ধেই গোল শোধ করে ফেলেছিল উজ্জীবিত চিলি। ব্রাজিল রক্ষণভাগ তখন মোটামুটি ফাঁকা। বল পেয়েছিলেন চিলির সবচাইতে বড় তারকা সানচেজ। সানচেজ দ্রুত বক্সে ঢুকে কোণাকুনি মাটি কামড়ানো শটে পরাস্ত করলেন গোলরক্ষক হুলিও সিজারকে। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা হল অতি রক্ষণাত্মক। গোল না হওয়ায় খেলা গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। সেখান থেকে পেনাল্টি শ্যূটআউট। চিলির শেষ শটটা সাইড বারে লেগে ফিরে আসার মাধ্যমেই ব্রাজিলের জয় নিশ্চিত হয়েছে।
ব্রাজিলকে এ দিন জিতিয়েছিলেন দলের অভিজ্ঞ গোলরক্ষক হুলিও সিজার। ৩৫ বছর বয়সী এ দিন সিজার তার ওপর গুরুর আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন।
কোয়ার্টার ফাইনালের ৮ দল এখন প্রস্তুত। কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার প্রতিটি লড়াই নানা নাটকে-চমকে উদ্ভাসিতই ছিল। অধিকাংশ খেলা গড়িয়েছে অতিরিক্ত সময়ে। ব্রাজিলের ম্যাচসহ ২টি ম্যাচ গড়িয়েছে টাইব্রেকারে। বুঝাই যাচ্ছে দলগুলোর ভেতরে মানের পার্থক্য দিন দিন কমে আসছে এটা তারই বহির্প্রকাশ! তবে এটাও ঠিক যে, শেষ পর্যন্ত কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে সেই দলগুলোই, যারা প্রথমপর্বের খেলায় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেদিক দিয়ে বড় দলগুলোর জায়গা অক্ষত রয়েছে এমন মনে করবার সুযোগও থাকছে। একমাত্র ব্যতিক্রম এখনও কোস্টারিকা। কে জানে নিজেদের বড় দল হিসেবে ঘোষণা করতে তারা এই মঞ্চকেই বেছে নিল কিনা!
নকআউট পর্বের দ্বিতীয খেলায় উরুগুয়েকে সহজে হারিয়েছে কলম্বিয়া। চিল্লেনির কাঁধে কামড় বসিয়ে ৯ ম্যাচ নিষিদ্ধ হওয়া সুয়ারেজ ওই দিন ছিলেন না উরুগুয়ে দলে। অন্যদিকে, কলম্বিয়ার তরুণ সেন্সেশন জেমস রদ্রিগেজ ছিলেন অবিশ্বাস্য ফর্মে। দলের পক্ষে ২ গোলের ২ গোলই করেছেন তিনি। প্রথমটাকে অনেকেই এই বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা বলে মানছেন। মাঝমাঠ থেকে উড়ে আসা একটা বল বুক দিয়ে নামিয়ে মাটিতে পড়ার আগেই ভলি করলেন এবং বলটা গোলপোস্টের দুরূহতম কোণ দিয়ে জালে জড়াল। গোলকিপার প্রাণপণে লাফ দিয়েও তার নাগাল পেলেন না। জালে খুঁজতে প্লেসমেন্টটাও এর চাইতে ভাল হতে পারত না। ৫ গোল নিয়ে রদ্রিগেজ এখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা। মেসি, নেইমার নয় ‘রদ্রিগেজের বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে এটি’ আর্জেন্টিনার সাবেক কোচ সিজার লুইস মেনোত্তির ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্যে প্রমাণের দিকে আরও একধাপ এগুলেন কলম্বিয়ার এই নতুন ‘ভালদেরামা’!
আর্জেন্টিনার পক্ষে মেসিজাদু অব্যাহত আছে। টানা চতুর্থ ম্যাচে মেসির এই– ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’তে পার পেয়ে গেল তার দল। এ দিন সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষেও গোলের জন্য একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল মেসিদের। সবাই যখন টাই-ব্রেকারের কথা ভাবছে তখনই মেসি অনবদ্য এক ড্রিবলিংয়ে ৩ জনকে কাটিয়ে বল দিলেন ডান পাশে ডি বক্সের ভেতরে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা ডি মারিয়াকে। কোণাকুনি মাটি কামড়ানো শটে গোলরক্ষককে বোকা বানাতে অসুবিধা হয়নি এ দিন পুরো ম্যাচে অনবদ্য প্রাণবন্ত ডি মারিয়ার। তবে আমরা মেসির এই জাদুকরী মুহূর্তগুলো নিয়ে খুশি থাকলেও মেসির দাদাজান (ম্যারাডেনা), কিন্তু হতাশ হয়ে পড়েছেন মেসির খেলায়। মেসি নাকি যথেষ্ট দৌঁড়ে খেলছেন না, নাতির ব্যাপারে এ রকম অভিযোগ করেছেন ভদ্রলোক। দাদুকে খুশি করার জন্য হলেও মেসিকে এখন থেকে আরও দৌঁড়াতে হবে। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই খুব খারাপ হবে না আর্জেন্টিনার জন্য!
রাউন্ড অব সিক্সটিনে দু-একটা দল দীর্ঘশ্বাসের জন্ম দিয়েছে, তাদের অন্যতম আলজেরিয়া। শক্তিশালী জার্মানিকে পুরো ৯০ মিনিট গোল-বঞ্চিত রেখেছিল তারা। অসাধারণ সব সেভ করে ওই দিন আলজেরিয়ার গোলরক্ষক রইস বারের নিচে প্রায় অতিমানব হয়ে উঠেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত সময়ের ২-০ ব্যবধানে জার্মানি এগিয়ে গেলে খেলা শেষ বলেই মনে হচ্ছিল। আলজেরিয়ানদের আফসোসটা তৈরি হল তখনই, যখন খেলা শেষ হওয়ার ৩০ সেকেন্ড আগে এক গোল শোধ করেছিল। আমেরিকাও বেলজিয়ামকে হারিয়ে দিতে পারত এবং তাও ৯০ মিনিটের ভেতরেই! পারেনি যে, সে দোষ তাদেরই শেষ মুহূর্তে সহজ একটা সুযোগ মিস করার মাশুল গুনতে হল তাদের। অতিরিক্ত সময়ে ২ গোলে এগিয়েছিল বেলজিয়াম। আর আমেরিকার পক্ষে বদলী হিসেবে নেমেই দুর্দান্ত এক গোল পরিশোধ করে চমক সৃষ্টি করেছেন ১৯ বছর বয়সী জুলিয়ান গ্রিন। খেলা তখনও অন্তত মিনিট দশেক বাকি ছিল। দুর্ভাগ্য আমেরিকার মরিয়া হযে খেলেও আর গোলের দেখা পায়নি। জুলিয়ান গ্রিন অবশ্য রেকর্ড বইয়ে ঢুকে গেলেন আন্তর্জাতিক ফুটবলে আমেরিকার পক্ষে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হিসেবে।
‘কর নয়তো মর’ পর্ব থেকে এক এক করে ছিটকে পড়ছে এক একটা দল। বলা বাহুল্য, ঝরে পড়া দলের অধিকাংশই দ্রুত বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে। শুধু কেউ কেউ বেঁচে থাকবে বিশ্বকাপ শেষ হযে যাবার অনেক অনেক দিন পরেও। এই বিশ্বকাপে দল হিসেবে আলজেরিয়াকে মনে রাখবার অনেকগুলো কারণ আছে। মাঠের খেলায় ফেগুলি, রইস, ব্রাহিমি, স্লিমানি, জাবুরা সবার নজর কেড়েছেন। তবে ভেতরের যে তথ্যটা নাড়া দিয়েছে, তা হল এই দলটার ২৩ জনের ১৬ জনেরই জন্ম ও বেড়ে ওঠা ফ্রান্সে। ফেগুলির মত দু’একজন ফ্রান্স জাতীয় দলে ডাকও পেয়েছিলেন। জিনেদিন জিদান, করিম বেনজেমাদের মতো এদেরও অনেকের সুযোগ ছিল ফ্রান্সের প্রতিনিধিত্ব করবার। কিন্তু তারা তাদের পূর্বপুরুষের বাসভূমি আলজেরিয়াকে বেছে নিয়েছেন। ফ্রান্সকে বেছে নিলে সবাই বিশ্বকাপ খেলতে পারতেন না- এ কথা মনে রাখলেও এ রকম সিদ্ধান্তের জন্য তাদের সম্মান জানাতে হয়। মানুষ তার শেকড়কে খুঁজে ফিরবে এই বোধই তাদের অনুপ্রাণিত করেছে। এখানে খুব আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
(দ্য রিপোর্ট/এএইচএমবি/এএস/ওআইসি/সা/জুন ০৪, ২০১৪