দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ কুদরাত-এ-খুদা ১৯০০ সালের ১ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের মাড়গ্রামের এক পীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান জেলার সীমান্ত মৌ গ্রামের সৈয়দ শাহ সুফী খোন্দকার আবদুল মুকিত ও সৈয়দা ফাসিয়া খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান। মক্তবে তার পড়াশোনার হাতেখড়ি। কয়েক বছর পর গ্রামের স্কুল ছেড়ে কলকাতার মিরজাপুর স্ট্রিটে অবস্থিত উডবার্ন এম.ই. স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৮ সালে তিনি কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসার অ্যাংলো পারশিয়ান বিভাগ থেকে মেধা তালিকায় প্রথম দশজনের মধ্যে থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯২৪ সালে ওই কলেজ থেকে রসায়নশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএসসি ডিগ্রি ও স্বর্ণপদক লাভ করেন।

এমএসসি পাস করার পর কুদরাত-এ-খুদা আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেট স্কলারশিপ নিয়ে লন্ডন যান ১৯২৪ সালের শেষের দিকে। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক থর্পের কাছে ডিএসসি ডিগ্রির জন্য কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৯২৯ সালে কুদরাত-এ-খুদার ডিএসসি গবেষণার পরীক্ষক হয়ে এসেছিলেন বিখ্যাত রসায়নবিদ এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উইলিয়াম হেনরি পার্কিন জুনিয়র। তিনি কাজে খুশি হয়ে তরুণ গবেষককে অক্সফোর্ডে তাঁর ল্যাবরেটরিতে কিছুদিন গবেষণা করতে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে বেশি বেতনের চাকরির সুযোগ পেলেও গ্রহণ করেননি। সে বছরই তিনি লন্ডন ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।

তখন ভারতবর্ষে ডিএসসি ডিগ্রি অর্জনকারী মুসলমান তরুণ ছিলেন একমাত্র তিনিই। এ সময়ে কুদরাত-এ-খুদা প্রথম মুসলিম ছাত্র হিসেবে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ স্কলারের সম্মান অর্জন করেন। ‘টানহীন উপপত্তির প্রথম পরখগত প্রমাণ’ এর উপর প্রকাশিত তার নিবন্ধ খুবই প্রশংসিত হয়। ১৯৩১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৩৬ সালে ওই বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদে উন্নীত হন। একই বছর সরকারের আমন্ত্রণে কুদরাত-এ-খুদা প্রথম শিক্ষা সপ্তাহ উদযাপনের দায়িত্ব পান। সে অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শিক্ষায় স্বাঙ্গীকরণ’ নামের প্রবন্ধ পড়েন। সে সময় ‘বিজ্ঞানের বিচিত্র কাহিনী’ বইটি পাঠ্যপুস্তক হিসেবে মনোনীত হয়। শিক্ষা সপ্তাহের কিছুদিন পরেই বাংলার মাধ্যমে ম্যাট্রিকিউলেশনের সকল বিষয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা হয়। ১৯৪২ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ.কে. ফজলুল হকের বিশেষ অনুরোধে তিনি ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। একই সময়ে ছাত্রদের বিশেষ অনুরোধে তিনি প্রতিদিন চার ঘণ্টা প্রেসিডেন্সি কলেজে কাজ করতে থাকেন। এরপর ১৯৪৬ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যক্ষ হয়ে ফিরে আসেন।


১৯৪৭ সালের পর কুদরাত-এ-খুদা পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। ওই বছরই পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রথম জনশিক্ষা পরিচালকের (ডিপিআই) দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ডিপিআই-এর দায়িত্ব পালন করার অন্তর্বর্তীকালে কুদরাত-এ-খুদা পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন হিসেবে বাংলা ভাষাকে বলবৎ রাখতে সচেষ্ট হন। জনাব ফযলী করিম সাহেব পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদেরকে আবশ্যিক দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উর্দু পাঠ করতে প্রস্তাব করলে কুদরাত-এ-খুদা এর বিরোধিতা করেন। ১৯৪৯ সালে তাঁকে করাচিতে পাকিস্তান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা নিযুক্ত করা হয়। ১৯৫৩ সালে দেশে ফিরে পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন।১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে পূর্বাঞ্চলীয় শাখা গঠনের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে কুদরাত-এ-খুদাকে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়।

তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বনজ, কৃষিজ ও খনিজ সম্পদের সর্বোত্তম সঠিক ব্যবহারের জন্য গবেষণা ও অনুসন্ধান শুরু করেন। বনৌষধি ও গাছগাছড়ার গুণাগুণ, পাট, কাঠকয়লা এবং মৃত্তিকা, লবণ ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ নিয়ে তিনি গবেষণা করেন। স্থানীয় বিভিন্ন গাছগাছড়া থেকে জৈব রাসায়নিক উপাদান নিষ্কাশনে সক্ষম হন, যা ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আনারস ও কলার ছোবড়া থেকে অত্যন্ত সুন্দর রেশমী ঔজ্জ্বল্যবিশিষ্ট লম্বা আঁশ বের করতে সক্ষম হন। বিভিন্ন জৈব পদার্থ নিষ্কাশন করেছিলেন যার সবই ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। পাটখড়ি থেকে কাগজ তৈরি তাঁরই গবেষণার ফল। পাটকাঠি থেকে পারটেক্স উৎপাদন, চিটাগুড় ও তালের গুড় থেকে ভিনেগার প্রস্তুত ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। বিজ্ঞানী হিসেবে ড. মুহাম্মাদ কুদরাত-এ-খুদা ও তাঁর সহকর্মীদের ১৮টি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারেরর পেটেন্ট রয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সঞ্চিত খনিজ দ্রব্যের ওপর তথ্য নিয়ে কোথায় কোন শিল্প প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব তার ইঙ্গিত লিপিবদ্ধ করে তিনি বাংলা একাডেমী থেকে একটি বই প্রকাশ করেন।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য ১৯৭২ সালে গঠিত প্রথম শিক্ষা কমিশনের সভাপতি নিযুক্ত হন ড. কুদরাত-এ-খুদা। শিক্ষা বিষয়ে তার প্রতিবেদনটি ‘কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট’ নামে পরিচিত। ১৯৭৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন।

বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে জীবনে তার ৯২টি বিজ্ঞানবিষয়ক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তার লেখা বিজ্ঞানের বইগুলো খুবই জনপ্রিয় হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বিজ্ঞানের সরস কাহিনী, বিজ্ঞানের বিচিত্র কাহিনী, বিজ্ঞানের সূচনা, জৈব-রসায়ন (৪ খণ্ড), পূর্ব-পাকিস্তানের শিল্প সম্ভাবনা, পরমাণু পরিচিতি, বিজ্ঞানের পহেলা কথা, যুদ্ধোত্তর বাংলার কৃষি ও শিল্প, বিচিত্র বিজ্ঞান, পবিত্র কোরআনের পূত কথা, ও অঙ্গারী জওয়ারা। ‘বিজ্ঞানের বিচিত্র কাহিনী’ হিন্দী, উর্দু ও অহমীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।

ইংরেজিতেও বেশ কয়েকটি পাঠ্যবই লিখেন তিনি। ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় তার অনুদিত বাংলা পবিত্র আল কুরআন।

প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি আকরামুন্নেছা উম্মাল উলুম সাদাত আকতারকে বিয়ে করেন। তাদের দুই ছেলে ও চার মেয়ে।

কুদরাত-এ-খুদা যেসব পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন তার উল্লেখযোগ্য হলো-একুশে পদক (১৯৭৬)ও স্বাধীনতা পদক (১৯৮৪, মরণোত্তর)। ১৯৯০ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তার বসতভিটায় প্রতিষ্ঠিত হয় ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা গ্রামীণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশ কেন্দ্র ও সংগ্রহশালা।

১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর তিনি ঢাকায় মারা যান।

(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/এইচএসএম/ডিসেম্বর ০১, ২০১৩)