১৯৭৪ সাল। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ মহামারীর রূপ নিয়েছে। ক্ষুধার্ত মানুষ, কাক, ডাস্টবিন আর কুকুরের ছবি আঁকছেন জয়নুল আবেদিন। নিউক্লিয়ার অস্ত্র উৎপাদন সীমিত করার লক্ষ্যে মস্কোতে ব্রেজনেভের সঙ্গে বসেছেন রিচার্ড নিক্সন। এদিকে ১৮ মে পারমাণবিক অস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়ে চীন ও পাকিস্তানের মাথা খারাপ করে দিয়েছে ভারত। আর জুলাইয়ের ৭ তারিখে মিউনিখের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে অবনত মস্তকে মাঠ ছেড়ে গেলেন ইয়োহান ক্রুয়েফ।

এরপর আর বিশ্বকাপে ফেরেননি টোটাল ফুটবলের রূপকার। রানীর অনুরোধ, দেশবাসীর আকুল আবেদন, ফুটবলপ্রেমীদের আকুতি কোনো কিছুই বুয়েন্স আইরিসে নিতে পারেনি ডাচ সম্রাটকে। দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত করলো হল্যান্ড। জোড়া গোল করলেন ক্রুয়েফ। পূর্ব জার্মানি বদান্যতাই দেখল (০-২)। এরপর রাইনাস মিশেলের প্রিয় ছাত্ররা ছিঁড়েখুঁড়ে খেল ব্রাজিলকে (২-০)। পুরো মাঠ জুড়ে নেচে বেড়ালেন, তিনবারের চ্যাম্পিয়নদের ফুটবলের নতুন কিছু পাঠ হাতে-কলমে শিখিয়ে তবে ক্ষান্ত হলেন ক্রুয়েফ। অন্য দিক থেকে পোল্যান্ড, যুগোস্লাভিয়া, সুইডেনকে হারিয়ে ফাইনালে উঠল পশ্চিম জার্মানি। ১৯৭২-এর ইউরো চ্যাম্পিয়ন তারা। বার্টি ফোটস, মুলার ও হোয়েন্সদের নেতৃত্বে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাউয়ার নামের অদম্য এক যুবক। তবুও সুপার ফেভারিট ছিল হল্যান্ড। নেসকেন্স, উটার্স আর ইয়োহান ক্রুয়েফ মিলে বিশ্বকে তখন টোটাল ফুটবলের তালিম দিচ্ছেন।

১৯৭১ থেকে ’৭৩ টানা তিনবার ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমান চ্যাম্পিয়ন্স লিগ) জিতেছে আয়াক্স আমস্টার্ডাম। তিনবারই বর্ষসেরা ফুটবলার ইয়োহান ক্রুয়েফ। হঠাৎ করেই লিওনিডাস, গ্যারিঞ্চা, পেলে আর জর্জিনহোর ব্রাজিলকে হটিয়ে ফুটবল বিশ্বের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে নিয়েছে টিউলিপের দেশটি। শুরু হলো ফাইনাল। রেফারির বাঁশি বাতাসে মিলিয়ে না যেতেই আচমকা নিজেদের বক্সে ক্রুয়েফকে আবিষ্কার করলেন বার্টি ফোটস এবং তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন এখনই ওকে না ঠেকালে গোল সুনিশ্চিত। শেষ পর্যন্ত ঠেকালেন, তবে

সেটা অবৈধভাবে। ফল- পেনাল্টি। ইয়োহান নেসকেন্সের গোলে এগিয়ে গেল হল্যান্ড। আমস্টার্ডাম, হেগে উদ্যাম উল্লাস শুরু হল। স্বপ্নের মতো শুরু। এবার আর হল্যান্ডকে রুখে সাধ্য কার? সাধ্য আছে। কিংবা অন্তত সে দিন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সে সাধ্য জার্মানির। হিটলারের উত্তরসূরিরা আস্তে আস্তে পরিকল্পনামাফিক মাঝমাঠ দখল করে নিল। শক্তিশালী ও প্রচণ্ড স্ট্যামিনার বার্টিফোটস ক্রুয়েফকে বাক্সবন্দি করে ফেললেন। ২৬ মিনিটে পল ব্রাইটনারের পেনাল্টি গোলে সমতা ফেরায় জার্মানি। ৪৩ মিনিটে জার্ড মুলারের গোল। শেষ পর্যন্ত স্কোরলাইন ২-১। দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিতে নিল জার্মানি। হতাশা, অবিশ্বাস আর বুক ভরা বেদনা নিয়ে মাঠ ছাড়লেন ইয়োহান ক্রুয়েফ, যাকে রাইনাস মিশেল, হিডালগোর মতো কোচ একজন পরিপূর্ণ ফুটবলার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ১৯৭৮-এর চূড়ান্তপর্বে উঠেছিল হল্যান্ড। সেবারও ভাল দল ছিল। বার্সার হয়ে ইউরোপ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ক্রুয়েফ। কিন্তু কি এক অজানা কারণে আর্জেন্টিনা গেলেন না তিনি। ফাইনালে স্বাগতিকরা মারিও ক্যাম্পেসের জোড়া গোলে (৩-১) হারিয়ে দিল হল্যান্ডকে। সবাই হাহুতাশ করল। ডাচরা এখনও বিশ্বাস করে ক্রুয়েফ থাকলে ’৭৮-এ অবশ্যই শিরোপা জিততো উইন্ডমিলের দেশ। অনেকে ভেবেছিলেন ’৭৪-এ জার্মানরা তার হৃদয় ভেঙে দেওয়ার পর অভিমান করে আর বিশ্বকাপ খেলতে চাননি ক্রুয়েফ। কারো কারো মতে, সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আর্জেন্টিনা যাননি। আরও কত রকম ব্যাখ্যা, কত রহস্য।

প্রায় ৩০ বছর পর ২০০৮ সালে সে রহস্য উন্মোচন করেছেন ক্রুয়েফ নিজে-‘১৯৭৭ সালের শেষদিকে এক রাতে আমার বার্সেলোনার ফ্লাটে আক্রমণ করে দুর্বৃত্তরা। মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আমায় বেঁধে ফেলে, বাচ্চাদের সামনে ওদের মাকেও বেঁধে ফেলে। তা ছিল এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। এরপর ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেত পুলিশ প্রহরায়। আমি খেলতে যেতাম বডিগার্ড নিয়ে। হঠাৎ করেই আমার কাছে জীবনের মানে বদলে গেল। বুঝতে পারলাম জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন অন্যদিকেও (ফুটবল ছাড়া) নজর দিতে হয়। তা ছাড়া এ সমস্ত কারণে শারীরিকভাবেও পুরোপুরি ফিট ছিলাম না আমি। শতভাগ ফিট না থাকলে বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।’ রেডিও ক্যাটালুনিয়াকে বলেছেন ক্রুয়েফ। তার ফুটবল জীবন এগিয়েছে উসাইন বোল্টের গতিতে।

১৭ বছর বয়সে আয়াক্সের সিনিয়র দলে অভিষেক। ১৯৬৫ থেকে ’৭৩, ৮ বছরে ছয়বার জিতেছেন ডাচ লিগ। পরে ১৯৮১, ’৮২-তে আরও দু’বার। ১৯৭১ থেকে ’৭৩ পুরো ৩ বছর ইউরোপ ছিল ক্রুয়েফ জ্বরে আক্রান্ত। প্রথম বছর প্যানাথিনাইকসকে ২-০ গোলে, পরের বছর ইন্টার মিলানকে ২-০ গোলে হারিয়ে উপর্যুপরি ইউরোপিয়ান কাপ জেতে আয়াক্স আমস্টার্ডাম। দুটি গোলই করেন ক্রুয়েফ। পরেরবার জুভেন্টাসকে ১-০ গোলে হারিয়ে হ্যাটট্রিক শিরোপা জিতে ডাচরা। এরপর এখন পর্যন্ত একমাত্র বায়ার্ন মিউনিখ ছাড়া উপর্যুপরি দুবার ইউরোপিয়ান বা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে পারেনি কোনো দল। ১৯৭২ সালে ডাচ লিগ (সর্বোচ্চ ২৫ গোল করেছিলেন ক্রুয়েফ) ও ডেন হ্যাগকে হারিয়ে ডাচ কাপও জিতে আয়াক্স। জানুয়ারিতে ইন্টার কন্টিনেন্টাল কাপ, মাস দুয়েক পর ইউরোপিয়ান সুপার কাপ। সব মিলিয়ে এক মৌসুমে ৫ ট্রফি। ১৯৭৩-’৭৪ মৌসুমে তৎকালীন রেকর্ড ২ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে বার্সেলোনায় যোগ দেন ক্রুয়েফ।

এসেই দূর করেন ২৪ বছরের শিরোপা খরা। রিয়াল মাদ্রিদকে নিজেদের মাঠে ৫-০ গোলে হারায় বার্সেলোনা। পরের বছর স্প্যানিশ কাপ জেতার পথে অ্যাথলেটিকো বিলবাওয়ের বিপক্ষে অদ্ভুত এক গোল করেছিলেন। সতীর্থের বাড়িয়ে দেওয়া পাসটি নিশ্চিত পোস্টের বাইরে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে ডান পা বাড়িয়ে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতা ও অ্যাথলেটিসিজমের চূড়ান্ত কৌশল প্রয়োগ করে বল জালে পাঠিয়ে দেন ক্রুয়েফ। ইউটিউবে আছে, দেখে নিতে পারেন। না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। এটা ‘ফ্যানটম গোল’ কিংবা ক্রুয়েফের ‘অসম্ভব গোল’ হিসেবে এখনও ফুটবলপ্রেমীদের কাছে এক অপার বিস্ময় হয়ে আছে। জাতীয় দলের হয়ে মাত্র ৪৮টি ম্যাচ খেলেছেন ক্রুয়েফ। তাতেই ৩৩ গোল। মোট ২২ ম্যাচে এই ৩৩ গোল। এর একটিতেও হারেনি হল্যান্ড। জিতেছে ২০টি। বাকি দু’টি ড্র। ম্যানেজার হিসেবেও দারুণ সফল ছিলেন তিনি। ১৯৯০ থেকে ’৯৪, টানা চারবার বার্সেলোনাকে লিগ শিরোপা এনে দেন। ’৯২ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা পেপ গার্ডিওলা, লুড্রাপ, স্টয়কভের ওই বার্সাকে এখনও ‘ড্রিম টিম’ বলা হয়। ক্রুয়েফের কাছে ফুটবল ছিল ‘সিম্পল গেম’। তবে ‘এই সহজ খেলাটা সহজভাবে খেলাটাই হল কঠিন কাজ।’আরও বলেছেন, ‘ধর্মে বিশ্বাস সেই আমার। খেলার আগে দু’দলের ২২ জন খেলোয়াড় বুকে ক্রস একে মাঠে নামে। হিসেবে তো প্রতিটি ম্যাচ ড্র হওয়ার কথা!’

২০১০ বিশ্বকাপে স্পেনের কাছে যে তৃতীয় ফাইনালটি হারল হল্যান্ড, তাতে দুঃখ নেই এই ‘টোটাল ফুটবলারের’। তার দুঃখ, রবেন, হেইটিঙ্গারা মারদাঙ্গা ফুটবল খেলে শিরোপা জয়ের ভুল পথটি বেছে নিয়েছিলেন। ‘সুন্দর, স্বাপ্নিক ও অপরিমেয় কৌশলী এক ফুটবলারের নাম ইয়োহান ক্রুয়েফ, যাকে আপনি সহজেই পেলে, ম্যারাডোনার পর তৃতীয় স্থানটি দিতে পারেন’ বলেছেন বার্সেলোনার ধারাভাষ্যকার গ্রাহাম হান্টার।

বিশ্বকাপ ছাড়া সবই জিতেছেন ক্রুয়েফ। স্টাইল, গ্লামারেও জর্জ বেস্টের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলেন না। পুরো ডাচ দলের স্পন্সর ছিল অ্যাডিডাস। ক্রুয়েফের পুমা। ফলে জাতীয় দলে ১৪ নাম্বার জার্সিতে অ্যাডিডাসের তিনটি নয়, দুটি কালো স্ট্রাইপ থাকতো! তার নামে ফ্যাশন ডিজাইনার লাজারোনি সেই ’৭৯-তে মার্কেটে স্পোর্টস ওয়্যার ছেড়েছেন।

৫ ফুট ১১ ইঞ্চি লম্বা, অত সুন্দর টিকোলো নাক ডাচদের হয় না, অমন ঝাঁকড়া চুলই বা ভ্যান বাস্তেন, ক্লুইভার্ট, পার্সিরা কোথায় পাবেন? সাপের মতো কিলবিল করে মাঝমাঠে ছবি আঁকতেন, বক্সের ভেতর থেকে, কখনও বা দূর থেকে দুরন্ত সব শট, ওয়ান টু ওয়ানে বিদ্যুৎ চমকের মতো পাস, শুধু খেলতেন না ক্রুয়েফ, খেলাতেনও। এমন একজন ফুটবলারের শোকেসে ইটালিয়ান ভাস্কর সিলভিয়া গাজানিগার ‘সোনার ট্রফিটি’ নেই- এটা ক্রুয়েফের দুঃখ, ডাচদের দুঃখ। এর চেয়েও বেশি করে বিশ্বকাপের দুঃখ!

ক্লাব ক্যারিয়ার (সিনিয়র)

সাল ক্লাব ম্যাচ গোল

১৯৬৪-৭৩ আয়াক্স ২৪০ ১৯০

১৯৭৩-৭৮ বার্সেলোনা ১৪৩ ৪৮

১৯৭৯-৮০ লস অ্যাঞ্জেলস ২৭ ২৪

১৯৮০-৮১ ওয়াশিংটন ডিপোম্যাটস ৩২ ১২

১৯৮১ লেভেন্তে ১০ ২

১৯৮১-৮৩ আয়াক্স ৩৬ ১৪

১৯৮৩-৮৪ ফেয়েন্যুর্ড ৩৩ ১১

মোট ৫২০ ৩০১

জাতীয় দল

সাল দেশ ম্যাচ গোল

১৯৬৬-৭৭ নেদারল্যান্ডস ৪৮ ৩৩

ম্যানেজার : আয়াক্স, বার্সেলোনা, ক্যাটালোনিয়া

অর্জন

আয়াক্স আমস্টারডাম

ডাচ লিগ : ১৯৬৬-৭৩, ’৮২, ’৮৩ (১০ বার)

ডাচ কাপ : ১৯৬৭, ’৭০, ’৭১, ’৭২, ’৮৩ (৫ বার)

ইউরোপিয়ান কাপ : ১৯৭১, ’৭২, ’৭৩ (৩ বার)

উয়েফা সুপার কাপ : ১৯৭২, ’৭৩ (২ বার)

ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ : ১৯৭২

বার্সেলোনা

স্প্যানিশ লিগ : ১৯৭৩-৭৪

কোপা ডেল রে : ১৯৭৭-৭৮

ফেয়েন্যুর্ড

ডাচ লিগ : ১৯৮৩-৮৪

ডাচ কাপ : ১৯৮৩-৮৪

ব্যক্তিগত অর্জন

জাতীয় দল

বিশ্বকাপ রানার আপ : ১৯৭৪

ইউরোপিয়ান বর্ষসেরা ফুটবলার : ১৯৭১, ’৭৩, ‘৭৪ (৩ বার)

ডাচ বর্ষসেরা ফুটবলার : ১৯৬৭, ’৬৯, ’৭১, ‘৭২, ’৮৪ (৫ বার)।

ডাচ বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ : ১৯৭৩, ’৭৪ (২ বার)

বিশ্বকাপের সেরা ফুটবলার : ১৯৭৪

অন্তর্ভুক্তি : ফিফা ড্রিম টিম, ফিফা সর্বকালের সেরা

একাদশ, ওয়ার্ল্ড সকার শতাব্দী সেরা একাদশ

ম্যানেজার হিসেবে শিরোপা (উল্লেখযাগ্য)

স্প্যানিশ লিগ : ১৯৯১-৯৪ (৪ বার)

ইউরোপিয়ান কাপ, উয়েফা সুপার কাপ - ১৯৯২

হেনরিক ইয়োহান ক্রুয়েফ

জন্ম : ২৫ এপ্রিল, ১৯৪৭

জন্মস্থান : আমস্টারডাম, নেদারল্যান্ডস

উচ্চতা : ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি

পজিশন : অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার

(দ্য রিপোর্ট/এফজে/এএস/সিজি/আরকে/জুলাই ৫, ২০১৪)