আমানউল্লাহ আমান, দ্য রিপোর্ট : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাঁচ ইস্যুতে ভোট চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত, নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশের ব্যাপ্তি ও গ্রামীণ উন্নয়ন- মোটা দাগে এই পাঁচ ইস্যূতেই ভোট পাবেন তারা।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘দিন বদলের স্লোগান’ নিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে ৮৭.৩১ শতাংশ ভোটার ভোট প্রয়োগ করেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছিলো ৪৮.০৪ শতাংশ। সংখ্যার হিসেবে ৭ কোটি ৬ লাখ ৪৮ হাজার ৪৮৫ ভোটের মধ্যে ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬২৯। মোট ২৩০ আসনে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে দলটি।

নির্বাচন কমিশনের হিসেবে দেখা যায় ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৬১ লাখ ৪০ হাজার ৬৩৯ জন নতুন ভোটার হিসেবে ভোট প্রদান করেন।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা মনে করেন, তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের আশ্বাসে তাদেরকে ভোট দিয়েছিলো।

তাই এবার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এর ব্যত্যয় ঘটবে না। এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৮ লাখ ৬১ হাজার ৮৫৮ নতুন ভোটার।

সম্প্রতি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের জনসভা, সাভারের আশুলিয়ায় মহিলা হোস্টেল উদ্বোধন, জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে বৈঠকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে এই সকল ইস্যূ নিয়ে বক্তব্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে পূনরায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, নতুন ভোটাররা যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ায় জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব স্বচক্ষে দেখেছে। তাই এ সকল নতুন ভোটাররা যুদ্ধাপরাধ বিচারের অসমাপ্ত কাজ, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ, জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়াত্তকরণসহ সরকারের উন্নয়নের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে।

আওয়ামী লীগের ইশতেহার তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবুল বারাকাত দ্য রিপোর্টকে বলেন, জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়াত্ততকরণের প্রস্তাব থাকবে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে।

অন্যদিকে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬১ জন ভোটারের মধ্যে নারী ভোটার রয়েছেন ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৩৬ হাজার ৯৮১ জন। যার সবটাই আওয়ামী লীগের ঘরে যাবে বলে দাবি করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এর কারণ হিসেবে তারা দেখছেন হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবির মাধ্যমে নারীদেরকে গৃহবন্দি রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ এটা মেনে না নিয়ে নারীদের উন্নয়নে কাজ করেছে। নবম জাতীয় সংসদের শুরুতেই সংরক্ষিত মহিলা আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৪৫ থেকে ৫০ করা হয়।

শুধু শহর নয় আওয়ামী লীগের ভোটের হিসেবে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছেন গ্রামের ভোটাররা। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের এক জরিপেও এমন তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। জরিপে বলা হয়েছে, শহরে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ২৫ শতাংশ এবং গ্রামে ৩৫ শতাংশ। গ্রামীণ মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য সরকার একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প করেছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করেছে। এই কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ১৭ কোটির বেশি রোগী স্বাস্থ্য সেবা পেয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের উদ্যোগে জনসাধারণের মাঝে ৩০ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের লক্ষ্য থাকলেও ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের কাজ চলছে।

যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি ও বৃটিশ দাতা সংস্থা ইউকেএইড এর অর্থায়নে জরিপকারী প্রতিষ্ঠান এসি নিলসন গত প্রায় এক বছরে চার ধাপে একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। এ জরিপটি বাস্তবায়নে কাজ করেছে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল। তাদের জরিপ মতে ১৯ শতাংশ ভোটার এখন পর্যন্ত কারো পক্ষে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি।

আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট ও হেফাজতে ইসলামের অপপ্রচারের সঠিক তথ্য তুলে ধরতে পারলে এই ১৯ শতাংশ ভোটারও তাদেরকে সমর্থন দেবেন।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সংসদ সদস্য খালিদ মাহমুদ চৌধুরী দ্য রিপোর্টকে বলেন, আওয়ামী লীগের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য গ্রাম অঞ্চলে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড গ্রামের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক হয়েছে। তাই বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, গ্রামের ৭০ শতাংশ ভোট আওয়ামী লীগ পাবে।

এক্ষেত্রে তিনি আরও জানান, সংখ্যালঘু ও আদিবাসী গোষ্ঠীর উপর জামায়াত-শিবিরের অব্যাহত তাণ্ডব, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নও বর্তমান সরকার বাস্তবায়ন করেছে। যা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে জনসমর্থন যোগাবে।

জামায়াত-হেফাজতের নারী বিদ্বেষী ইস্যু, সংখ্যালঘু-আদিবাসীদের উপর হামলা, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ, জামায়াতের অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান রাষ্টায়ত্তকরণ, তরুণ প্রজন্মের যুদ্ধাপরাধের বিচারসম্পন্ন করাসহ উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার বিষয়গুলোর সমাধান করতে পারলে নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে ভোটব্যাংকের সমীকরণে এগিয়ে থাকবে আওয়ামী লীগ। এমনটাই মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী মহল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী দ্য রিপোর্টকে বলেন, সাধারণত ক্ষমতায় যে দল থাকে তাদের পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়া কঠিন হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ কী কী ভাল কাজ করেছে তা জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে।

তিনি আরও বলেন, হেফাজতের ৫ মে-র রাতের সমাবেশে পুলিশের গুলিতে কত মানুষ মারা গেছেন তা নিয়ে চলা বিভ্রান্তি নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাছাড়া শেয়ার বাজার, ডেসটিনি, হলমার্ক অর্থ কেলেঙ্কারি, ছাত্রলীগ-যুবলীগের অনিয়ন্ত্রিত আচরণসহ বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে সেই অভিযোগগুলো যদি আওয়ামী লীগ খণ্ডন করতে পারে তাহলে হয়তো বা জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

আচরণের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক নেই দাবি করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে আরও সংযত হতে হবে। সংযত হয়ে তাদের ইতিবাচক দিকগুলো মানুষের কাছে তুলে ধরা উচিত।

(দ্য রিপোর্ট/এইউএ/এমডি/এইচএসএম/ডিসেম্বর ০১, ২০১৩)