বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর আগে `পোস্টার বয়’ হিসেবে আলোচনায় উঠে আসেন আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি, পর্তুগালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এবং ব্রাজিলের নেইমার। ক্লাব ফুটবলের পারফরম্যান্স আর ব্যক্তিগত ক্যারিশমার কারণে সবার মনোযোগ কেড়ে নেন এই তিন ফুটবলার। তিনজনই বিশ্বের অন্যতম সেরা লিগ লা লিগায় খেলেন। বার্সেলোনায় মেসি ও নেইমার এবং রিয়াল মাদ্রিদে রোনালদো। ২০০৯ সালে `ব্যালন ডিঅর’ ও `ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার’, ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে `ফিফা ব্যালন ডি’অর এবং ২০১০-১১ সালে ইউফা বেস্ট প্লেয়ার ইন ইউরোপ অ্যাওয়ার্ড জয় করে সবাইকে ছাড়িয়ে যান ২৭ বছর বয়সী লিওনেল মেসি। ক্লাব ফুটবল প্রতিযোগিতায় বার্সেলোনার অল-টাইম টপ স্কোরার তিনি। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে টানা চারবার সর্বাধিক গোলদাতা এবং টানা ৪ বছর হ্যাটট্টিক করার একমাত্র রেকর্ড তার। লা লিগা, ইউফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ইউরোপীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তিনি সর্বাধিক গোলদাতা। ২০০৫ সালে ফিফা অনূর্ধ-২০ বিশ্বকাপ এবং ২০০৮ সালে অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী আর্জেন্টিনা দলের অন্যতম খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। আর্জেন্টিনার হয়ে ৪২টি গোল করেছেন এই ফরোয়ার্ড। এ ছাড়া তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য রেকর্ড। এ কারণে তিনি সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একজন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকেন।

২০০৮ সালে ব্যালন ডি’অর ও ফিফা ওয়ার্ল্ড প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার এবং ২০১৩ সালে-ফিফা ব্যালন ডি’অর হন ২৯ বছর বয়সী ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। পর্তুগালের হয়ে সর্বাধিক আন্তর্জাতিক গোল তার। এ ছাড়াও তিনি বেশ কিছু কৃতিত্বের অধিকারী। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হন ২০০৯ সালে রেকর্ড পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দিয়ে। ২০১৩ সালে ওয়েলসের উইঙ্গার গেরেথ বেল টটেনহাম হটস্পার থেকে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দিয়ে নতুন রেকর্ড গড়ার আগ পর্যন্ত রোনালদোই ছিলেন এই রেকর্ডের মালিক। তবে ক্লাব থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ প্রাপ্তির দিক দিয়ে রোনালদোকে এখনও কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফুটবলার হওয়া ছাড়াও রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে গোল করে চলেছেন নিয়মিতই। এ ক্ষেত্রে বার্সেলোনার মেসির সঙ্গে তার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। গত ৫ মৌসুমে মেসি তিনবার ও রোনালদো দুইবার সর্বাধিক গোলদাতা হয়েছেন। মেসির গোলের সংখ্যা ১৬৮ ও রোনালদোর ১৬৫। একই সময় বার্সেলোনা তিনবার ও রিয়াল মাদ্রিদ একবার চ্যাম্পিয়ন হয়। এ থেকে এই দু’জনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আচ কিছুটা হলেও অনুধাবন করা যায়। এ কারণেই বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ আর মেসি-রোনালদোকে নিয়ে ফুটবল বিশ্বে এত বেশি আলোড়ন, এত বেশি হৈ চৈ।কিন্তু মেসি এবং রোনালদোর তুলনায় অর্থ, সন্মান, খ্যাতি, প্রতিপত্তির দিক দিয়ে পিছিয়ে আছেন ২২ বছর বয়সী নেইমার। অবশ্য বয়সও খুব বেশি নয় এই ফরোয়ার্ডের। ২০১১ সালে জিতেছেন ‘সাউথ আমেরিকান ফুটবল অব দ্য ইয়ার’ এবং সেরা গোলের জন্য ‘ফিফা পুসকাস অ্যাওয়ার্ড’। ২০১৩ সালে বড় অঙ্কের বিনিময়ে ব্রাজিলের সান্তোস থেকে বার্সেলোনায় আসেন নেইমার। জাতীয় দলের হয়ে ইতোমধ্যে গোল করেছেন অর্ধ-শতাধিক। তিনি তার খেলার স্টাইল দিয়ে আলাদাভাবে নিজের অবস্থান গড়ে নিয়েছেন। যে কারণে মেসি-রোনালদোর পর আলোচিত হয় নেইমারের নাম।

তিন বল প্লেয়ারের মধ্যে মেসি ও রোনালদো ২০০৬ ও ২০১০ বিশ্বকাপ খেললেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। আর এবারই প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবলে অভিষেক হয় নেইমারের। পরিণত মেসি ও রোনাল্ডোর সঙ্গে নবীন নেইমারের পারফরম্যান্স ছিল এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম আকর্ষণ। জার্মানির কাছে ৪-০ গোলে নাস্তানাবুদ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২-২ ও ঘানাকে ২-১ গোলে হারিয়ে প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়ে যায় পর্তুগাল। ঘানার বিপক্ষে সবেধন নীলমণি একটি গোল করেই বিদায় নেন রোনালদো। সেই তুলনায় নেইমারের অভিষেক হয়েছে দুর্দান্ত। ক্রোয়েশিয়া আর ক্যামেরুনের বিপক্ষে ২টি করে মোট ৪টি গোল দিয়ে গোল্ডেন বুটের লড়াইয়ে টিকে ছিলেন তরুণ এই ফুটবলার। তাকে কেন্দ্র করে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছিল ব্রাজিল। ইতোমধ্যে সেমিফাইনালেও পৌঁছে গেছে সেলেসাও’রা। কিন্তু স্বপ্ন ভেঙে গেছে নেইমারের। কোয়ার্টার-ফাইনালে কলম্বিয়ার সঙ্গে খেলায় মেরুদণ্ডে আঘাত পেয়ে ছিটকে গেছেন বিশ্বকাপ থেকে।

বিশ্বকাপ ফুটবলের অতীতের ব্যর্থতা ঝেড়ে ফেলে এবার যেন স্ব-মহিমায় প্রকাশিত হয়েছেন মেসি। তিনি হয়ে উঠেছেন আর্জেন্টিনার স্বপ্নযাত্রার পথ-প্রদর্শক। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, ইরান, নাইজেরিয়ার বিপক্ষে জয়সূচক গোল করে তিনি দলকে নিয়ে যান দ্বিতীয় রাউন্ডে। আর ‘রাউন্ড অব সিক্সটিন’-এ সুইজারল্যান্ড এবং কোয়ার্টার-ফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে গোল করতে না পারলেও তার জাদুকরি পাসে জয় পেয়েছে আর্জেন্টিনা। এরফলে আর্জেন্টিনা এখন সেমিফাইনালে উঠে বিশ্ব জয়ের স্বপ্নে মশগুল। আর মেসি চার গোল দিয়ে ‘গোল্ডেন বুট’-এর লড়াইয়ের পাশাপাশি ‘গোল্ডেন বল’-এর অন্যতম দাবিদার হয়ে উঠেছেন।

তবে ‘পোস্টার বয়’ না হয়েও এবারের বিশ্বকাপের নায়ক হয়ে উঠেন কলম্বিয়ার জেমস রদ্রিগেজ। ২২ বছরের এই তরুণ কিন্তু নিজেকে পরিচিত করেছেন ‘হামেস’ রদ্রিগেজ হিসেবে। তার দুর্দান্ত ক্রীড়ানৈপুণ্যে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার-ফাইনালে খেলে কলম্বিয়া। প্রথম রাউন্ডে গ্রীস, আইভরি কোস্ট ও জাপান, দ্বিতীয় রাউন্ডে উরুগুয়ে এবং কোয়ার্টার-ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে গোল করেন। এবারের বিশ্বকাপে তিনিই একমাত্র খেলোয়াড়, অংশ নেওয়া প্রতিটি ম্যাচেই গোল করে চমক দেখিয়েছেন। দল বিদায় নিলেও ৬ গোল করে তিনি গোল্ডেন বুট’-এর লড়াইয়ে আছেন সবার ওপরে।

গোল্ডেন বুট-এর লড়াইয়ে রদ্রিগেজের পাশে রয়েছেন ৪টি করে গোল দিয়ে আছেন মেসি, জার্মানির থমাস মুলার, ৩ গোল দিয়ে নেদারল্যান্ডসের রবিন ফন পার্সি ও আরিয়েন রবেন। এ ছাড়া সেমিফাইনালের দলগুলোর মধ্যে ব্রাজিলের ডেভিড লুই, জার্মানির ম্যাটস হামেলস, নেদারল্যান্ডসের মেমিফিস ডিপে দু’টি করে গোল দিয়েছেন। অবিশ্বাস্য কিছু না হলে এই খেলোয়াড়দের মধ্যে থেকেই কেউ-গোল্ডেন বুট পাবেন। এক বিশ্বকাপে ১৩ গোল দিয়ে’ গোল্ডেন বুট- পান ফ্রান্সের জাস্ট ফন্টেইন। ১৯৫৮ সালে সুইডেন বিশ্বকাপে তিনি এই রেকর্ড গড়েন। ২০০২ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের রোনাল্ডোর ৮ গোল বাদ দিলে ১৯৭৮ সাল থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপে ৬ বা ৫ গোল দিলেই পাওয়া গেছে-গোল্ডেন বুট। আর ২০০৬ বিশ্বকাপে জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসা এবং ২০১০ বিশ্বকাপে জার্মানি থমাস মুলার, স্পেনের ডেভিড ভিয়া, নেদারল্যান্ডসের ওয়েসলি স্নেইডার ও উরুগুয়ের ডিয়েগো ফোরলান ৫টি করে গোল দেন। সেই হিসেবে কলম্বিয়ার হামেস রদ্রিগেজের অনেকটাই নিশ্চিত থাকার কথা। কিন্তু এখনও রয়ে গেছে সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল; কিংবা তৃতীয়স্থান নির্ধারণী ম্যাচ। মেসি বা মুলার দুই ম্যাচে ৩টি গোল করলেই ছাড়িয়ে যাবেন রদ্রিগেজকে। তেমন সম্ভাবনাকে তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর সেমিফাইনালে ১৯৩০ সালে উরুগুয়ের পেদ্রো সিয়া, ১৯৩৪ সালে চেকস্লাভাকিয়ার ওল্ডরিচ নেজেদলি, ১৯৫৮ সালে ব্রাজিলের পেলে, ১৯৫৮ সালে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ফ্রান্সের জাস্ট ফন্টেইন এবং ১৯৬৬ সালের ফাইনালে ইংল্যান্ডের জিওফ হার্স্টের মতো হ্যাটট্টিক করতে পারলে তো কথাই নেই। বিশ্বকাপ ফাইনালে একমাত্র হ্যাটট্টিক করার কৃতিত্ব হার্স্টের। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, এরপর ফাইনাল তে দূরে থাকুক, সেমিফাইনালে আর কখনও হ্যাটট্টিক হয়নি।

এবারের বিশ্বকাপে-গোল্ডেন বুট-এর লড়াইয়ে এগিয়ে আছেন কলম্বিয়ার অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার রদ্রিগেজ। অসম্ভব প্রতিভাবান এই ফুটবলার প্রতিটি ম্যাচে গোল করলেও কোয়ার্টার-ফাইনাল থেকে তাকে বিদায় নিতে হয়। এমন বিদায় মেনে নিতে পারেননি এই তরুণ। তাই ভেঙে পড়েন কান্নায়। তার এই কান্না ছুঁয়ে যায় ফুটবল অনুরাগীদের। কলম্বিয়াকে স্বপ্ন দেখান এই ফুটবলার-‘গোল্ডেন বুট’ পেলে তা হবে তার জন্য বড় একটি সান্ত্বনা।

(দ্য রিপোর্ট/ডিএম/এএস/আরকে/জুলাই ৭, ২০১৪)

dulalmahmud@yahoo.com