হরতাল-অবরোধে পরিবহন ব্যবসায় ধস
রানা হানিফ, দ্য রিপোর্ট : বেগ শহিদুল ইসলাম, পেশায় বাসচালক। খুলনা থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম রুটে নিয়মিত বাস চালান। আর এই রুটে একটি ট্রিপের জন্য শহিদুল আয় করেন দেড় হাজার টাকা। স্বাভাবিক অবস্থায় সপ্তাহে চারটির বেশি ট্রিপ দেওয়া সম্ভব নয় শহিদুলের পক্ষে। এতে করে মাস শেষে তার আয় হয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ঘন ঘন হরতাল ও অবরোধের কারণে নভেম্বর মাসের পুরোটাই বেকার ছিলেন তিনি। আবার ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই অবরোধ চলায় এই মাসেও আয় হবে না বলে আশঙ্কা শহিদুলের।
নির্বাচনকালিন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কটে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা ঘন ঘন হরতাল ও অবরোধের ফলে ধস নেমেছে পরিবহন ব্যবসায়। একই সঙ্গে পরিবহন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের এই সময়ে বেকার বসে থাকতে হচ্ছে।
হানিফ ইন্টারপ্রাইজের বাসচালক বেগ শহিদুলের মতো ঈগল পরিবহনের সুপারভাইজার মুকুলও ঘরে বেকার সময় কাটিয়েছেন পুরো নভেম্বর মাস। শহিদুলের মতো মুকুলও দ্য রিপোর্টকে জানান, অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে পুরো নভেম্বর মাস পর্যন্ত মাত্র চারটি ট্রিপে কাজ করতে পেরেছেন তিনি।
মুকুল বলেন, ‘যেদিন হরতাল বা অবরোধ ডাকা হয় সেদিন থেকেই লং-রুটের সকল বাস চলাচল বন্ধ করে দেয় মালিকপক্ষ। আবার হরতাল শেষ হলেও সেদিন গাড়ি বের করা সম্ভব হয় না। কারণ বর্তমানে হরতাল থাকা লাগে না, হরতাল-অবরোধ ডাকা হলেই গাড়ি ভাঙচুর, আগুন দেওয়া শুরু হয়ে যায়। আর এ কারণে মালিক গাড়ি বের করতে নিষেধ করেন।’
পরিবহন শ্রমিকদের চাইতেও দুরাবস্থায় রয়েছেন এ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তরা। ব্যাংক ঋণ নির্ভর এই খাতে হরতাল ও অবরোধের ফলে ধ্বংস হতে বসেছে বলে মনে করছেন পরিবহন মালিকরা।
এ ব্যাপারে অ্যাসোসিয়েশন অব বাস কোম্পানিজের সভাপতি মো. কাজল দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘একদিন বাস বন্ধ থাকা মনেই লস। আর সেখানে পুরো নভেম্বর মাসে বাস রাস্তায় বের করতে পারিনি। ডিসেম্বর মাসেও একই অবস্থা থাকবে বলে মনে হয়। ফলে আমাদের ব্যবসা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বাংলাদেশে পরিবহন ব্যবসা গড়ে উঠেছে। হরতাল-অবরোধের ফলে এই ব্যবসা ধ্বংস হতে চলেছে।’
কাজল বলেন, ‘একদিন বাস বন্ধ থাকলেও আমার অফিস খরচ, স্ট্যাফের বেতন বন্ধ থাকে না। আবার গাড়ি বন্ধ রেখে পার্কিংয়ের টাকাও বসে বসে দিতে হচ্ছে। আমরা যারা ঋণ করে গাড়ির ব্যবসা করছি তাদের সময় মতো কিস্তি পরিশোধ করতে হয়।’
পরিবহন ব্যবসা ‘চাল-ডাল ব্যবসার’ মতো না যে বিক্রি হলো না রেখে দেব- এমন অভিমত ব্যক্ত করে তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের মূলধন বাস নয়, সময়। আমরা সময় বেঁচে খাই। কার কয়টা বাস আছে- এটা বড় বিষয় না। সপ্তাহে আমার বাস কতদিন চলছে সেটাই আমার ব্যবসা। তাই যতদিন বাস বন্ধ থাকবে আমাদের ক্ষতিও ততো বাড়বে।’
হরতাল ও অবরোধে দূরপাল্লার গণপরিবহনের আর্থিক ক্ষতি সম্পর্কে জানতে চাইলে সোহাগ পরিবহনের এক কর্মকর্তা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আর্থিক ক্ষতি একেক কোম্পানির একেক রকম। গ্রীণলাইন, হানিফ, এস আলম, শ্যামলী পরিবহনের মতো বড় বড় কোম্পানির প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা সেল হয় (যাত্রী ভাড়া)। হরতাল-অবরোধে পুরো সেলই বন্ধ থাকে। তাই গত এক মাসে ক্ষতির পরিমাণ সব কোম্পানির এক করলে কয়েকশ কোটি টাকায় দাঁড়াবে।’
পণ্য পরিবহনেও স্থবিরতা :
হরতাল-অবরোধের ফলে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান নির্ভর পণ্যপরিবহন ব্যবস্থা পুরোটাই বন্ধ থাকে গোটা নভেম্বর মাসে। ফলে এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় এক কোটি মানুষ আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অন্যদিকে, ব্যবসায়িক ক্ষতির পাশাপাশি পরিবহন ব্যবসা বন্ধেরও চিন্তা করছেন অনেক মালিক।
মিরপুর-১০ নম্বর চালের আড়ৎদার হারুনুর রশীদ। পুরো নভেম্বর মাসে মাত্র তিন চালান চাল আড়তে মজুদ করতে পেরেছেন। যেখানে মাসে প্রায় ১০ থেকে ১৫ চালান চাল ঢাকায় আনতে হয় তাকে।
দ্য রিপোর্টকে হারুনুর রশীদ বলেন, ‘মিরপুর-১০ নম্বরের অধিকাংশ পাইকারী ব্যবসায়ী কুষ্টিয়া ও পাবনা এলাকার রাইসমিল থেকে চাল কিনে থাকে। তাদের সপ্তাহে অন্তত তিনবার চাল আনতে হয়। কিন্তু নভেম্বর মাসে আমি মাত্র তিনবার চাল আনতে পেরেছি। এখন চাল কিনে আমাকে মিলে ফেলে রাখতে হচ্ছে। কোনো ট্রাক মালিক তার ট্রাক ভাড়া দিতে চাচ্ছেন না। ফলে চালের একটা সংকট রয়েছে। পাশাপাশি দামও বাড়ছে।’
এ ব্যাপারে কথা বলা হলে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি সভাপতি মো. তোফাজ্জল হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সারাদেশে প্রায় ৬০ হাজার ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান রয়েছে। মালিক বাদ দিয়ে একজন ড্রাইভার ও একজন হেলপারের হিসেব করলে এক লাখ ২০ হাজার মানুষ সরাসরি এই ব্যবসায় জড়িত। এছাড়া পণ্য ও মালামাল পরিবহনের সঙ্গে কুলি, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরাও সংশ্লিষ্ট। সব মিলিয়ে এই খাতে প্রায় কোটি মানুষের আয়-রোজগার নির্ভর করছে। হরতাল-অবরোধের কারণে তাদের আয়ও বন্ধ থাকছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের ৬০ ভাগই ব্যাংক লোন নির্ভর। আমরা লোন নিয়ে রাস্তায় ট্রাক নামায়। আর এখান থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে লোন শোধ করি, ড্রাইভার-হেলপারের বেতন দেই এবং নিজেদের সংসার চালাই। কিন্তু দিনের পর দিন ব্যবসা বন্ধ থাকলে কয়েকদিন পর ব্যাংকের লোকজন এসে হয় আমাদের গাড়ি নিয়ে যাবে, না হয় আমাদের কোমরে দঁড়ি পরাবে।’
(দ্য রিপোর্ট/এইচআর/জেএম/ডিসেম্বর ০১, ২০১৩)