‘ভারতও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়’
সাগর আনোয়ার, দ্য রিপোর্ট : আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অর্থবহ দেখতে চায় প্রতিবেশি দেশ ভারত। বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশি এই দেশটির বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে খুব বেশি মাথা ব্যথা নেই। তবে দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে চিন্তিত।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী গত সপ্তাহে ৪ দিনের ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে দ্য রিপোর্টের সঙ্গে আলাপকালে একথা বলেন। ওই সফরে তিনি দেশটির রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী, সিনিয়র মন্ত্রীসহ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘ভারতের কাছে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণই হচ্ছে মূল বিষয়। ভারত বোকার দেশ নয় যে, বাংলাদেশের চেয়ে তারা আওয়ামী লীগকে প্রাধান্য দিবে। প্রতিবেশি হিসেবে ভারতের যতটুকু চিন্তিত থাকা দরকার তারা বাংলাদেশ নিয়ে ততোটুকুই চিন্তিত। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা থাকার কথা নয়। আমিও তেমন দেখিনি।’
ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবীর বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে তাকে (প্রণব মুখার্জী) চিন্তিত মনে হয়েছে। তার সঙ্গে কথা বলে আমার আরো মনে হয়েছে, তারা অবশ্যই একটি অর্থবহ, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন চায়। সৎ প্রতিবেশি হিসেবে প্রতিবেশির শান্তি, সু-স্থিতি তারা অবশ্যই চান।’
কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘ভারত প্রাধান্য দেয় বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জনগণ ও বাংলাদেশের সমৃদ্ধিকে। সেখানে তাদের মিত্রদল হিসেবে আওয়ামী লীগের নাম সবার আগে চলে আসে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, আমরা ভারত নিয়ে একটু বেশি ভাবি।’
তিনি বলেন, ‘ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী আমার বন্ধু নন, বড় ভাইয়ের মতো। তাঁর স্ত্রী আমার মায়ের মতো। কেবল প্রণব মুখার্জীই নন, এমন আরো অনেক ভারতীয় রাজনীতিক আমাদেরকে সম্মানের চোখে দেখেন। আমার মনে হয় ভারত কখনো আমাদের মুরুব্বি হতে চায়নি, সৎ প্রতিবেশি হতে চেয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের কোনো কোনো নেতা ভারতকে তাদের মুরুব্বি মনে করছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যেভাবে অন্যের ওপর আমাদের কর্তৃত্ব জাহির করি, ভারতের কোনো রাজনীতিক এতটা নোংরাভাবে কারো ওপর কর্তৃত্ব করেন না।’
আশির দশকে টানা ১৬ বছর ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। ওই সময়ের স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন আমাদের যথেষ্ঠ যত্ন করেছেন, মর্যাদা দিয়েছেন। আমার এখনও মনে পড়ে, আমার পুরো পরিবার নিয়ে ১৯৮০ সালের ৩০ ডিসেম্বর এক নম্বর সমদার জং বাড়িতে আমরা ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। আমার মা তার জন্য একটা অখণ্ড পবিত্র কোরআন ও টাঙ্গাইলের শাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন।’
বঙ্গবীর আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘‘আমরা খুব অভিভূত হয়েছিলাম, মার দেওয়া শাড়িটি হাতে নিয়েই ইন্দিরা গান্ধী কয়েক মিনিটের জন্য ভেতরে গিয়ে পরে এসে আমার আর মার মাঝখানে বসে অনেক কথা বলেছিলেন। ওই সময়ে আমার মাকে তিনি বলেন, ‘তুমি টাইগারের মতো সন্তান জন্ম দিয়ে এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ মাতার গৌরব অর্জন করেছো।’ সেদিনের সেই স্মৃতি, ছবি এখনও আমাদের হৃদয়ে রেখাপাত করে। আজ মা নেই, আমি যখন সেই ছবি দেখি, মনে হয় সব আছে।’’
কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘তাই শুধু একা মহামান্য রাষ্ট্রপতি নন, আমাদের সঙ্গে ভারতেরই একটা সম্মানজনক মধুর সম্পর্ক রয়েছে। যতদিন সমমর্যাদা পাবো ততোদিন এ সম্পর্ক অবশ্যই বহাল থাকবে।’
মন্ত্রিপরিষদে যোগদানের জন্য সরকারের তরফ থেকে অনুরোধের বিষয়ে কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘কিছুদিন তো আমিও কতডাক পেলাম উপদেষ্টা হওয়ার জন্য, সরকারের উপদেষ্টা হলে তাও কথা ছিলো, মন্ত্রীর পদ-মর্যাদার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা! উপদেষ্টার প্রতি তো প্রধানমন্ত্রীর আস্থা ও বিশ্বাস থাকতে হবে। আমার সঙ্গে তার রাজনৈতিক মতবিরোধ রয়েছে। আমি কি করে তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হবো। এটা তো মারাত্মক ন্যায়নীতি বিরোধী।’
তিনি বলেন, ‘আমরা তো বারবার বলে আসছি, সরকারপ্রধানের দায়িত্ব সবাইকে নিয়ে চলা। দেশের সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। তারপরও যদি সরকার নির্বিকার থাকে তাহলে মুখে যতো কথাই বলুক সরকার প্রধানকে জবাবদিহি করতেই হবে।’
সঙ্কট নিরসনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রস্তাবনা সম্পর্কে কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘আমার দলের একেবারেই সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব, এই ছেলেখেলা নির্বাচনী তফসিল বাতিল করে সংসদের মেয়াদ শেষ হলে সংসদ পরবর্তী ৯০ দিনের নির্বাচনী সরকার গঠন করে সকলকে নিয়ে একটা বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে হবে।’
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পর্কে কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও মহাজোট ছাড়া কেউ প্রার্থী বাছাই করেনি। তাছাড়া আওয়ামী লীগও নির্বাচন করার জন্য সরকারি মনোনয়নপত্র জমা দেয়নি। শুধু আমি নই সবাই বলছে পাতানো নির্বাচনে আমাদের কোনো সম্মতি নেই। আমরা নির্বাচনে অংশ নিবো না।’
তিনি বলেন, ‘সঙ্কটের সমাধান সবাইকে নিয়ে বসে বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে হবে।’
সঙ্কটের সমাধান কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাংবিধানিক সঙ্কটের কথা বলে উত্তেজনা সৃষ্টির কোন মানেই হয় না। সদিচ্ছা থাকলে অনেক বিকল্প আছে। আর সর্বদলীয় সরকারের যে কথা বলা হয়েছে, এখন যারা সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন, তাদের মধ্যে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছাড়া সংবিধানের বিধান অনুসারে সবাই অবৈধ। সংবিধানে কোনো সর্বদলীয় সরকারের বিধান নেই। মিলে-মিশে কয়েকটি দল সর্বদলীয় সরকার গঠন করে জনগণের ভোট লুট করবে, দেশবাসী তা মানবে না। এগুলো ছেলেখেলার মতো। যারা সংসদে আছে তারা সর্বদলীয় সরকারে, আর যারা নেই, অথবা নিবন্ধিত দল তাদের সবাইকে উপদেষ্টা বানাবেন তারপর নির্বাচন দিবেন, এমন পাতানো নির্বাচন এর আগে কখনো পৃথিবী দেখেনি। এমন আজব নির্বাচন দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।’
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাধীনতার ৪২ বছর পর বিজয়ের মাসে নিজের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি সম্পর্কে কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় তো আমরা খুব ছোট ছিলাম সেজন্য বেশি কিছু চাইনি। তবে পাকিস্তান আমলে যেমন ছিলাম আমরা কেউ তেমন থাকতে চাই নি। আমরা সম্মান, মর্যাদার সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম। গরীবের উপর ধনীর জুলুম হবে না, সরকার তস্করের ভূমিকায় নামবে না এমনটাই আশা করেছিলাম। গরীব আরো গরীব, ধনী আরো ধনী হবে না এটাই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের চালিকাশক্তি। সেক্ষেত্রে আমরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি। আজ ন্যায়-অন্যায় মানবতা সব ভূলুণ্ঠিত। পাকিস্তানের ধনী ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে ছিলো আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এখন সেই জায়গায় ২২ লাখ কোটিপতি। তাই অনেক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন হয়নি।’
তরুণদের উদ্দেশ্যে কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘আশার কথা আমরা একটা স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েছি। ভাবি প্রজন্মের মধ্যে যদি জাতীয় আত্মসম্মানবোধ থাকে, তারা বিশ্বের দরবারে যদি খড়কুটো হিসেবে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরতে না চায়, তাহলে আমরা ভিনদেশি শত্রুর হাত থেকে রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে হলেও দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবো। আমাদের যোগ্য ভাবি প্রজন্ম অভ্যন্তরীণ শত্রু মোকাবেলা করে বিজয়ী হবে। বিজয়ের জয়টিকা তারা কপালে পরবে। এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা একটা দেশের, জাতির ভিত রচনা করেছি, নবপ্রজন্ম ইটের উপর ইট রেখে তাতে ইমারত রচনা করবে।’
(দ্য রিপোর্ট/ সাআ/এইচএসএম/ডিসেম্বর ০২, ২০১৩)