আমানউল্লাহ আমান, দ্য রিপোর্ট : সম্প্রতি গোপন স্থান থেকে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে দেশের মানুষের পরিচিতি না থাকায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ‘রাজনীতিতে কী ইঙ্গিত দিচ্ছে এই ভিডিও বার্তা’।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের টানা ৭২ ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পর শুক্রবার ভোর রাতে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। এরপর দলটির অন্যতম যুগ্ম-মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে দলের মুখপাত্রের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

মুখপাত্র হিসেবে দলীয় কর্মসূচি মিডিয়ার মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারের কথা থাকলেও সালাহউদ্দিন আহমেদ একরকম আত্মগোপনে থেকে বিবৃতি ও ভিডিও বার্তার মাধ্যমে দলের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। গ্রেফতার এড়াতেই তিনি এমনটি করছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এটি অত্যন্ত অশুভ সঙ্কেত। বিরোধী দল মনে করছে, সাংবিধানিকভাবে সরকারের বিরোধিতা-ভুল-ভ্রান্তি তুলে ধরার মাধ্যমে প্রকাশ্যে তারা জনমত গড়ে তুলতে পারছে না। সরকার পদে পদে অসহিষ্ণু ও একরোখা মনোভাব দেখাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘সরকার নির্যাতন করে যেভাবে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে, তাতে দলটি নেতৃত্বের অভাবের আশঙ্কা করছে। এ কারণে সাময়িকভাবে তারা গা ঢাকা দিয়েছে। যুদ্ধকালীন সময়ে শত্রুপক্ষ যেভাবে গোপনে থেকে কর্মসূচি চালিয়ে যায় তারাও তাই করছে।’

মিজানুর রহমান বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের আলোচনার পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। সরকারের কারণেই এই আন্দোলন সহিংস থেকে সহিংসতর হচ্ছে; যা গণতন্ত্রের জন্য, দেশের জন্য অত্যন্ত অশুভ ও অমঙ্গলজনক ইঙ্গিত।’

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব দ্য রিপোর্টকে এ প্রসঙ্গে বলেন, এটি ‘আনসার্টেন’ ঘটনা।

গণতন্ত্রের জন্য এই ভিডিও বার্তা কী ইঙ্গিত বহন করে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র বলে কিছুই নেই।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, দুটি রাজনৈতিক দলের ‘রাজনীতির খেলা’র শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে, এই দুইপক্ষ বাই টার্ম নিজেদেরকে ‘সাংঘর্ষিক’ অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, ক্ষমতার বাইরে থাকলে ‘ঝুঁকি’ আর ক্ষমতায় থাকতে পারলে ‘সুবিধা’- এই দুইয়ের সংমিশ্রণেই রাজনীতি। এটি ক্রমাগত বাড়ছে। এমন এক অবস্থায় রাজনীতিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যাতে মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব হচ্ছে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, দুদিন পরে যখন ক্ষমতার পালাবদল হবে তখন এর পরিণাম হবে আরও ভয়াবহ। কাজেই এই অবস্থা কোনো গণতান্ত্রিক দেশে, কাঠামোতে কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকারকে এই পথ থেকে সরে আসতে হবে, দমন-পীড়ন বন্ধ করতে হবে। বিরোধী দলেরও উচিত হবে, অনমনীয় অবস্থান থেকে সরে এসে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে একটা সামঝোতায় পৌঁছানো। একাজটি করা উভয়পক্ষরই সমান দায়িত্ব।

জাতীয় সমাজতন্ত্রিক দলের (জাসদ) সাধারণ সম্পাদক শরীফ নূরুল আম্বিয়া এ প্রসঙ্গে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সচল রাখার জন্য বিরোধী দলকে ষড়যন্ত্রের পথ থেকে সরে আসা উচিত। সেক্ষেত্রে সরকারের যদি কোনো দুর্বলতা থাকে তবে তাও প্রকাশ করা উচিত। আত্মগোপন করে বাংলাদেশে কখনও কেউ জনগণের রাজনীতি করতে পারেনি। এর ফল কখনও ভালো হয়নি।

তিনি বিরোধী দলকে ‘আত্মগোপন’ থেকে প্রকাশ্যে আসার আহবান জানান।

একই প্রশ্নের জবাবে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না দ্য রিপোর্টকে বলেন, বিএনপিকে যদি রাজনীতি করার সুযোগ না দেওয়া হয় তাহলে তারা কী করবে? একজন যুগ্ম-মহাসচিবকে ধরে নিয়ে গেছে, আরেকজনকে বাসায়ও সংবাদ সম্মেলন করতে দেওয়া হচ্ছে না। নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিনেই বাড়ি পর্যন্ত সহিংসতা চলে গেছে।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আমরা সহিংসতাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি? আমি উভয় নেত্রীর কাছে বলতে চাই, প্লিজ স্টপ। তা না হলে এই আগুনে আপনারা দুজনই পুড়বেন।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘অন্তরাল থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া একটি পুরনো বিষয়। যেহেতু বাইরে আসলে বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেফতার হতে হচ্ছে, সেহেতু তারা অন্তরালে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এটা দেখে আমি খুব বেশি অবাক হচ্ছি না। তবে শংকার কারণ হচ্ছে, রাজনীতি ভয়াবহ এক নৈরাজ্যের দিকে যাচ্ছে। এর নিয়ন্ত্রণ কিভাবে হবে, আমরা জানি না। এই পরিস্থিতি আঞ্চলিক পর্যায়ে, তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি বিরোধী দল কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, সেটা আমারও ঠিক জানা নেই।

তিনি অভিযোগ করে আরও বলেন, সরকার বিষয়টি আরও ভয়াবহতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য আরও বেশি আতঙ্কজনক।

(দিরিপোর্ট/এইউএ/এমএআর/এইচএসএম/ডিসেম্বর ০২, ২০১৩)