‘নৃশংস প্রাণসংহার ও ধ্বংসযজ্ঞের মূল হোতা আওয়ামী সন্ত্রাসীরা’
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চলমান সরকার বিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষের ওপর নৃসংস হামলা ও হতাহতের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, বিরোধী দলের আন্দোলনের কর্মসূচির পাশাপাশি চলমান অন্তর্ঘাত ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ এবং গার্মেন্টস শিল্প ধ্বংসের উদ্দেশে ধ্বংসাত্মক তৎপরতার প্যাটার্নের সঙ্গে আগেকার আওয়ামী সন্ত্রাস হুবহু মিলে যায়। সকলের কাছেই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, নৃশংস এসব প্রাণসংহার ও ধ্বংসযজ্ঞের মূল হোতাও আওয়ামী সন্ত্রাসীরাই।
চলমান আন্দোলনে সাধারণ মানুষের ওপর হামলা, এসব ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকার পক্ষের বক্তব্যর প্রেক্ষিতে সোমবার রাতে দীর্ঘ এক বিবৃতিতে বিএনপি চেয়ারপারসন এসব কথা বলেন।
বিবৃবিতে খালেদা জিয়া বলেন, আমি বিস্মিত, হতবাক, ক্ষুদ্ধ ও বেদনাহত। তিনি বলেন, চরম আক্রমণাত্মক স্বৈরশাসনের কবল থেকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা করতে এবং প্রহসনের একতরফা নির্বাচন আয়োজনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে, একই সঙ্গে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতির দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক দল, পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠন যখন আন্দোলন গড়ে তুলেছে সেই আন্দোলনের পাশাপাশি অজ্ঞাত-পরিচয় দুর্বৃত্তরা নিরীহ নিরপরাধ সাধারণ মানুষের ওপর পৈশাচিক হামলা চালিয়ে তাদের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। যাত্রীবাহী যানবাহনে বোমা মেরে, আগুন দিয়ে নাগরিকদের জীবন্ত দগ্ধ করছে। বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা শিকার হচ্ছে এই জঘন্য হামলার। অগ্নিদগ্ধ মানুষেরা হাসপাতালে তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তাদের করুণ আর্তনাদ আমাদের জননিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্ষমাহীন ব্যর্থতাই প্রকটভাবে ফুটিয়ে তুলছে।
খালেদা জিয়া বলেন, এইসব বর্বর হামলা ও নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের আমি তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। পরিকল্পিত নাশকতায় যারা জীবন দিয়েছেন তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের প্রতি জানাচ্ছি গভীর সহানুভুতি ও সমবেদনা। তিনি বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে আইন-শৃংখলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানের ভেতরে এইসব নারকীয় হামলার ঘটনায় দেশবাসীর সঙ্গে আমিও প্রবলভাবে বিস্মিত। এমন বিভৎস ঘটনা ঘটিয়ে অপরাধীরা নিরাপদে পার পেয়ে যাওয়া এবং এ পর্যন্ত ঘটনাস্থল থেকে একজনও গ্রেফতার না হবার রহস্য কারো কাছে বোধগম্য নয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতায় থাকার উদগ্র বাসনায় বিরোধী দল ও জনগণের আন্দোলন দমন এবং কেবল নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যাতিব্যস্ত সরকার আজ জনগণের জীবনের নিরাপত্তাটুকু দিতেও যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, তাতে কারো কোনো সন্দেহ নেই। তিনি বলেন, আমি বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দল, পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠনসহ আন্দোলনরত প্রতিটি নেতাকর্মীর প্রতি আবারো আহ্বান জানাচ্ছি, দেশের কোথাও যেন নিরাপরাধ সাধারণ মানুষের ওপর হামলা না হয়। কোথাও যেন তাদের সম্পদ নষ্ট করা না হয়।
খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের নেতাকর্মীরা আন্দোলনে নেমে প্রতিদিন পুলিশ-র্যাব-বিজিবি ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে জীবন দিচ্ছেন। দেশের শান্তিপ্রিয় নিরাপরাধ নাগরিকগণ আমাদের প্রতিপক্ষ নন। আমাদের আন্দোলন দেশ বাঁচাতে, মানুষ বাঁচাতে। আমাদের আন্দোলন সাধারণ মানুষের প্রাণসংহার বা তাদের ব্যক্তিগত সম্পদহানির জন্য নয়। তিনি বলেন, আমরা গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, সরকারী দল ও প্রধানমন্ত্রী নিজে এই ঘৃণ্য কার্যকলাপকে পুঁজি করে সংকীর্ণ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে নানামুখী অপপ্রচার শুরু করেছেন। সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান এবং দুর্বৃত্তদের নিরোধ কিংবা ঘটনাস্থল থেকে কোনো অপরাধীকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়ে তারা কোনো রকম তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই বিরোধী দলকে দায়ী করে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। এ মিথ্যা অজুহাতে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আরো নৃশংস দমননীতি চালাবার প্রকাশ্য ঘোষণা তারা দিচ্ছেন। অথচ বিএনপির পক্ষ থেকে এসবের জবাব দেয়ার সব পথ তারা বন্ধ করে দিয়েছে।
বিএনপি প্রধান বলেন, দলের পক্ষে কথা বলার জন্য যাকেই দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে তাকেই মিথ্যা অভিযোগে মামলা দিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। বিএনপির সদর দফতরে হামলা করে যে-পন্থায় মধ্যরাতের পর যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদকে গ্রেফতার এবং অফিসে ভাংচুর ও লুন্ঠন করা হয়েছে তা হানাদার বাহিনীর আক্রমণের কথাই মনে করিয়ে দেয় বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে।
তিনি বলেন, এরপর আরেক যুগ্ম-মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে দলের পক্ষে কথা বলার দায়িত্ব দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার গ্রামের বাড়ি ও ঢাকার বাসায় পুলিশ তল্লাশি চালায়। মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ ও গোয়েন্দা লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। সালাহউদ্দিন আত্মগোপনে থেকে দলের বক্তব্য নানা রকম ঘুরপথে প্রচারের জন্য এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, আমি বিরোধী দলের নেতা। অথচ গুলশানে আমার অফিসের স্বাভাবিক কার্যক্রম পর্যন্ত পুলিশ ও গোয়েন্দাদের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য তৎপরতার কারণে চলতে পারছে না। আমার বিশেষ সহকারীকে আটক রাখা হয়েছে। অন্যরাও স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারছে না।
তিনি বলেন, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন ও সরকারের সমালোচনার দায়ে অনেকগুলো প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র বন্ধ রেখে রাষ্ট্রীয় প্রচার-মাধ্যম ও শাসক দলের সমর্থনপুষ্ট কিছু গণমাধ্যমকে দিয়েও আজ বিরোধী দলের বিরুদ্ধে একতরফা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। ভিন্নমত দমনের মাধ্যমে দেশে ভারসাম্যহীন এক অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে।
বিভিন্ন স্থানে অন্তর্ঘাত, সন্ত্রাস ও নাশকতার ঘটনা নিরোধে ব্যর্থ সরকার ঘটনাস্থল থেকে অপরাধীদের আটক করতে না পারলেও বিনা তথ্য-প্রমাণে বিএনপি-র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ১৮ দলের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সকল নেতাকে হুকুমের আসামী করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। অনেকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছেন। অনেকে আত্মগোপন করে আছেন। পুলিশ ও গোয়েন্দারা তাদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
একদিকে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের মিথ্যা অভিযোগে মামলা হচ্ছে, অপর দিকে এক মন্ত্রী বলেছেন যে, সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেললে তাদের ছেড়ে দেয়া হবে। এসব থেকে পরিস্কার হয় যে, বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে মামলা করে তাদেরকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
নাশকতার ঘটনায় অপরাধীদের গ্রেফতার বা শনাক্ত না করে সঙ্গে সঙ্গে বিনা তথ্য-প্রমাণে বিরোধী দলের নেতাদের হুকুমের আসামী করে যেভাবে মামলা হচ্ছে তাতে এটাও সুস্পষ্ট যে, মামলা দায়ের, বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেফতার, আন্দোলন দমন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জনমতকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশে সুপরিকল্পিতভাবে এইসব নৃশংস তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, দেশবাসী দেখতে পাচ্ছেন, শাসকদলের লোকজন বিভিন্ন জায়গায় সশস্ত্র মহড়া দিচ্ছে। আন্দোলনরত বিরোধী দলের নেতা-কর্মী, জনসাধারণ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উপর হামলা করছে। এমন কি প্রহসনের নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়ায় তারা হরতাল, অবরোধ, ভাংচুর, বোমাবাজি ও অগ্নিসংযোগ করছে। অথচ তাদের কারো বিরুদ্ধেই কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
বিরোধী নেতা বলেন, এর আগে প্রধানমন্ত্রীর নিকটত্মীয়, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিমের জবানবন্দী থেকে দেশবাসী জেনেছেন যে, দলীয় সভানেত্রীর জ্ঞাতসারেই তার দলের যুবনেতারা যাত্রীবাহী বাসে গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে মারার পৈশাচিক কার্যকলাপে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ নেতাদের জবানবন্দী থেকে দেশবাসী আরো জেনেছেন যে, গার্মেন্টস শিল্পে পরিকল্পিত নাশকতার সঙ্গেও তারাই জড়িত ছিলেন। সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্ত ওই সব নেতারা নানাভাবে পুরষ্কৃত হয়েছেন। তাদের কেউ কেউ মন্ত্রিসভায় ছিলেন। একতরফা প্রহসনের নির্বাচনে তাদেরকে আওয়ামী লীগ মনোনয়নও দিয়েছে।
বিভিন্ন বন্ধুদেশ ও জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেশের চলমান পরিস্থিতিতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। দেশবাসী প্রচন্ড আতঙ্কিত। কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশে এ ধরনের ঘৃণ্য কার্যকলাপ ও অনিশ্চিত পরিস্থিতি চলতে পারেনা। অথচ সরকার সম্পূর্ণ নির্বিকার। তারা পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ এবং এখানো এ নিয়ে সংকীর্ণ রাজনীতি ও প্রচার চালিয়ে ফায়দা হাসিলের অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে।
খালেদা জিয়া আরও বলেন, আমি তাদেরকে বলবো, যে-ভাবেই হোক আপনার এখনো ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে রয়েছেন। উৎপীড়ন ও নির্মূল অভিযান ছেড়ে এখনো সমঝোতার পথে আসুন। চক্রান্ত ও অন্তর্ঘাতের পথ পরিত্যাগ করে শান্তি ফিরিয়ে আনুন। নিজেরা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় থেকে বিরোধী দলকে তাড়া করে ফিরছেন। আইন-শৃখলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় দলীয় সন্ত্রাসীদের সশস্ত্র অবস্থায় রাজপথে নামিয়ে, আমাদের অফিস অবরুদ্ধ করে রেখে বিরোধীদলকে মাঠে নামার আহবান জানাচ্ছেন। আর দাবি করছেন, দেশে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের পরিবেশ রয়েছে, এটা কেউ মেনে নেবে না। প্রশাসন ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আমার আহ্বান, আপনারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করুন। জনগণের প্রতিপক্ষে অবস্থান নেবেন না।
খালেদা জিয়া বলেন, নির্বাচন কমিশনকে বলবো, প্রহসনের একতরফা নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়ে বিশেষ দলের ক্রিড়নক হিসেবে ব্যবহৃত না হয়ে ঘোষিত তফসিল স্থগিত করে দেশকে বাঁচান। প্রহসনের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জড়িত না হবার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করছি। আমি গত পাঁচ বছর ধরে উৎপীড়িত ও ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনে চালিয়ে যাবার আহ্বান জানাচ্ছি। জনগণের ন্যায়সংগত আন্দোলন কখনো ব্যর্থ হয়নি। ইনশাআল্লাহ্ বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত ও অতি নিকটবর্তী।
(দ্য রিপোর্ট/টিএস-এমএইচ/ এমডি/ডিসেম্বর ০২, ২০১৩)