পুস্তক প্রকাশনা শিল্পে ধসের আশংকা
লুৎফর রহমান সোহাগ, দ্য রিপোর্ট : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় পুস্তক প্রকাশনা শিল্পে ধ্বসের আশংকা দেখা দিয়েছে।
হরতাল-অবরোধে নিউজপ্রিন্ট, কেমিক্যালসহ বই প্রকাশের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো ঢাকায় না আসায় ব্যাহত হচ্ছে নতুন বই মুদ্রণ। আবার মুদ্রিত বইও ঢাকার বাইরে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের অনেকে ধ্বসের আশংকায় বই প্রকাশ থেকে বিরত থাকছেন।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, পুস্তক প্রকাশনার প্রাণকেন্দ্র বাংলাবাজারে অলস সময় কাটাচ্ছেন অধিকাংশ শ্রমিক। অথচ এ সময়টাতেই ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা, একুশে বইমেলা ও নতুন বছরের একাডেমিক বই তৈরির জন্য ব্যস্ত থাকার কথা ছিল তাদের। এমতাবস্থায় পুস্তক প্রকাশনার সঙ্গে জড়িতরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির আশংকায় আছেন। পাশাপাশি নতুন বছরের শুরুতে বই হাতে পাওয়ার ব্যাপারেও শঙ্কা প্রকাশ করেছে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা।
বাংলাবাজার এলাকার বিভিন্ন লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখা যায়, আশংকাজনক হারে কমে গেছে বইয়ের ক্রেতা। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কেউ বই কিনতে আসছেন না বলে জানিয়েছেন ঢাকা টাউন লাইব্রেরির মালিক নিরুপ ও কলেজ লাইব্রেরির মালিক জসিম উদ্দীন।
কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে। তারা আগামি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন।
রাজনৈতিক পরিবেশ স্বাভাবিক না হলে দেশের প্রকাশনা শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়বে জানিয়ে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পরিচালক ও পুঁথিনিলয় এর কর্নধার শ্যামল পাল দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ঢাকার বাইরে থেকে কাঁচামাল আসা এবং তা প্রস্তুত হয়ে ঢাকার বাইরে যাওয়া পুরোটাই একটা প্রক্রিয়া। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক পরিবেশে সেই প্রক্রিয়াটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ধারা চলতে থাকলে ভবিষৎতে বই প্রকাশই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। অন্য শিল্পের সঙ্গে প্রকাশনা শিল্পের ব্যবধান অনেক। এখানে ইচ্ছা করলেই সহজে ক্ষতিটা পুষিয়ে নেওয়া যায় না।
রাজনৈতিক অস্থিরতায় একাডেমিক বই প্রকাশে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পরবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি ও জুপিটার পাবলিশার্সের কর্ণধার কায়সার-ই-আলম প্রধান।
ইতোমধ্যেই অধিকাংশ শ্রমিক বেকার হয়ে পরেছে জানিয়ে দ্য রিপোর্টকে তিনি বলেন, আগামি শিক্ষাবর্ষে প্রকাশক, বিক্রেতা, শ্রমিক ও শিক্ষার্থীদের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা পুরো প্রক্রিয়ার জন্যই বড় আঘাত।
হরতাল-অবরোধে একাডেমিক বইয়ের পাশাপাশি সৃজনশীল (সাহিত্য-সংস্কৃতি সংক্রান্ত) বইয়ের বাজারেও মন্দা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ সৃজনশীল প্রকাশনা সমিতির পরিচালক ও মাওলা ব্রাদার্সের কর্ণধার আহম্মেদ মাহমুদুল হক দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ডিসেম্বরে প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি থাকে। এসময় শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল বই পড়ে। এছাড়া একুশে বইমেলায় সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল বই বিক্রি হয়। কিন্তু রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে সৃজনশীল বই প্রকাশ কঠিন হয়ে পড়বে।
এদিকে চলতি মাসের ১৬ ডিসেম্বর শুরু হচ্ছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা। আগামি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হবে একুশে বইমেলা। এ দুটি বইমেলাকে কেন্দ্র করেই মূলত বই প্রকাশের হিসাব কষে দেশের সিংহভাগ প্রকাশক। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতায় বইমেলায় ক্রেতার সংখ্যা কমে যেতে পারে বলে আশংকায় আছেন অধিকাংশ সৃজনশীল প্রকাশক। ফলে এবার মেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশের পরিমাণও কমছে উল্লেখযোগ্য হারে।
ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলায় বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাজে প্রভাব পড়তে পারে বলে দ্য রিপোর্টকে জানিয়েছেন মেলা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও অন্বেষা প্রকাশনীর কর্ণধার শাহাদত হোসেন।
চলমান অস্থিরতা সৃজনশীল প্রকাশনায় দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের গভর্নিং বডির সদস্য ও পল্লল প্রকাশনীর কর্ণধার খান মাহবুব।
রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে ইতোমধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ ক্রেতা কমে গেছে জানিয়ে দ্য রিপোর্টকে তিনি বলেন, ‘পাঠ্যবই পড়তে পাঠককে বাধ্য করা হয়। কিন্তু মনে সুখ থাকলেই মানুষ সৃজনশীল বই পড়বে। রাজনৈতিক সংঘাতে মানুষের মনে এখন আর সুখ নেই।’
এই অস্বস্তি সৃজনশীল প্রকাশনায় দীর্ঘমেয়াদি বাজে প্রভাব ফেলবে বলে জানিয়েছেন তিনি। ফলে প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আলমগীর শিকদার লোটন।
(দ্য রিপোর্ট/এলআরএস/এমসি/ডিসেম্বর ০৩, ২০১৩)