রেলের নিরাপত্তা ব্যবস্থাই নাজুক
মীর হোসেন, দ্য রিপোর্ট : রেলের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে দুই মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা দুই বাহিনী। এদের দায়িত্ব এক হলেও সমন্বয়হীনতা প্রকট। যেকোনো ঘটনায় পরস্পরের কাঁধে দায় চাপানোর প্রবণতাও রয়েছে তাদের।
জানা গেছে, দুটি বাহিনীতেই লোকবল সংকট তীব্র। বাহিনী দুটির একটি হলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন গভর্নমেন্ট রেলওয়ে পুলিশ বা জিআরপি। অন্যটি হলো রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীন রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী বা আরএনবি। আরএনবির দায়িত্বের পরিধি ও অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতা জিআরপির চেয়ে কম। দুই বাহিনীর গড়ে সাতজন কর্মী একেকটি রেলস্টেশনের পাহারায় থাকে। দেশের প্রধান রেলস্টেশন কমলাপুরে দায়িত্ব পালন করে মাত্র ১৫ জন। প্রতিটি যাত্রীবাহী ট্রেনে জিআরপি সদস্য থাকেন দুজন। প্রয়োজনমাফিক আরএনবি সদস্যও থাকেন।
সম্প্রতি রেল স্টেশন ও রেলপথে অপরাধ এবং নাশকতার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দ্য রিপোর্টের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রেল স্টেশনগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করতে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) নেই। যাত্রী ও মালপত্র স্ক্যানিংয়ের ব্যবস্থা নেই। ট্রেন, রেললাইন ও স্টেশনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এবং পানির পর্যাপ্ত জোগান নেই এবং রেলপথে নিবিড় পাহারার জন্য প্রয়োজনীয়-সংখ্যক ওয়েম্যান (গ্যাংক) নেই। এ ধরনের আরো অনেক সমস্যা নিয়ে চলছে রেলের নিরাপত্তা কার্যক্রম।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। তবে সমস্যার মূলে না গেলে দেশের ৪৪৪টি স্টেশন ও দুই হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার রেলপথ অরক্ষিতই থেকে যাবে বলে তাঁরা মনে করেন।
রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দুটি বাহিনী দুই মন্ত্রণালয়ের অধীনে হলেও কাজে তেমন সমস্যা নেই। আমাদের জনবলের সীমাবদ্ধতা আছে, সমস্যা নয়। এ জনবল নিয়েই নিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে আরো বেশি কার্যকর করতে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে।’
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে রেলপথে দুই শতাধিক নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েও নাশকতা এড়াতে পারেনি। কমলাপুর ও চট্টগ্রাম স্টেশনে অগ্নিসংযোগ, হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। রেলপথ উপড়ে ফেলার ঘটনা ঘটছে প্রতিদিনই। সহিংসতার ভয়ে গানম্যান (সশস্ত্র পুলিশ) পাহারায় ট্রেন চালানোর ব্যবস্থাও করা হয়। জারি করা হয় রেড এলার্ট।
জিআরপি ও ভুক্তভোগীদের তথ্যমতে, রেলপথে ছিনতাইকারী, পকেটমার, টানা পার্টি, ডাকাত, অজ্ঞান পার্টি, মাদক বাণিজ্য, কৃষ্ণমালা পার্টি প্রভৃতি ৮২টি অপরাধী গ্রুপের তৎপরতা বেড়েছে। প্রতিবছর রেললাইনের পাশ থেকে তিন শতাধিক লাশ উদ্ধার করা হয়। যাদের অনেকেরই পরিচয় শনাক্ত করা যায় না। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর যথাযথ তদন্ত হচ্ছে না।
স্টেশনের নিরাপত্তা নাজুক : সরেজমিনে কমলাপুর রেল স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, আরএনবি কর্মকর্তারা রেলের পণ্য পরিবহন এবং জিআরপি পুলিশ রুটিন কাজে ব্যস্ত থাকছে। ঈদ মৌসুমে যাত্রীদের টিকিট লাইনে কিছু বেশি কর্মী নিয়োগ করা হলেও সেখানে প্রয়োজনের তুলনায় কম কর্মী দায়িত্ব পালন করছেন। কমলাপুরে ১৬টি পয়েন্টে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এ ক্যামেরা মনিটরিং হচ্ছে স্টেশনের ব্যবস্থাপকের কক্ষ থেকে। একটি মনিটর আছে কমলাপুর জিআরপি থানায়। জানা গেছে, ১৫টি পয়েন্টের চিত্র এ ক্যামেরায় ধারণ করা হলেও তা রেকর্ড করা হয় না।
এ ছাড়া টিকিট কাউন্টার, পণ্য খালাসের স্থানসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো এ ক্যামেরার বাইরে। কমলাপুর জিআরপি থানার ওসি আব্দুল মজিদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সিসিটিভি ক্যামেরায় কাভার করে না বলেই আমরা গত ৫ অক্টোবর ইস্রাফিল হত্যার কোনো আলামত সেখান থেকে পাইনি।’ স্টেশনের ব্যবস্থাপক খায়রুল বশার বলেন, ‘১৬টি স্থানে এ ক্যামেরা বসানো হয়েছে। সীমাবদ্ধতার কারণে সব স্থানে দেওয়া যায়নি।’
দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি কমলাপুরে হামলা ও ট্রেনে আগুনের ঘটনার পর সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা চালু করা হয়। তবে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও সিলেটে ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা থাকলেও তা অকার্যকর।
দুই বাহিনীর রশি টানাটানি : জানা গেছে, স্টেশনে ও ট্রেনে নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে আরএনবি ও জিআরপি পুলিশের রশি টানাটানি চলছে। পুলিশ প্রবিধানের অষ্টম অধ্যায়ে রেলওয়ে পুলিশের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েই এ মতভেদ। টার্মিনালের পণ্যবাহী ট্রেন ও স্টেশনের নিরাপত্তায় ঢিলেঢালা অবস্থান করলেও কোনো অপরাধে ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয় আরএনবি। একই ট্রেনের যাত্রীবাহী বগিতে জিআরপি এবং মালবাহী বগিতে আরএনবি থাকে। কিন্তু চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই বা অন্য কোনো অঘটন ঘটলে তারা পরস্পরের ওপর দায় চাপায়। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জিআরপির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিধিমালা অনুযায়ী আরএনবির অনেক দায়িত্ব। কিন্তু তারা জিআরপির ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা বাঁচতে চায়। আবার আরএনবির কয়েকজন কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, জিআরপি অপরাধ-সংক্রান্ত ব্যাপারে আরএনবিকে কাজ করতে দেয় না। সম্প্রতি নাশকতা-সংক্রান্ত গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে।
লোকবল সংকট : রেলের ৪৪৪টি স্টেশনের জন্য জিআরপি সদস্য আছে এক হাজার ৪৪৯ জন। আরএনবি সদস্য আছে দুই হাজার ২৯০ জন। প্রতিটি আন্তনগর যাত্রীবাহী ট্রেনের ৮০০ থেকে ৯০০ যাত্রীর নিরাপত্তায় কাজ করে মাত্র দুই থেকে চারজন পুলিশ। মাঝেমধ্যে দুজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে একজন আনসার সদস্য দেওয়া হয়। তাই অপরাধ দমন ও মামলা তদন্তের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক যাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে জিআরপি। ব্রিটিশ আমল থেকে জিআরপি থানার অফিসার ইনচার্জের (ওসি) দায়িত্ব পালন করেন একজন উপ-পরিদর্শক (সাব-ইনস্পেক্টর) পদমর্যাদার কর্মকর্তা। শুধু ঢাকা ও খুলনা জিআরপি থানার ওসি হিসেবে দুজন পরির্দশক (ইন্সপেক্টর) দায়িত্ব পালন করছেন। রেলওয়ের চট্টগ্রাম জোনে জিআরপি থানা ১২টি এবং ফাঁড়ি ১৮টি। প্রতিটি থানায় আছে দুজন সাব-ইন্সপেক্টর ও ২০ জন কনস্টেবল। সৈয়দপুর জিআরপি জোনে থানা ৮টি এবং ফাঁড়ি ১৭টি। জিআরপি থানাগুলোতে দুজন সাব-ইন্সপেক্টরই সব মামলার তদন্ত করেন।
আরএনবিও ভুগছে লোকবল সংকটে। পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চল মিলে এ বাহিনীতে অন্তত ৬০০ জনবল কম আছে। ঢাকা বিভাগই ৭৩ জন কম কর্মী নিয়ে চলছে।
পুলিশের রেলওয়ে রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সোহরাব হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘জনবল সংকট থাকায় প্রতি ট্রেনে পর্যাপ্ত পুলিশ দেওয়া সম্ভব নয়। সীমাবদ্ধতার মধ্যেই রেলওয়ে পুলিশ কাজ করছে। রেলওয়ের গোয়েন্দা ইউনিট আরএসবি ও কাজ করছে। সম্প্রতি অপরাধীচক্রের কিছু সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’
সমস্যার আবর্তে আরএনবি : সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা সমস্যায় ডুবে আছে রেলের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীটি। রেলের সম্পদ পাহারা দেওয়াই এ বাহিনীর প্রধান কাজ। পাশাপাশি রেল স্টেশন, মালবাহী ট্রেন, তেলের গাড়ি, কনটেইনার, কারখানা, স্টোর, রেলের কোচ, ও বুকিং মালামাল পাহারার দায়িত্ব তাদের। ব্যাংকের টাকা স্থানান্তরেও নিরাপত্তা দেয় আরএনবি।
এ ছাড়া উচ্ছেদ অভিযান এবং স্টেশনে টিকিট চেকিংয়ের কাজও করে তারা। কিন্তু এ বাহিনীর আইন প্রয়োগের ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা এবং কার্যপরিধি খুবই সীমিত। পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে দুটি সদর দপ্তরে দুজন চিফ কমান্ড্যান্ট বাহিনীটি চালাচ্ছেন। দুই অঞ্চলের দুটি করে মোট চারটি বিভাগে চারজন কমান্ড্যান্ট আছেন। প্রায়ই একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জটিলতায় পড়তে হয় আরএনবিকে। পুরো বাহিনীর জন্য একজন চিফ কমান্ড্যান্ট নেওয়ার প্রক্রিয়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে লাল ফিতায় আটকে আছে দীর্ঘদিন। আরএনবিকে রেলের নিরাপত্তা বাহিনী বলা হলেও ফৌজদারি ও দণ্ডবিধির অপরাধ তদন্ত করে না তারা।
সূত্র জানায়, দুটি বিভাগে আলাদা প্রসিকিউশন পরিদর্শক আছে। পরিদর্শকরা শুধু রেলের সম্পদ খোয়া গেলে এবং নিজেরা আলামত উদ্ধার করলে আদালতে মামলা করেন। দুয়েকটি মামলা তদন্তও করেন। জরুরি প্রয়োজন মেটাতে আরএনবির রিজার্ভ ফোর্স নেই। ট্যাংক ওয়াগন পাহারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ গোয়েন্দা কার্যক্রম। সব বাহিনীর রেশনিং সুবিধা থাকলেও আরএনবি এ থেকে বঞ্চিত। নেই ঝুঁকি ভাতাও। পোশাকের জন্য এ বাহিনীর সদস্যদের বরাদ্দ বছরে এক হাজার ২০০ টাকা। পরির্দশক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যানবাহন সুবিধা নেই। রয়েছে বেতন বৈষম্য।
আরএনবির কর্মকর্তারা জানান, ২০১১ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে সাবেকি আমলের থ্রি-নট-থ্রি রাইফেলের পরিবর্তে ৭.৬২ এমএম, টি-৫৬ সেমি অটোমেটিক চাইনিজ রাইফেল প্রভৃতি আধুনিক অস্ত্র দেওয়া হয় আরএনবিকে। কিন্তু এসব অস্ত্র ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা আছে। রেলে নাশকতা ও অপরাধ দমনে সব ক্ষেত্রে আরএনবির অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতা নেই। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। বিষয়টি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।
জানা গেছে, আরএনবি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে হওয়ায় পুলিশসহ অন্য বাহিনীগুলো আরএনবিকে অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতা দেওয়ার বিরোধিতা করছে।
আরএনবির চিফ কমান্ড্যান্ট (চট্টগ্রাম-পূর্ব অঞ্চল) ফারুক আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘অনেক সমস্যার মধ্যেও আমরা চেষ্টা করছি ভালো সেবা দেওয়ার। পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করেই আমাদের অনেক কাজ করতে হয়।’
(দ্য রিপোর্ট/এমএইচ/এমসি/এইচএসএম/ডিসেম্বর ০৪, ২০১৩)