এরশাদের নির্বাচন বর্জনের নেপথ্যে
সাগর আনোয়ার, দ্য রিপোর্ট : জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোয় সারাদেশে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নানা কৌতুহল। সবার প্রশ্ন, এরশাদ কি শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারবেন?
মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর এরশাদের খোঁজ না পাওয়া যাওয়ায় এ আশঙ্কা আরো জোরালো হয়েছে। সবারই জানার আগ্রহ এরশাদ কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন।
জাপা সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার সকালে এরশাদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেবেন এটা দলটির মহাসচিব থেকে শুরু করে নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রীরাও জানতেন না। এমনকি এরশাদের সকল বিবৃতি যিনি সংবাদ মাধ্যমে পাঠান সেই প্রেস এন্ড পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সুনীল শুভরায়ও সংবাদ সম্মেলনের আগ-পর্যন্ত কিছু জানতেন না। দ্য রিপোর্টকে একথা বলেছেন সুনীল শুভরায়। এ সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য এরশাদ নিজ হাতে লেখেন। জাপার একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য, এরশাদের উপদেষ্টা ও সম্প্রতি এরশাদের কাছ থেকে দূরে থাকা জাতীয় পার্টি (জাফর-মসীহ) নেতাদের সঙ্গে কথা বলে তার এমন সিদ্ধান্তের নেপথ্য কথা জানা গেছে।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যরা জানান, এরশাদ গত কয়েকদিন ধরেই প্রতিশ্রুতিভঙ্গের যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে এনেছিলেন তার একটিও রাখেননি। কয়েকটি প্রতিশ্রুতির মধ্যে বিশেষ প্রতিশ্রুতি ছিলো মঞ্জু হত্যা মামলা থেকে এরশাদকে খালাস দেওয়া। কিন্তু নভেম্বর মাসের শেষের দিকে মামলাটির রায় না দিয়ে আদালত আগামী বছরের ২১ জানুয়ারি রায়ের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন। এতে এরশাদ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। সাক্ষী ও শুনানির পরও রায়ের তারিখ বার বার পেছানো সরকারের ইচ্ছাতেই হচ্ছে বলে ধারনা এরশাদের।
মঙ্গলবার মঞ্জু হত্যা মামলার বিষয়ে এরশাদ বলেন, ‘জেনারেল মঞ্জু হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে ঘটনার ১৮ বছর পর। কোনো মামলায় যখন আমাকে আটকানো যাচ্ছিল না তখন আমাকে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। মামলা ১৮ বছর ধরে চলছে। ১৩ জন বিচারক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু মামলার রায় হয়নি। আশা করেছিলাম গত মাসে মামলার রায় হবে। কিন্তু মামলার রায় দুই মাস পিছিয়ে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আমাকে ঝুলিয়ে রাখতেই হবে। কোনো সাক্ষীই আমার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি। তারপরও আমাকে ফাঁসির জুজু দেখানো হচ্ছে।’
জানা গেছে, শুধুমাত্র মঞ্জু হত্যা মামলা নয় উচ্চ আদালতে বিচারাধীন জাতীয় পার্টির প্রতীক নিয়ে চলমান মামলার রায় নিয়েও এরশাদকে সরকারের পক্ষ থেকে ভয় দেখানো হয়েছিল।
এ বিষয়ে এরশাদ বলেন, ‘আমি শৃঙ্খলিত রাজনীতিবিদ। আমি কোনো সুবিচার পাইনি। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর আমাকে বন্দি করা হয়েছিল। আমি এখন সরে এসেছি। আমি স্বাধীনভাবে রাজনীতি করতে চাই। আমি মৃত্যু ও জেলের ভয় করি না। কারো কাছে হাত পাতি না। আমি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি।’
এরশাদের প্রেস এন্ড পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সুনীল শুভরায় দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘রবিবার মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়সীমা বৃদ্ধির জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বলেন এরশাদ। সরকারের সবুজ সংকেত পেয়ে জাপার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক সোহেল রানাকে নির্বাচন কমিশনে পাঠান এরশাদ। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সময় বাড়ায় নি। সময় বাড়ালে বিএনপি নির্বাচনে চলে আসতে পারে এমন আশঙ্ক ছিল সরকারের। এজন্যই জাপার দাবি অনুসারে সময় বাড়ানো হয়নি বলে মনে করছেন এরশাদের প্রেস এন্ড পলিটিক্যাল সেক্রেটারি।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা রিন্টু আনোয়ার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমরা অনেকেই বিএনপি নয় বরং আওয়ামী লীগের হামলার আশঙ্কা করেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিনিধির মাধ্যমে লুকিয়ে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছি।’
তিনি বলেন, ‘এরশাদ ব্যক্তিগতভাবে রক্তারক্তি ও খুনাখুনি চান নি। নির্বাচনে অংশ নিলে আমাদের অনেক প্রার্থীর জীবন হারাতে হতো। এজন্য এরশাদ নির্বাচন বর্জন করেছেন।’
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ট এক নেতা জানান, ‘চাঁদপুর-১ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী ডা. শহীদ, লালমনিরহাট-১ আসনের প্রার্থী মজিবুর রহমান, নোয়াখালী-২ আসনের প্রার্থী ক্যাপ্টেন (অব.) রেজাউল করিমকে মনোনয়ন জমা না দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হুমকি দেওয়া হয়। ফলে তারা মনোনয়ন দাখিল করতে না পেরে রাতে এরশাদকে ফোন করেন। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এরশাদের মোবাইলে অনেকে মেসেজের মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেন।’
জাপার এক প্রেসিডিয়াম সদস্যের দাবি, যেখানে জাপাকে নির্বাচনে সহায়তা করার কথা সেখানে বাঁধা দেওয়ার ঘটনা শুনে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন এরশাদ।
জাপার অপর একজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের দাবি, ১৮ নভেম্বর সকালে এরশাদের বাসভবনে সরকারের একজন বিশেষ প্রতিনিধি পাঠানো হয়। প্রতিনিধি বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোটের একাধিক সাংসদ ও নেতা সর্বদলীয় সরকারে অংশ নিচ্ছে বলে এরশাদকে আশ্বস্ত করেন। প্রতিনিধি এরশাদকে বলেন, ‘তিনি অংশ নিলে খালেদা জিয়া অংশ না নিলেও বিএনপির একাংশ দিয়ে নির্বাচন করানো হবে। আর ১৮ দলীয় জোটের মধ্যে দুইজন সাংসদের নাম উল্লেখ করেও প্রতিনিধি জানান, এই দুইজন সর্বদলীয় সরকারে থাকছেন।’
এরশাদ সরকারের সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীর দাবি, মনোনয়নের সময় না বাড়ানো ও ১৮ দলীয় জোট না ভাঙতে পারার কারণেই মূলত সোমবার রাতে প্রতিবেশি একটি দেশ ও বিশেষ বাহিনীর নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাসে নির্বাচন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন এরশাদ।
তিনি বলেন, ‘এরশাদ এখন নিশ্চিত হয়ে গেছেন নির্বাচন হচ্ছে না। তাই তিনি কর্মীদের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ফেলতে চাননি।’
সম্প্রতি এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে সরে আসা জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান কাজী জাফর আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘জনতার ভাষা বুঝতে পারা এবং যদি সত্যিই এরশাদের কথা ঠিক থাকে তাহলে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা প্রশংসনীয়। যে সরকার পাঁচ বছর জাতীয় পার্টিকে কিছুই দেয়নি। সেই সরকারের দালাল হয়ে বাঁচার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়।’
(দ্য রিপোর্ট/সাআ/এইচএসএম/ডিসেম্বর ০৪, ২০১৩)