বেতন বাড়েনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে
বাড়িভাড়া নিয়ে সঙ্কটে সরকারি চাকুরেরা
রানা মুহম্মদ মাসুদ, দ্য রিপোর্ট : শাহরিয়ার হোসাইন (ছদ্ম নাম) সরকারের একজন উপসচিব। গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ে আছেন। জেলা প্রশাসক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। থাকেন সংসদ ভবনের কাছাকাছি মণিপুরী পাড়ায়। তিনি যে ফ্ল্যাটে থাকেন তার ভাড়া ৩০ হাজার টাকা। তার মূল বেতন ২২ হাজার ২৫০ টাকা। মূল বেতন অনুযায়ী তিনি বাড়িভাড়া পান ১১ হাজার ১২৫ টাকা। কেমন করে চলেন?- বিস্মিত জিজ্ঞাসার সামনে তিনি মৃদু হেসে বলেন, বাড়িটা শ্বশুরের বলে রক্ষা। ভাড়া দিতে হয় না।
একটু পরে খানিকটা ইঙ্গিত করে বলেন, নচেৎ অন্য পথ ধরতে হয়তো বাধ্য হতাম। সেই ‘অন্যপথে’র ইঙ্গিতটা সহজে ধরে নেওয়া যায়। শাহরিয়ার শ্বশুরের বদৌলতে সে পথে না গেলেও ঢাকায় বসবাস করা প্রশাসনের নিরুপায় অনেককেই সে পথ থেকে ফেরানো যাচ্ছে না।
শাহরিয়ারের মতো বাড়িভাড়াসহ সুযোগ-সুবিধাগত অপ্রতুলতার কারণে প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাই সঙ্কটে পড়েছেন। হতাশা বাড়ছে। বেসরকারি খাত কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়ে গেলেও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল রেখে মূল বেতন, বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য ভাতাদি বাড়েনি বলে অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর আবাসনের দায়িত্ব সরকারের হলেও নগন্য সংখ্যক চাকরিজীবীর আবাসনের ব্যবস্থা করতে পেরেছে সরকার। প্রশাসনে কর্মরতদের বড় অংশকেই আবাসনের ব্যবস্থা তাদের নিজেদের করতে হচ্ছে। অপ্রতুল বাড়িভাড়া ভাতা বর্তমানে প্রশাসনে দুর্নীতির ব্যাপকতার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে দেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বর্তমানে প্রায় ৭ শতাংশ আবাসন সুবিধা ভোগ করছে। প্রায় ৯৩ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী এই সুবিধার বাইরে রয়েছে। সরকারের দেওয়া বাড়িভাড়া ভাতা নিয়েও সন্তুষ্ট নন তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সচিবালয়ে কর্মরত অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী বাড়িভাড়া ভাতা নিয়ে তাদের অভিযোগের কথা জানান।
জাতীয় বেতন স্কেল ২০০৯ অনুযায়ী সর্বোচ্চ বেতন ধাপ (প্রথম গ্রেড) ৪০ হাজার টাকা (নির্ধারিত) ও সর্বনিম্ন বেতন ধাপ (২০তম গ্রেড) ৪ হাজার ১০০ টাকা করা হয়েছে।
যাদের মূল বেতন ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত তারা ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় বাড়িভাড়া পাবেন মূল বেতনের ৬৫ শতাংশ হারে। আর ঢাকার বাইরে অর্থাৎ নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশালের মেট্রোপলিটন বা পৌর এলাকার জন্য ৫৫ ভাগ হারে, তবে অন্যান্য স্থানের জন্য ৫০ ভাগ হারে। ৫ হাজার ১ টাকা থেকে ১০ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য ৬০ ভাগ, অন্যান্য মেট্রোপলিটন ও পৌর এলাকার জন্য ৫০ ভাগ ও অন্যান্য স্থানের জন্য ৪৫ ভাগ হারে ১০ হাজার ৮০১ টাকা থেকে ২১ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার জন্য ৫৫ ভাগ, অন্যান্য মেট্রোপলিটন ও পৌর এলাকার জন্য ৪৫ ভাগ ও অন্যান্য স্থানের জন্য ৪০ ভাগ হারে, পরবর্তী উপরের ধাপের সব কর্মকর্তার জন্য ৫ ভাগ হারে বাড়িভাড়া কমবে।
এ হার অনুযায়ী একজন সহকারী সচিব ও সমমর্যাদার কর্মকর্তা ঢাকায় বাড়িভাড়া পান ৬ হাজার ৫০০ টাকা (ন্যূনতম হিসেবে), সিনিয়র সহকারী সচিব পান ৮ হাজার ২৫০ টাকা, উপসচিব পান ১০ হাজার ১৭৫ টাকা, যুগ্মসচিব পান ১২ হাজার ৮৭৫ টাকা, অতিরিক্ত সচিব পান ১৬ হাজার ৭৫০। এ ছাড়া একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী পান ২ হাজার ৮০০ টাকা, তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী পান প্রায় সাড়ে ৩ হাজার টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা পান ৪ হাজার ৮০০ টাকা।
এ বাড়িভাড়া ‘বাস্তবতা বিবর্জিত’ বলে অভিযোগ করেছেন অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী। অনেকেই বলছেন ঢাকায় বাড়িভাড়া বেড়ে বেড়ে এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে, এখন ৮ হাজার টাকার নিচে কোনো ফ্ল্যাট পাওয়া যায় না। স্থান ভেদে এ মূল্য লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যায়। ফার্মগেট, তেজগাঁও, শাহজাহানপুর, ওয়ারী, টিকাটুলিসহ কয়েকটি এলাকায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার নিচে কোনো ফ্ল্যাটই পাওয়া যায় না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, একজন সচিব বেতন পান ৪০ হাজার টাকা। তিনি বাড়িভাড়া পান ২০ হাজার টাকা। এ টাকায় তার পক্ষে ধানমন্ডি কিংবা গুলশানে মোটামুটি মানের একটি ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতে পারাও প্রায় অসম্ভব।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী বলেন, ‘সরকার বাসাভাড়া দেয় ২ হাজার ৮০০ টাকা। আমার এক ছেলে এক মেয়ে। এই ভাড়া দিয়ে কোথায় থাকব আমি।’ তিনি ৩ হাজার টাকা খরচ করে মেরাদিয়ার একটি ছোট্ট বাসা নিয়ে থাকেন বলে জানান।
একজন সিনিয়র সহকারী সচিব বলেন, ‘আমার এক মেয়ে কলেজে পড়ে, ছেলে প্রাথমিকে। আমি বাসাভাড়া পাই সাড়ে ৮ হাজার টাকার মতো। এই টাকায় স্বাস্থ্যকরভাবে জীবনযাপন করা যায় মূল শহরের মধ্যে এমন কোনো ফ্ল্যাট পাওয়া যাবে? আমি থাকি টিকাটুলিতে। বাসাভাড়া দিতে হয় ১৫ হাজার টাকা।’
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী বলেন, ‘আমি সাড়ে ৩ হাজার টাকা বাড়িভাড়া পাই। একটু সাশ্রয়ের জন্য কর্মস্থল থেকে অনেক দূরে শ্যামপুর থানার মেরাজনগরে থাকতে হচ্ছে আমাকে। তা-ও ছোট্ট দু’রুমের ফ্ল্যাটের জন্য আমাকে ভাড়া দিতে হয় সাড়ে ৪ হাজার টাকা।’
সরকারি চাকুরেদের আবাসনের দায়িত্বে থাকা আবাসন পরিদফতর বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীর আবাসনের ব্যবস্থাও করতে পারছে না।
আবাসন পরিদফতর সূত্রে জানা গেছে, তারা শুধু ডি-২, ডি-১, ই, ‘এফ’ও সুপিরিয়র টাইপ বাসা বরাদ্দ দেয়। ‘এ’ ‘বি’ ‘সি’ টাইপ বাসা বরাদ্দ দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মিলিয়ে আবাসন পরিদফতরের বিভিন্ন ধরনের মোট বাসার সংখ্যা ১৫ হাজার ৩৬৬টি। এর মধ্যে ঢাকায় ১২ হাজার ৯৯৭ (পরিত্যক্ত ৫৪১টি) ও চট্টগ্রামে পরিত্যক্তসহ ২ হাজার ৩৬৯টি।
আবাসন পরিদফতর কেবল ঢাকা ও চট্টগ্রামে মধ্যে ৫ ধরনের বাসা বরাদ্দ দিয়ে থাকে। মূল বেতন ৯ হাজার ৬০১ টাকা থেকে সর্বোচ্চ পর্যন্ত দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের মধ্যে বাসা বরাদ্দ দেয়।
যাদের মূল বেতন ৯ হাজার ৬০১ টাকা থেকে ১৩ হাজার ৮৯৯ টাকা তারা ডি-২ টাইপ বাসা পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের মধ্যে ১৩ হাজার ৯০০ থেকে ২২ হাজার ৪৪৯ টাকা মূল বেতন পান তাদের মধ্য থেকে ডি-১ টাইপ বাসা দেওয়া হয়। ২২ হাজার ৫০০ থেকে ২৬ হাজার ৭৪৯ টাকা পর্যন্ত মূল বেতনধারীরা ‘ই’ এবং ২৬ হাজার ৭৫০ থেকে ৩২ হাজার ২৯৯ পর্যন্ত ‘এফ’ ও ৩২ হাজার ৩০০ টাকার উপরের মূল বেতনধারীরা ‘সুপিরিয়র টাইপ’ বাসা পেয়ে থাকে।
অনেকেই বলছেন, বাড়িভাড়া বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় অনেক কর্মকর্তাই সততা বজায় রাখতে পারছেন না। তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে বর্তমান প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জীবনাযাপনের রসদ না দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে সততা আশা করা যায় না।’
গত বছরের ২১ এপ্রিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কার্যালয়ে প্রাক-বাজেট আলোচনায় সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক এম এস সেকিল চৌধুরী বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়িভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করে বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ানো হলে অফিসে ঘুষ লেনদেন কমবে, রাস্তায় বস্তা-বস্তা টাকা পাওয়া যাবে না। তখন ব্যবসায়ীরাও সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়তা পাবে। পরোক্ষভাবে দেশের উন্নয়ন হবে।’
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে যে হারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে সে হারে প্রশাসনের চাকরিজীবীদের বেতন বাড়েনি বলে মনে করছেন প্রশাসনের বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব বলেন, ‘১৯৭১-৭২ সালের দিকে প্রশাসনে প্রবেশ করা একজন কর্মকর্তারা মূল বেতন ছিল ৪৫০ টাকা। এ সময় প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম ছিল ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে। মূল বেতনের টাকা দিয়ে ৪ থেকে সাড়ে ৪ ভরি স্বর্ণ কেনা যেত।’
একজন যুগ্মসচিব বলেন, ‘ওই সময় চালের কেজি ছিল ৮ থেকে ১০ আনা। বর্তমানে একজন কর্মকর্তা প্রশাসনে প্রবেশকালে মূল বেতন ১১ হাজার টাকা।’ তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘এখন মূল বেতন দিয়ে কত মন চাল কেনা যায়?’
অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আজ থেকে ৩০-৩৫ বছর আগে টেলিভিশন, ফ্রিজ, মোবাইল ফোনসহ অনেক উপকরণ ব্যবহারের বিষয় ছিল না। এখন জীবনযাপনে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসের দামই কেবল বাড়েনি, নতুন নতুন অনেক জিনিস ব্যবহার করতে হচ্ছে। কিন্তু বেতন নির্ধারণে তার প্রতিফলন নেই।’
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব বলেন, ‘১৯৯৯ সালে আমি অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেই। তখন আমি সিনিয়র সহকারী সচিব। প্রশিক্ষণে একজন ভারতীয় উপসচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। আমরা দু’জনেই ১৯৮৮ সালে চাকরিতে প্রবেশ করি। তিনি ওই সময় উপসচিব হয়ে ৪০ হাজার ভারতীয় রূপি বেতন পান। আমি তখন সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে সাকুল্যে পাই ১৫ হাজার টাকা।’
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন সচিব আবদুস সোবহান সিকদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘প্রশাসনে কমকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খানিকটা কম। সরকার কয়েক বছর আগে পে স্কেল ঘোষণা করেছে। আবার হয়তো করবে। বেতন-ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে সরকারেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।’
সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন, ‘প্রশাসনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রয়োজনের তুলনায় অবশ্যই কম। এ বেতনে চলতে কষ্ট হবে।
এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘সরকার ৩-৪ বছর পর পর পে স্কেল ঘোষণা করে। নতুন পে স্কেল ঘোষণা বাজারের ওপর প্রভাব ফেলে, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। আবার ৩-৪ বছর এভাবে চলে এতে সমস্যা থেকেই যায়। পে স্কেল করার সময় আমাকে ডাকা হলে আমি এ সমস্যার সমাধানে প্রতি বছর মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় সরকারি কমকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সমন্বয়ের সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু তা মানা হয়নি।’
(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/আইজেকে/এস/এইচএসএম/ডিসেম্বর ০৪, ২০১৩)