বিএনপির তৃণমূলে আস্থার সংকট
তারেক সালমান ও মাহমুদুল হাসান, দ্য রিপোর্ট : সরকার বিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তে দলের সিনিয়র নেতাদের আত্মগোপনের কৌশলকে ভাল চোখে দেখছে না বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। নেতাদের এ কৌশলে তাদের মধ্যে হতাশা ও আস্থার অভাব দেখা দিয়েছে।
সাধারণ নেতাকর্মীদের বক্তব্য, বিএনপির এই দুর্যোগ মুহূর্তে যেখানে আমাদের সামনে থেকে সাহস ও ভরসা দেওয়ার কথা মহাসচিবসহ দলের সিনিয়র নেতাদের সেই ক্রান্তিকালে আমরা তাদের কাছে পাচ্ছি না। নেতাদের সঙ্গে ন্যূনতম যোগাযোগও মাঠ পর্যায়ের কোনো নেতাকর্মীর হচ্ছে না।
প্রায় এক মাসের বেশি হয়েছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ অন্য সিনিয়র নেতারাও আত্মগোপনে। এতে তৃণমূল কর্মীবাহিনীর মধ্যে দেখা দিয়েছে আস্থাহীনতা ও হতাশা।
সরকার পতন ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের টানা অবরোধ কর্মসূচি শেষ হল বৃহস্পতিবার। শনিবার থেকে ফের ৭২ ঘণ্টার অবরোধ শুরু হবে।
অবরোধ শুরুর আগে টানা ৮৪ ঘণ্টা হরতাল কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আত্মগোপনে রয়েছেন। ওই হরতালের পর এখন পর্যন্ত সারাদেশে ২১৪ ঘণ্টা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে ১৮ দলীয় জোট।
সিনিয়র কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতারের পরিপ্রেক্ষিতে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নিরাপদ স্থান থেকে দলের নির্দেশনা দিচ্ছেন।
ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের নিরপদ স্থানে চলে যাওয়ার পর সাধারণ কর্মীদের যোগাযোগের একমাত্র ভরসা ছিলেন যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। তাকে শাহবাগ থানায় দায়ের করা বাস পোড়ানো মামলায় গ্রেফতার করার পর অন্য নেতারাও চলে গেছেন তৃণমূলের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
রিজভী গ্রেফতারের পর দলের আরেক যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদকে দলের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব দেন বিএনপির হাইকমান্ড। তিনিও গ্রেফতারের ভয়ে দায়িত্ব পাওয়ার পর এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসেননি। অজ্ঞাত স্থান থেকেই তিনি দলের নতুন কর্মসূচি ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন।
দলটির তৃণমূলের লাখ লাখ নেতাকর্মীর অভিযোগ, আন্দোলনের তুমুল মুহূর্তে দলের সিনিয়র নেতাদের এভাবে মাঠ ছেড়ে ‘পলায়ন’ তাদের মন ভেঙে দিয়েছে। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ নেতাদের আত্মগোপন দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার বন্যা বয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারাও এ নিয়ে রসালো আলোচনা করছেন। সাধারণ নেতাকর্মীদের অভিমত, আন্দোলনের মাঠ থেকে এভাবে পলায়ন না করে নেতাকর্মীদের সামনে থেকে সিনিয়র নেতারা গ্রেফতার হলে আন্দোলন থেমে যাবে না, বরং নেতাকর্মীরা আরও চাঙা হয়ে উঠতো।
তৃণমূল কর্মীরা জানান, সরকারের মেয়াদ শেষ ও একতরফা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলেও সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে ও দলকে সু-সংগঠিত করতে না পারায় এখনও আন্দোলনের সাফল্য ঘরে তুলতে পারছে না বিএনপি। মেয়াদ শেষেও পূর্ণ শক্তি নিয়ে সরকার আছে বহাল তবিয়তে। এটা শুধু বিএনপির সাংগঠনিক ব্যর্থতার কারণেই সম্ভব হচ্ছে।
সাধারণ কর্মীদের অভিযোগ, দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিএনপি এখনও নিজের বিশাল কর্মী বাহিনীকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। এ কারণেই দেশের সাধারণ জনগণের মাঝেও বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে আস্থা তৈরি হয়নি। বরং সৃষ্টি হয়েছে অবিশ্বাস, ক্ষোভ ও হতাশা। এ অবস্থাতেও দলের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে দলের সিনিয়র নেতারা কখনও আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নেননি। যার দায়ভার এখন দলকেই বহন করতে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বিএনপির সিনিয়র নেতাদের পলায়ন মানসিকতার প্রভাব তৃণমূল নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের নেতাদের ওপর পড়েছে। আন্দোলনের শেষ ও চূড়ান্ত সময়েও আগের মতোই কেন্দ্রীয় নেতারা কর্মসূচি সফলে মাঠে নামছেন না। এতে বিভ্রান্ত ও ক্ষুব্ধ হচ্ছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তৃণমূলের এক নেতা বলেন, অবরোধ ডেকেই চুপ শীর্ষ নেতারা। চলে যাচ্ছেন আত্মগোপনে। যোগাযোগের মাধ্যম মোবাইল ফোনও প্রায় রাখছেন বন্ধ। দু’একজন খোলা রাখলেও তা রিসিভ করেন না। তাদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাকর্মীরা ন্যূনতম যোগাযোগও করতে পারছেন না। পাচ্ছেন না কোনো সঠিক দিক নির্দেশনা। মহাসচিবের কাছ থেকেও আসছে না দিকনির্দেশনা। টিভি-পত্রিকায় দেখে জানতে হচ্ছে কর্মসূচির খবরাখবর।
অভিযোগ উঠেছে, এ কর্মসূচির বিষয়ে দলের নিচের সারির তো দূরের কথা, কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতারাও অনেকেই জানছেন না। কর্মসূচি পালনের বিষয়ে তৃণমূল নেতাদের কাছে কোনো নির্দেশনাও যাচ্ছে না কেন্দ্র থেকে।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে জোটের শরিকদের নিয়ে একের পর এক কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। কিন্তু বিচ্ছিন্ন কিছু গাড়িতে আগুন, ভাংচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক ছড়ানো ছাড়া নেতাকর্মীদের মাঠে দেখা যাচ্ছে না। এ কারণেই আন্দোলনে গতি সঞ্চার হচ্ছে না বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতারা।
এদিকে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলকে আন্দোলনের ভ্যানগার্ড বলে বিএনপি দাবি করলেও তাদের কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রদলের এক নেতা দ্য রিপোর্টকে বলেন, শীর্ষ নেতারা নিজেরাও মাঠে নামেন না, আমাদেরও মাঠে নামতে উদ্বুদ্ধ করেন না। যদিও ঢাকার রাজপথ দখলের সব শক্তিই ছাত্রদল-বিএনপির আছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু দ্য রিপোর্টকে বলেন, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা আত্মগোপনে চলে গেছেন, এমনটা নয়। গ্রেফতার এড়িয়ে আড়ালে থাকা আন্দোলনের একটি পন্থা। তিনি বলেন, একের পর এক নেতাকে এরা মিথ্যা মামলায় ধরে জেলে পুরছে। আমাদের স্থায়ী কমিটির প্রবীণ নেতাদের পর দলের মুখপাত্র রিজভীকে তারা দলের কার্যালয় থেকে ধরে নিয়ে গেছে। ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাকেও আটক করেছে। এভাবে নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা পেতে অনেকে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন।
টুকু বলেন, দেখামাত্র পুলিশকে গুলি করার নির্দেশ দিয়ে বর্তমান মেয়াদ উত্তীর্ণ অবৈধ সরকার আন্দোলনকে দমন করতে চাচ্ছে। কিন্তু তারা এসব করে সফল হবে না। কারণ কোনো আন্দোলনই বৃথা যায় না। দেশের জনগণ জেগে উঠেছে। খুব শিগগিরিই গণজোয়ারে এ অবৈধ সরকার ভেসে যেতে বাধ্য হবে।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুল কাদের ভুইয়া জুয়েল কর্মসূচি বাস্তবায়নে সিনিয়র নেতারা মাঠে থাকেন না অভিযোগ অস্বীকার করে দ্য রিপোর্টকে বলেন, বর্তমান অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা রাজপথে আছেন। দেশবাসী জানে জনগণের ন্যায্য দাবিতে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনে মাঠে নামলে ফ্যাসিস্ট সরকারের দলীয় ক্যাডার, অনুগত পুলিশ নির্বিচারে হামলে পড়ে। তারা নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও গুলি চালায়। এ কারণে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আমাদের কিছুটা কৌশলে রাস্তায় নামতে হয়। তবে এটা সাময়িক, অচিরেই লাখো জনতা এই ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করতে রাজপথে নেমে আসবে।
(দ্য রিপোর্ট/টিএস-এমএইচ/এইচএসএম/ডিসেম্বর ০৫, ২০১৩)