ঝিনাইদহ মুক্ত দিবস ৬ ডিসেম্বর
ঝিনাইদহ সংবাদদাতা : ৬ ডিসেম্বর, ঝিনাইদহ মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার মুক্ত হয় ঝিনাইদহ।
১৯৭১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহে প্রথম পাকহানাদার বাহিনী আক্রমণ করে। পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ঝিনাইদহের মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা অসহযোগ আন্দোলন ও প্রতিরোধ সংগ্রামে সর্বস্তরের জনগণকে সংঘবদ্ধ ও সম্পৃক্ত করে। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনীর আক্রমণের খবরে ঝিনাইদহের নেতৃবৃন্দ মহাকুমা পুলিশ সুপার মাহাবুব উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এ সময় থানার অস্ত্রগার খুলে দেওয়া হয়। পুলিশ-আনসারসহ জনতার মাঝে ৪ শতাধিক রাইফেলস ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে ট্রেনিং করানো হয়। আহ্বান জানানো হয় মুক্তি সংগ্রামের।
২৮ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আহমেদুল ইসলাম ছদ্মবেশ নিয়ে ঝিনাইদহে রাতযাপন করেন। পরদিন মহকুমা পুলিশ প্রধান মাহাবুব উদ্দিনের সহয়তায় মেহেরপুর সীমান্ত হয়ে দেশত্যাগ করেন।
১ এপ্রিল ১৯৭১, যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভারী কামান ও মেশিনগানে সজ্জিত হয়ে এক সশস্ত্র কনভয় ঝিনাইদহের বারোবাজার ও কালীগঞ্জ দখল করে মহকুমা শহরের দিকে এগিয়ে আসে। এখানে মুক্তিকামী জনতা পাকবাহিনীকে বাঁধা দেয়। বিষয়খালীর কাছে বেগবর্তী নদীর দক্ষিণ তীরে দুপুর ১টার দিকে উভয়পক্ষে সম্মুখযুদ্ধ হয়। যুদ্ধে নেতৃত্বে দেন এসডিপিও মাহাবুব উদ্দিন। বিষয়খালি যুদ্ধে শহীদ হন দুঃখু মাহামুদ, সদর উদ্দিন, আব্দুল কুদ্দুস, খলিলুর রহমান, গোলাম মোস্তফা, নজির উদ্দিন, এনামুল ও কাজী বদিউল ইসলাম।
এই যুদ্ধের পর ৫ এপ্রিল কুষ্টিয়া থেকে ঝিনাইদহের দিকে প্রায় ৩০ জন পাকসেনা ৩টি জিপে অগ্রগামী হচ্ছে খবর আসে। তখন মহাকুমা সদরের শৈলকূপা থানার গাড়াগঞ্জ কুমার নদের ব্রিজের দুইপাড়ে গর্ত খুঁড়ে পাকা রাস্তার ওপর চাটাই বিছিয়ে আলকাতরা লেপন করে পজিশন নেয় শতশত মুক্তিপাগল জনতা। দ্রুতগতিতে জিপগুলো আসার পথে খাদে পড়ে যায়। হতবিহ্বল সেনারা পালাতে চেষ্টা করেলে জনতা জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে তাদের বেশিরভাগকে ধরে ফেলেন এবং হত্যা করেন।
এখানে ধরা পড়েন লে: আতাউল্যা শাহ। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার আশায় তাকে হত্যা না করে ৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার দায়িত্বপ্রাপ্ত ইপিআর মেজর ওসমানের কাছে পাঠানো হয়। যুদ্ধের এ পর্যায়ে সমন্বয় সাধনের জন্য ঢাকা থেকে আসেন আওয়ামী লীগ নেতা এমএনএ কামরুজ্জামান। বিষখালী যুদ্ধের পর মূলত পাকবাহিনী ঝিনাইদহের ওপর চালায় সাঁড়াশি আক্রমণ।
১৬ এপ্রিল ১৯৭১ পাকবাহিনীর সাড়াশি আক্রমণে ঝিনাইদহের পতন ঘটে। পাকবাহিনী ঝিনাইদহ দখল নেওয়ার পর পাক শাসকদের তৈরি শান্তি কমিটি, আলবদর ও আলশামসে যোগ দেয় সুবিধাবাদীরা। এ সময় ৪ আগস্ট আলফাপুরের যুদ্ধ, ১৪ অক্টোবর আবাইপুর যুদ্ধ, ২৭ নভেম্বর কামান্নার ট্রাজেডিসহ বেশ কয়েকটি গেরিলাযুদ্ধ সংগঠিত হয়। ঝিনাইদহের কামান্নায় ২৭ নভেম্বর পাকহানারা রাজাকারদের সহযোগিতায় অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতা নজরুল ইসলামসহ ২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। ১৪ অক্টোবর আবাইপুরের যুদ্ধে ৪১ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
এদিকে আলফাপুরের যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ২ ক্যাপ্টেন, ৩ সিপাহিসহ ৪ রাজাকার নিহত হয়।
১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের দিকে গেরিলাযুদ্ধ চরম আকার ধারণ করে। অপরদিকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। ফলে যৌথবাহিনীর অভিযানে ৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ঝিনাইদহ স্বাধীন হয়।
ঝিনাইদহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মকবুল হোসেন ও সাবেক কমান্ডার মনোয়ার হোসেন মালিথা জানান, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবমণ্ডিত ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের চেতনায় জাগ্রত থাকুক এবং মুক্তিকামী শহীদদের পবিত্র রক্ত নিয়ে কেউ যেন রাজনীতির মিথ্যা চর্চা না করেন।
(দ্য রিপোর্ট/টিএম/এস/এসবি/ডিসেম্বর ০৬, ২০১৩)