এরশাদই বাংলাদেশের রাজনীতির আসল চরিত্র?
ওয়াহিদ সুজন
বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের পর গণঅভ্যুত্থানের বড় নজির ধরা হয় আশির দশকব্যাপী চলা এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে। হরতাল, অসহযোগ, অবরোধ ও রক্তের বিনিময়ে এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। বলা যায়, বাংলাদেশের জনগণকে নতুনভাবে গণতন্ত্রের চেতনায় উদ্ধুদ্ধ করেছে এই আন্দোলন। সে মোতাবেক আমরা অহরহ বলছি ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ গণতন্ত্রে ফিরেছে। কিন্তু চিন্তা ও কাজের দিক থেকে আমরা কতটা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধারণ করতে পেরেছি।
গণতন্ত্র আদৌ কতটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটা গত ২০ বছর ধরেই প্রশ্নবোধক চিহ্নে আটকে আছে। এটা যে হয়নি তার বড় লক্ষণ নিজের কর্মকাণ্ডে অনুতপ্ত না হওয়া এরশাদ, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার দলের জিইয়ে থাকা। শুধু তাই নয়, তাকে জিইয়ে রাখার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল। তাদেরকে গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার একদিনের শোডাউনে অর্থাৎ ভোটের সুবিধার জন্য এরশাদের হাতে হাত রেখে দাঁড়াতে হয়। এরশাদ সকালে এক কথা, বিকেলে আরেক কথা বলার জন্য নিন্দিত ও হাস্যস্পদ। তার চেয়ে হাস্যকর ধারণা একদিনে ভোট দেওয়ার গণতন্ত্র নয় কি? যেখানে গণতন্ত্র কোনো চিন্তা পদ্ধতি আকারে হাজির নাই, সেখানে তো সব জায়গায় এরশাদতন্ত্র হওয়ারই কথা।
বড় দুটি দলের ক্ষমতায় যাওয়ার আগে ও পরের সময়গুলো মিলিয়ে দেখুন। বুদ্ধিজীবীদের মাঝে গণতন্ত্রের নামে দলবাজির নমুনা দেখলে বোঝা যায় গণতন্ত্রের অবস্থা। এখানে দল-মত নির্বিশেষে জনগণের জন্য কোনো দেশ নেই। বরং দলের জন্য এক নীতি, দলের বাইরের মানুষের জন্য আরেক নীতি। ব্যক্তি ক্ষমতার মাপকাঠি দিয়ে নির্ধারিত হয়। সংবিধানও কাজ করে এক দল ও এক নেতার হয়ে।
এবার দেখা যাক, বর্তমান দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে এরশাদকে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে দিলো। এর আগের পাঁচটি সংসদের মধ্যে চারটিতে এরশাদের সঙ্গে ঐক্য থাকাটা বড় দুটি দলের জন্য দরকারি ছিল। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বরাবরের মতো এরশাদ গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছেন। কেননা, বিএনপিহীন নির্বাচনকে বৈধতা দিতে গেলে এরশাদের জাতীয় পার্টির মতো দলের দরকার আছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রীদের মধ্যে এটা নিয়ে বিশ্লেষকরা নেই। এটাকে তারা স্বাভাবিক ধরে নিয়েছেন। এরশাদের ক্ষমতাকালীন সময়ে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে- এটাও আমরা ভুলিনি। তাই বিষয়টা কিছুটা স্বাভাবিকই। গাঁটছড়া বাঁধলে এরশাদ ঠিক, নয়তো স্বৈরাচার। রাজনীতিবিদ এবং আমরা জনগণের মধ্যে গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের পার্থক্য ইতরবিশেষ মাত্র।
অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে চলতি বছরের ১৮ নভেম্বর নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সেদিন তিনি বলেন, ‘আমি নির্বাচনে যাচ্ছি ক্ষমতায় আসার জন্য, কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য নয়। নির্বাচনে না গেলে মানুষ রাজনীতিকদের ধিক্কার জানাবে।’
এর আগে তিনি বলেছিলেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না। শেষ বয়সে বেইমান হয়ে মরতে চান না। এ মুহূর্তে একদলীয় পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে লোকে তাকে থুথু দেবে।’ ঘটা করে তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারী গেলেন আল্লামা শফীর দোয়া নিতে। এর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে তিনি ভোল পাল্টে নির্বাচনে যাওয়ার কথা বললেন। তার দলের কয়েকজন নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দিলেন। বাজারে শুধু আলোচিত হলো কত টাকা ও কত আসনের প্রতিশ্রুতি মিলেছে।
কিন্তু আবারো কথা পাল্টালেন এরশাদ। ৩ ডিসেম্বর নতুন ঘোষণা এলো। এবার বললেন, ‘আমি তিনবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছি। তবে এবার আমি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে চাই না। আমি বলেছিলাম আগামী নির্বাচনে সবাই না এলে জাতীয় পার্টিও অংশ নেবে না। এখন এ নির্বাচনে সব দল অংশ না নেওয়ায় আমি তা বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ এরশাদ জানান, ‘সকালে এক কথা; আবার বিকেলে অন্য কথা বলার তার যে দোষ রয়েছে, এবার আর তার ব্যত্যয় হবে না।’
এরশাদের এই ঘোষণা বড় দুটি রাজনৈতিক দল, মিডিয়া ও জনগণের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। এখন তো দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা খবরের আশায় সাংবাদিকরা তাকে পাহারা দিয়েই রাখছেন। গণতন্ত্রের চেয়ে স্বৈরাচারের প্রতি আমাদের মুগ্ধতার উদাহরণ এর চেয়ে আর কী হতে পারে!
এরশাদের বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে এরশাদের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণার পরপরই সরকারের মন্ত্রীরা সরব হয়ে উঠেছেন। যেমন ওবায়দুল কাদের বললেন, ‘এটা এরশাদের শেষ কথা নয়’। শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের মতে, ‘সাময়িকভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে কোনো বিশেষ কারণে হয়তো এরশাদ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার এই সিদ্ধান্ত পরে পরিবর্তনও হতে পারে।’
দশম জাতীয় সংসদে এরশাদকে নিয়ে সরকারের তোড়জোড় থেকে এটাই স্পষ্ট যে সরকার যেনতেনভাবে নির্বাচন চায়। গণতন্ত্র থাক মুখের বুলি হিসেবে। মজার সঙ্গে লক্ষ্য করুন সরকার বলছে সংলাপে আসুন। আবার বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ সরকারের দায়িত্বশীলরা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার জন্য বারবার প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। কিন্তু আমরা এটাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছি। কথার মিল না থাকা একা এরশাদের বিষয়! এটাই কী বাংলাদেশের সংস্কৃতি?
বিরোধী দলের দিকে তাকান। তারাও গণতন্ত্রী। গণতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষায় তারা সরকার পদ্ধতি নিয়ে লড়াই করছেন। অথচ জনগণের দোহাই দিলেও সেই তারাই নির্বাচন ছাড়া অন্য দাবিতে মাঠে নামে না। কোনো ধরনের নতুন ধারণা তারা হাজির করতে পারে না। জনগণ হয়তো তাদের চায়। কিন্তু এটা হলো অগতির গতি মাত্র। এরশাদের সর্বশেষ ঘোষণায় তাদের অবস্থানও মজার। সালাহউদ্দিন আহমেদ এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন। অর্থ্যাৎ, স্বৈরাচারী এরশাদের নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া তাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারাও এরশাদকে সঙ্গে রাখতে চায়।
সর্বোপরি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে জনগণের উন্নয়ন, সুশাসন প্রসঙ্গে নানান কথা বলা হয়। কিন্তু একই সময়ে তারা উল্টোটাও করে। তারা নির্বাচনের জন্য জনগণকে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করে বাইরের শক্তির পক্ষে থাকা। এই লাভের হিসেবে নির্ধারিত হয়- কখন কে কী কথা বলবে এবং কোন বিষয়ে চুপ থাকবে। সুতরাং, এরশাদের ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলানো একটা ছোট ঘটনামাত্র। বরং এ রকম ঘটনা-ই বাংলাদেশের রাজনীতির মূল চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের রাজনীতি করলে তো এমনটা হওয়ার কথা না।
লেখক : সাংবাদিক