মতপার্থক্যে খাদের কিনারে বাংলাদেশ
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন করে সহিংসতা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সহিংস ধর্মঘট এবং অবরোধে থমকে গেছে দেশটি। আর এ জন্য খাদের কিনার থেকে দেশকে ফিরিয়ে আনতে জরুরি অবস্থা জারি করা হতে পারে বলে দিন দিন এমন ধারণাই বাড়ছে।
বিবিসি অনলাইনে শুক্রবার প্রকাশিত ‘ইলেকশন ডিভিশনস পুশ বাংলাদেশ টুয়ার্ডস দ্য ব্রিংক’ নামে এক প্রতিবেদনে এমনটিই উল্লেখ করা হয়েছে।
দ্য রিপোর্টের পাঠকদের জন্য পুরো প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো:
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্তর্বর্তী সরকারের পতনের দাবিতে সর্বাত্মক আন্দোলন করছে দেশটির প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
এদিকে ২৪ জানুয়ারি বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সাংবিধানিক প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছে নির্বাচন কমিশন। আর এর ভিত্তিতে আগামী ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখও ঘোষণা করে কমিশন।
২০০৭ সালে একই ধরনের সংকটের সময় দেশটির সেনাবাহিনী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ সময় তারা রাজনৈতিক সংস্কার ও দুর্নীতি দূর করতে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালনা করে।
কিন্তু সেই সরকার রাজনৈতিক সংস্কার ও দুর্নীতি দূর করতে ব্যর্থ হয়। তবে দেশটিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিক শাসন ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয় তারা। ২০০৯ সালের ওই নির্বাচনে মধ্য-বামপন্থি আওয়ামী লীগ বিশাল ব্যবধানে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে।
ভঙ্গুর অর্থনীতি
বিএনপি ও এর প্রধান শরিক জামায়াত একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। তারা বলছে, হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নির্বাচনে কারচুপি করবে।
কিন্তু এই সংকটের জন্য প্রধানমন্ত্রীই দায়ী এবং তার পদত্যাগের মাধ্যমে একটি সমঝোতার পথ তৈরি হবে বিএনপি এমন দাবির পক্ষে এখনও জনসমর্থন রয়েছে।
তবে চলমান আন্দোলনে বিএনপি ও জামায়াত যে কৌশল অবলম্বন করছে তা নিয়ে দিন দিন উদ্বেগ বাড়ছে।
গত ২৫ অক্টোবর থেকে তারা দেশজুড়ে হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করছে। যার ফলে দেশটির অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে অবরোধকারীরা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দিয়েছে। ফলে এক সপ্তাহ ধরে দেশটির রফতানির সবচেয়ে বড় খাত গার্মেন্ট শিল্প মালিকরা তাদের পণ্য পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
বাংলাদেশের অন্যতম একটি গার্মেন্টস মোহাম্মাদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক বলেন, ‘যদি আরও এক মাস এ ধরনের সংকট চলতে থাকে। তাহলে সামগ্রিক অর্থনীতি থমকে যাবে। ফলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ খুব কঠিন হবে।’
ত্রাস সৃষ্টি
বিরোধীদের চলমান আন্দোলনে ঢাকা বা অন্যান্য বড় শহরগুলোতে আগের রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোর মতো গণবিক্ষোভ বা সমাবেশ দেখা যাচ্ছে না। এর পরিবর্তে গণপরিবহনগুলো লক্ষ্য করে অনেক বেশি গেরিলা হামলার ধরন পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর এর মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ যাত্রী এবং চালকদের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ ধরনের হামলাকে একটি বিপদজ্জনক উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সিনিয়র এক বাম নেতা এমএম আকাশ বলেন, ‘অগণতান্ত্রিক ভাষা এখন গণতান্ত্রিক ভাষার জায়গা দখল করে নিয়েছে। ভয়-ভীতি সৃষ্টির জন্য এ ধরনের আন্দোলন করা হচ্ছে।’
গত ২৬ নভেম্বর থেকে বিক্ষোভকারীদের হামলা এবং পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে কমপক্ষে ৪০ জন নিহত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে রেল লাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। এর ফলে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে কমপক্ষে তিনজন নিহত এবং শত শত লোক আহত হয়েছে।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার দলকে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দেওয়ার মতো বিষয়গুলো থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন। তবে দলের অন্য নেতাদের মধ্যে এ বিষয়ে খুব কমই অনুশোচনাবোধ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি
খালেদা জিয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা শমসের মবিন চৌধুরী এ চলমান সংকটকে যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চৌধুরী বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও কি আপনি পরিচ্ছন্ন যুদ্ধ দেখেছেন?’
তিনি বলেন, ‘পশ্চিমারা কি আফগানিস্তানে নিরাপরাধ নারী, পুরুষ এবং শিশুদের হত্যা করছে না?’
শমসের মবিন বলেন, ‘সংকট আরও গভীর হয়েছে কারণ সরকার সাধারণ মানুষের ওপর একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে।’
বাংলাদেশে বিএনপি ছাড়া নির্বাচন হলে পরিস্থিতি খারাপ হবে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো উন্নয়ন সহযোগীরা ইতোমধ্যেই তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা একটি ‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচন’ অনুষ্ঠান করতে দুই দলকে সমঝোতায় পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছে।
১৯৯৬ সালে সাংবিধানিকভাবে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ওই সরকারের কাজ ছিল পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে দেশে সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন করা।
কিন্তু আওয়ামী লীগ বলছে যে, ২০১০ সালে হাইকোর্টের একটি রুলিংয়ের ফলে এখন এই ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। তাই এখন থেকে ক্ষমতাসীন সরকার অন্তর্বর্তী প্রশাসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে যার অধীনে নির্বাচন হবে।
সরকার জনসম্মুখে বারবারই নির্ধারিত দিনে ভোটগ্রহণের ব্যাপারে তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করছে। যার ফলে সহিংসতা আরও ব্যাপকমাত্রার বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
যদিও গোপনে গোপনে সরকার নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের বিষয়টিকে উড়িয়ে দিচ্ছে না। এছাড়া অরাজকতা বন্ধে জরুরি অবস্থা জারির বিষয়টিও তারা ভাবছে।
যদি সরকার আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করে তাহলে নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে যেতে পারে। আর বর্তমানে সংবিধানের ধারা অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন শেখ হাসিনা।
তবে বড় একটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যে, সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব কী এক থাকবে এবং হাসিনার প্রতি তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখবে কিনা। যদি নির্বাচন খুব সহিংস হয় অথবা জরুরি অবস্থা দিয়েও যদি বিক্ষোভ দমানো না যায়, তাহলে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের বিষয়ে সমর্থন বাড়তে পারে।
আশাবাদীরা মনে করছেন, বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও জাতিসংঘ একটি মধ্যস্থতা করতে সমর্থ হবে। আর এর মধ্য দিয়ে জানুয়ারির শেষদিকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের রাস্তা তৈরি হবে।কিন্তু খুব কমসংখ্যক মানুষই এ ধরনের আশা পোষণ করেন।
(দ্য রিপোর্ট/আদসি/এনডিএস/ডিসেম্বর ০৬, ২০১৩)