বিদেশিদের আগ্রহের নেপথ্যে
কূটনৈতিক প্রতিবেদক, দ্য রিপোর্ট : অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিদেশিরা উদ্বিগ্ন। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে পা বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বার্থ নিয়েই বিদেশিরা চিন্তিত। যেকোনো সঙ্কটের সময় হস্তক্ষেপকারীরা বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে তাদের দায়িত্ব পালনের কথা বলেন। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে প্রতিবেশী, বন্ধু রাষ্ট্র, শুভাকাঙ্ক্ষী এসব কথার আড়ালে থাকা বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর কূটনৈতিক তৎপরতার মূল কারণ অর্থনৈতিক স্বার্থ।
এর আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বেশকিছু দেশ তাদের উদ্বেগের কথা প্রকাশ করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয়ে বহির্বিশ্বের আগ্রহের নেপথ্য কারণ কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল বিষয় হলো পারস্পরিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক। অর্থনৈতিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিনিময় হয়। তবে বিদেশি রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে শুধু নেতিবাচকভাবে দেখার কোনো কারণ আমি দেখি না। আমরা যেহেতু নিজেরা নিজেদেরকে সমস্যা সমাধানে যোগ্য করতে পারিনি। অন্যদের দোষ দিয়ে কী লাভ? তাছাড়া অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য সংশ্লিষ্টরা তাদের উদ্বেগের কথা জানাতেই পারেন।’
ড. ইমতিয়াজ আরো বলেন, ‘কৌশলগতভাবে বাংলাদেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অধিষ্ঠিত। এখানে বিশ্ব পরাশক্তিগুলো তাদের প্রভাব বজায় রাখার মাধ্যমে আঞ্চলিক রাজনীতির সূতা হাতে রাখতে চাইবেন। বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে বাংলাদেশের স্বার্থ বাংলাদেশকেই বজায় রাখতে হবে।’
বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে তৎপর হতে দেখা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমেরিকা, ভারত, চীন, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ।
ভারত বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী। বৃহৎ এই রাষ্ট্রের বড় গ্রাহক বাংলাদেশ। ২০১০-১১ অর্থবছরের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশ ভারত থেকে ৪৫৭ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করে। বিপরীতে ভারতীয়রা বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে ৫০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য।
আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ভারতের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের চিত্র এটি। এর বাইরে ভারত থেকে চোরাই পথে ২০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয় বলে অনুমান করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি রফতানির চিত্র ভারতের বিপরীত। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ৪৯০ থেকে ৫০০ কোটি ডলার রফতানি করে। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ আমদানি করে মাত্র ৫০ কোটি ডলার সমমূল্যের পণ্য। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ শুল্ক পেয়ে থাকে। দেশটির স্বাভাবিক শুল্কহার এক শতাংশ হলেও বাংলাদেশি পণ্যের ক্ষেত্রে এই হার ১৫ শতাংশেরও বেশি।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে উচ্চমাত্রার লাভজনক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে। শেভরন, কনোকো ফিলিপসসহ খনিজ সম্পদ আহরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য সৌদি সরকার করে না। কিন্তু বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত এই দেশটি। সৌদি আরবে বর্তমানে কমবেশি ২৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত আছেন। এটি বাংলাদেশের মোট প্রবাসীদের প্রায় এক তৃতীয়াংশ। বিশ্বের আর কোনো দেশে এত সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত নেই। বাংলাদেশের জন্য সৌদি আরব যেমন অনেক বড় শ্রমিক বাজার, একইভাবে অপেক্ষাকৃত কম দামে শ্রমিক নিয়োগ করার সুযোগ পায় সৌদি আরব।
জাতিসংঘ বর্তমান বিশ্ব বাস্ততায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী একটি সংস্থা। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সংখ্যক সেনা সদস্য রয়েছে। ১০ হাজারেরও বেশি সৈন্য রয়েছে শান্তিরক্ষা মিশনে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আয়ের তৃতীয় বৃহত্তম খাত হিসেবে ধরা হয়।
দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এসব রাষ্ট্র ও সংস্থার আগ্রহকে তাই প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচনা করে কেউ ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন। কেউবা সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করেন প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘একটি দেশের সমস্যায় আরেকটি দেশের সহযোগিতার উদ্যোগ সাধারণ আন্তর্জাতিক নর্ম। উদ্যোগ গ্রহণকারী দেশগুলো তাদের নিজেদের স্বার্থও বিবেচনায় নেয়। অনেক ক্ষেত্রে সেই স্বার্থটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। কারণ বাংলাদেশ একটি বিশাল জনসংখ্যার দেশ। প্রচুর ভোক্তা আছে এখানে। এমন বাজার নষ্ট হোক সেটা কেউ চাইবে না।’
ড. দেলোয়ারের মতে, ‘ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, পারস্পরিক সম্পর্ক, আর্ন্তজাতিক প্রভাব-বলয়সহ আরো অনেক বিষয় পাস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে পরিগণিত হয়।’
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। শুক্রবার পাঁচ দিনের সফরে এসেছেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ফার্নান্দেজ তারানকো। কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ সফর করে গিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক নবনিযুক্ত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। আগামী সপ্তাহে আসছেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দফতরের জ্যেষ্ঠ প্রতিমন্ত্রী ব্যারনেস সাঈদা ওয়ার্সি।
(দ্য রিপোর্ট/বিকে/এস/এইচএসএম/ডিসেম্বর ০৬, ২০১৩)