গুণ যেন ঢাকা না পড়ে
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ম্যান্ডেলার মতো নির্ভীক মানুষের এতই গুণ যে তার জন্য অতিশয়োক্তির দরকার পড়ে না। যদি কেউ তা করতে চায়, তবে বুঝতে হবে তারা ম্যান্ডেলার কোনো গুণ লুকাতে চান বা তার কোনো কোনো বিষয়ে অস্বস্থিতে ভুগেন।
নেলসন ম্যান্ডেলা মনে প্রাণে রাজনীতি সক্রিয় ছিলেন। রাজনীতির মর্মশাস কোন ছল-চাতুরীর বিষয় নয়। যাকে ন্যায় মনে করতেন, তাতে দুনিয়ার অন্য কারো সায় আছে কিনা তাতে কোনো আগ্রহ ছিলো না। আপোসহীনতা ছিল তার ন্যায়ের পক্ষে থাকার শক্তি। ব্যক্তি বা কারো কাছে মাথানত করেননি। বরং এক সময় তাকে যারা সন্ত্রাসী বলেছে তাদেরই করতে হয়েছে মাথানত। তারাই আজ তার জন্য স্তুতিবাক্য ছড়াচ্ছে। এমনকি ম্যান্ডেলা যা নয়, তাও হয়ত বলা হচ্ছে।
ম্যান্ডেলা প্রসঙ্গ এলে তার জেলে থাকা আর আফ্রিকার বর্ণবাদের কথা আসে শুধু। অথচ ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক অঙ্গীকার এককেন্দ্রিক ছিল না। তিনি জানতেন এটা শুধু তার দেশের একার সমস্যা নয়, সারাবিশ্বের সমস্যা। একইভাবে জানতেন বর্ণবাদ শুধু একটা রূপের মধ্যে আটকে থাকে না। তার রয়েছে নানান রঙ ও মাত্রা। তাই তার প্রতিবাদ বর্ণবাদের একটা ধরনের মধ্যে আটকে ছিল না। থিংক প্রগেস সাইট অবলম্বনে সে ধরনের কিছু প্রসঙ্গ জানা যাক-
১. তিনি ছিলেন ইরাক যুদ্ধের বিপক্ষে। সে সময় ম্যান্ডেলা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তিনি এমন একজন প্রেসিডেন্ট যার কোনো দূরদর্শিতা নেই। তিনি সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারেন না। বিশ্বকে হত্যাযজ্ঞের মধ্যে ডুবিয়ে দিতে চান। বুশ ইরাকি তেলের জন্য এ সব কিছু করছে।’ তিনি পুঁজিবাদী আমেরিকার ইরাক যুদ্ধকে পৃথিবীর জন্য বড় সমস্যা হিসেবে দেখেছেন। আমেরিকাকে নৃশংস বলে উল্লেখ করেন। তার কথা বিফলে যায়নি, সে যুদ্ধের দায় বিশ্বের মানুষের ওপর বর্তেছে।
২. ম্যান্ডেলার মতে দারিদ্র্যতা দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ সমস্যাগুলোর একটি। তিনি মনে করতেন, দারিদ্র্যতাকে অতিক্রম করা কোনো দাতব্য কাজ নয়, ইনসাফের বিষয়। যা হবে মৌলিক মানবাধিকার, মর্যাদা ও সুন্দর জীবনের জন্য নিরাপত্তা স্বরূপ। যেখানে দারিদ্র্যতা থাকবে, সেখানে সত্যিকারের স্বাধীনতা নেই।
৩. নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে অন্যতম শোক পালনকারী দেশে যুক্তরাষ্ট্র। ইতোমধ্যে জানা গেছে ১৫ ডিসেম্বর তার শেষকৃত্যে যোগ দিতে যাচ্ছেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তার স্ত্রী মিশেল ওবামা এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও তার স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। অথচ ২০০৮ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটনের সন্ত্রাসীদের তালিকায় ম্যান্ডেলার নাম ছিলো। ম্যান্ডেলা ছিলেন জর্জ বুশের ওয়ার অন টেররের (সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ) কড়া সমালোচক। তার মতে, সঠিকভাবে যাচাই বাছাই না করে কারো ওপর সন্ত্রাসীর সিলমোহর দেওয়া যাবে না। এমনকি ওসামা বিন লাদেনের ক্ষেত্রেও। কোনো কিছু করার আগে তার জন্য কাউকে দায়ী করা মৌলিক আইনেরই লঙ্ঘন বটে।
৪. ১৯৯০ সালে নিউইর্য়ক ভ্রমণের সময় ম্যান্ডেলা সেখানকার হার্লেম (মূলত আফ্রিকান-আমেরিকান বংশোদ্ভূতরা এখানে বাস করেন) পরিদর্শন করেন। তিনি বর্ণবৈষম্য ও অর্থনৈতিক অসাম্যের বিরুদ্ধে তাদের লড়ে যাওয়ার প্রশংসা করেন। ইয়াঙ্কি স্টেডিয়ামের বৃহৎ জনসভায় মনে করিয়ে দেন বর্ণবাদ শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার বাস্তবতা নয়। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বিশ শতকের শেষ দশকে চলে এসেছি, এটা মেনে নেওয়া যায় না ও অগ্রহণযোগ্য যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সমাজকে এখনো বর্ণবাদের ক্যান্সার খেয়ে ফেলছে।’
৫. কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও লিবীয় প্রেসিডেন্ট কর্ণেল মুয়াম্মার গাদ্দাফীর নিন্দা না করার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। তারা তাকে অফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সাহায্য যুগিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘পশ্চিমাদের একটা বড় ভুল হলো তারা মনে করে তাদের শত্রু আমাদেরও শত্রু হওয়া উচিত।’ তিনি আমেরিকার টেলিভিশন দর্শকদের মনে করিয়ে দেন, ‘আমাদের নিজেদের একটা সংগ্রাম রয়েছে।’ তিনি ফিলিস্তনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের প্রশংসা করে বলেন, ‘এ কমরেড ইন আর্মস।’
৬. যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে তিনি গিয়েছিলেন ডেট্রয়েট অটো ওয়ার্কার ইউনিয়নের অফিসে। তিনি সেখানকার কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘বোন ও ভাই, বন্ধু ও সাথী যে মানুষটি আপনাদের সামনে কথা বলছে সে কোনো আগন্তুক নয়। যে মানুষটি কথা বলছে সে ইউএডব্লিউ (ইউনাইটেড অটোমোবাইল ওয়ার্কাস) এর একজন সদস্য।’
(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/এস/এমসি/ডিসেম্বর ০৭, ২০১৩)