খান সরওয়ার মুরশিদ
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা খান সরওয়ার মুরশিদ ২০১২ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও উপাচার্য ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন। খান সরওয়ার মুরশিদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে শুরু থেকে জড়িত ছিলেন। এছাড়া সাহিত্য সমালোচক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল।
তিনি ১৯২৪ সালের ১ জুলাই কুমিল্লায় নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আলী আহমদ খান ছিলেন প্রথমে অবিভক্ত বাংলার এবং পরে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য। পরবর্তীতে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তার সম্পাদনায় ‘পূর্ব বাংলা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো।
খান সরওয়ার মুরশিদ নিজ এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রবেশিকা পাস করার পর ফেনী সরকারি কলেজ এবং পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন।
১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক পাসের পর সেখানেই প্রভাষক পদে শিক্ষকতা শুরু করেন। পঞ্চাশের দশকে গবেষণার জন্য ব্রিটেনে পাড়ি জমান তিনি। নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘দ্য ইনফ্লুয়েন্স অফ টেগোর অন দ্য ওয়ার্কস অফ ডব্লিউ বি ইয়েটস, আলদোস হাক্সলি অ্যান্ড টিএস এলিয়ট’ বিষয়ে পিএইচডি করেন। ডিগ্রি অর্জন শেষে দেশে ফিরে আগের কর্মস্থলে যোগ দেন।
১৯৭২ থেকে ৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে আবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। পরের বছর শিক্ষক হিসেবে অবসর নিলেও সংখ্যাতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৫ থেকে ৬৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন খান সরওয়ার মুরশিদ। সে সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের জন্য প্রস্তাবনা ও অবকাঠামো তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেন।
সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার অবদান রয়েছে। ১৯৫১ সালে তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সংস্কৃতি সংসদ’। পাকিস্তান লেখক সংঘের পূর্বাঞ্চলীয় কমিটির সেক্রেটারি জেনারেলও ছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন খান সারওয়ার মুরশিদ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রবল বাধা পেরিয়ে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী পালনে নেতৃত্ব দেন। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হওয়ার পর সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে জাতীয় নেতাদের সঙ্গে তিনিও ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার নীতিনির্ধারক ও পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম তিনি। উনসত্তরের গণআন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিন আহমেদের অন্যতম সহযোগী ছিলেন তিনি। এছাড়া মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের অন্যতম সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন খান সারওয়ার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালে ‘ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ’ গঠন করে বিশ্বের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের দেশে আনেন। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ফরাসি বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মালরোকে আমন্ত্রণ করে তাকে সম্মানজনক ডি লিট প্রদানে মুখ্য ভূমিকা ছিল তার।
১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি কমনওয়েলথের সহকারী মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
তার লেখা প্রবন্ধ সংকলনের নাম ‘কালের কথা’। তিনি নিউ ভ্যালিউজ (১৯৪৯-১৯৬৫) নামে একটি ইংরেজি সাংস্কৃতিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
শিক্ষা ও গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই এসোসিয়েশন তাকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করে। প্রবন্ধ ও গবেষণায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরষ্কার লাভ করেন তিনি। এছাড়া জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক ও কণ্ঠশীলন পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তার উপর আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় একটি সংবর্ধনা-গ্রন্থ প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি।
১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট প্রয়াত শিক্ষক, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ নূরজাহান বেগমের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান তিনি। যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ থেকে দুই বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নূরজাহান। এছাড়া ‘এদেশ একাল’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি। তাদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। একাত্তরে খান সারওয়ার মুরশিদের পুরো পরিবারই কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/এস/জেএম/ডিসেম্বর ০৮, ২০১৩)