নাটকের শেষ দৃশ্য কী?
বাহরাম খান, দ্য রিপোর্ট : নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা পুরনো কথা। নতুনভাবে যোগ হয়েছে নির্বাচনী নাটকীয়তা। এই নাটকের পরিচালক এবং নায়ক সাবেক স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ। দর্শক ষোল কোটি মানুষ। প্রযোজক প্রধান দুই রাজনৈতিক দল।
নির্বাচনী নাটকের সিকোয়েন্স . . .
ডেটলাইন ২১ অক্টোবর : নাটকের সূচনা
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দলীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে গণভবনে সাক্ষাৎ করেন এইচ এম এরশাদ।
বৈঠক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘জাতীয় পার্টি মহাজোটে থাকবে কি থাকবে না তা নির্ভর করবে বিএনপির ওপর। বিএনপি নির্বাচনে এলে জাতীয় পার্টি মহাজোটে থেকে নির্বাচন করবে। আর বিএনপি না এলে তারা মহাজোট থেকে বেরিয়ে আলাদাভাবে নির্বাচন করবে।’
প্রতিক্রিয়ায় এরশাদ পরের দিনই সংবাদ সম্মেলন করে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যের বিরোধিতা করেন। সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘আমি বার বার বলে আসছি, জাতীয় পার্টি কোলাবরেট হয়ে থাকতে চায় না। একতরফা নির্বাচনে অংশ নিয়ে দালাল হয়ে মরতে চাই না। আমরা নিজস্ব সত্ত্বা নিয়ে বেচে থাকতে চাই। কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য আমরা নির্বাচন করব না।’
ডেটলাইন ১১ নভেম্বর : নির্বাচনে গেলে থুতু দেবে
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এরশাদ বলেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে গেলে মানুষ আমাকে থুতু দেবে। এর চেয়ে জেলেই মরে যাওয়া ভালো।’
শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচনে জাতীয় পার্টি যাবে না উল্লেখ করে এরশাদ বলেন, ‘মানুষ জানবে, বুঝবে, আমি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য নির্বাচন করছি। তখন মানুষ বলবে, এরশাদ সাহেব কথা রাখে না না। সম্মান বড় না জেল বড়।’
ডেটলাইন ১৮ নভেম্বর : নির্বাচনে না গেলে থুতু
‘এই সরকারকে সরাতে হলে নির্বাচন দরকার। নির্বাচনে না গেলে মানুষ থুতু দেবে। শুধু আমাকে নয় সব রাজনীতিককেই জনগণ থুতু দেবে।’
এদিন তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে মহাজোট ছাড়েন। এই ঘোষণার ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে ‘সর্বদলীয় সরকার’-এ যোগ দেয় তার দল। একইসঙ্গে বিরোধী দলকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানান তিনি।
ডেটলাইন ৩ ডিসেম্বর : নির্বাচনে যাব না
একক সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমি বলেছিলাম সব দল নির্বাচনে না গেলে আমি যাব না। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরাপদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আমরা নির্বাচনে যাব। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমাকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে হলো। এখন দেশের অনিশ্চিত গন্তব্য কোথায় গিয়ে থামবে তা শুধু সর্বশক্তিমান আল্লাহরই জানা।’
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘তোমরা আমাকে বিদ্রুপ করো, এরশাদ সকালে এক কথা আর বিকেলে আরেক কথা বলে। তোমাদের বুঝতে হবে। আমি না থাকলে দল থাকে না। জেলে গেলে দলের অস্তিত্ব থাকে না। আমাকে অনেক কিছু ভাবতে হয়। একটি শান্ত, সুশীতল, শান্তিময় দেশ গড়ার জন্য শুধু সকাল বিকাল কেন, প্রতি মুহূর্তেও যদি অবস্থান বদলাতে হয়, তাও আমি করতে পারবো।’
ডেটলাইন ৪ ডিসেম্বর : উধাও এরশাদ
একক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন বর্জনের পরপরই উধাও হন এরশাদ। প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর নিজ বাসায় ফেরেন এরশাদ। বৈঠক করেন ভারতের সফরকারী পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের সঙ্গে।
বৈঠক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সরকার থেকে তার দলের মন্ত্রীদের পদত্যাগের আহ্বান জানান।
হতভম্ব নিজ দলের মন্ত্রীরা এরশাদকে বুঝানোর চেষ্টা করেন। সরকারের পক্ষ থেকে পরোক্ষ গ্রেফতার আতঙ্ক তৈরি করা হয়। প্রতিক্রিয়ায় এরশাদ বলেন, ‘গ্রেফতার হলেও ভালো, মানুষ অন্তত থুতু দেবে না।’
এদিন রাতেই গ্রেফতার করা হলে আত্মহত্যার হুমকি দেন এরশাদ। বলেন, ‘র্যাব-পুলিশ আমার গায়ে হাত দেওয়ার আগে আমি মরে যাব। সরকারকে বলেছি, কোনো চালাকি করলে চারটা পিস্তল আছে, আমি সুইসাইড করব। দিস ইজ মাই প্রমিজ।’
এদিন এরশাদ বলেন, ‘আমি আমার জীবনের শেষ প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করব না। সব দল না আসলে আমি নির্বাচনে যাব না, এটা আমার শেষ কথা। নির্বাচনে যাব না, যাব না।’
ডেটলাইন ৫ ডিসেম্বর : নরম হলো গরম কথা
সাবেক এই স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের গরম খবর নরম হতে সময় লাগেনি। তার দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ী পদত্যাগ করেননি তার দলের মন্ত্রীরা।
উল্টো সরকারে থাকা তার দলের একমাত্র উপদেষ্টা ও মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যান দরকষাকষিতে। প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন রওশন এরশাদ, রুহুল আমিন হাওলাদার ও মুজিবুল হক।
দ্বিতীয় দফায় বৈঠক করেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন বাবলু।
এদিন রাত দশটায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এরশাদ জানান তার দলের মন্ত্রীরা তার কাছে পদত্যাগপত্র দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি দেশে আসলে সেগুলো প্রেরণ করা হবে। তিনি আবার মত পাল্টাবেন কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে এরশাদ বলেন, ‘আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এর বাইরে গেলে আমার মৃত্যু ছাড়া উপায় নেই।’
ডেটলাইন ৫ ডিসেম্বর : কথা বলেননি এরশাদ
এদিন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি এরশাদ। সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে বাসার নিচে নামলেও শেষ পর্যন্ত বের হননি তিনি। সাংবাদিকদের কাছে কোনো প্রতিক্রিয়াও জানাননি।
রাষ্ট্রপতি দেশে ফিরলেও আগের দিনের কথা অনুযায়ী পদত্যাগপত্র জমা দেননি এরশাদ।
ডেটলাইন ৬ ডিসেম্বর : নতুন শর্ত
নতুন শর্তে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা বলেন এরশাদ। রাতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, আমার কয়েকজন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নির্বাচনের তফসিল ১০ দিন পেছানো এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের কথা বলেছেন। যদি এটা সম্ভব হয় তাহলে আমরা নির্বাচনে যেতে পারি।
ডেটলাইন ৭ ডিসেম্বর : পদত্যাগের গুজব
জাতীয় পার্টির নতুন উইং কাজী জাফর আহমদ এরশাদের পদত্যাগের খবর চাউর করেন। পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে আজীবন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এরশাদ।
এদিন জাতীয় পার্টির একাধিক শীর্ষ নেতার বাসায় দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ডেটলাইন ৮ ডিসেম্বর : নতুন খবর নেই
এদিন এরশাদকে নিয়ে চমক দেওয়ার মতো কোনো সংবাদ আসেনি।তবে বিদেশি একটি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান বিরোধীদলহীন নির্বাচনে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
শেষ দৃশ্য কী?
নির্বাচনী নাটকে নায়ক এবং পরিচালক একজন। পরবর্তী দৃশ্য কী হবে দ্বিতীয় কারো জানা নেই। নায়কের অভিনয়শৈলী এবং অতীত ইতিহাসের কারণে পরিস্থিতি আন্দাজ করা কঠিন। তবে, ডেটলাইন অনুযায়ী রচিত সিকোয়েন্স এবং অতিসাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আগামী নির্বাচনে এরশাদের অংশগ্রহণের দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। কারণ, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে এরশাদের ঘোষণা নতুন চমক দিয়েছে। কিন্তু ঘোষণা পরবর্তী সময়ের কার্যক্রম এরশাদের দ্বিধান্বিত রাজনীতির রূপকেই প্রকাশ করছে। মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেননি, মনোনয়নপত্র দাখিলকারীদের বেশিরভাগই সেগুলো প্রত্যাহার করেননি। দুই পথ খোলা রেখে চলা এরশাদকে নিয়ে তাই শেষ কথা বলা কঠিন…।
কে কী বলছেন
কাজী জাফর আহমদ
সভাপতি, জাতীয় পার্টি (নবগঠিত)
এরশাদ থুতু ফেলে আবার সেই থুতু চেটে তুলবেন ভাবিনি। গত ১০০ বছরের ইতিহাসে বিশ্বাসভঙ্গের এমন নজির আমি দেখিনি।
ড. কামাল হোসেন
সভাপতি, গণফোরাম
তিনি এখন থুতু সাহেব। এরশাদ একই সঙ্গে সরকারেও আছেন, আবার বিরোধী দলেও আছেন। এটা বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।
ওবায়দুল কাদের
যোগাযোগমন্ত্রী
এরশাদের শেষ কথা শোনার জন্য ১৩ নভেম্বর (মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিন) পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
রুহুল কবীর রিজভী
যুগ্ন-মহাসচিব, বিএনপি
কুচবিহারী এরশাদের বিষয়ে মন্তব্য নয়। এরশাদ কখন কী বলছেন না বলছেন ঠিক নেই। তার মধ্যে দেশপ্রেম নেই। তিনি সামঞ্জস্যহীন ও অনৈতিক লোক।
(দ্য রিপোর্ট/বিকে/এইচএসএম/ডিসেম্বর ০৮, ২০১৩)