নাশকতাকারীদের টার্গেট পুলিশ
আহমদুল হাসান আসিক, দ্য রিপোর্ট : পুলিশকে দুর্বল করার টার্গেটে সংঘবদ্ধ হচ্ছে নাশকতাকারীরা। দিনের আলোয় তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। ককটেল ছুড়ে ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে আহত করা হচ্ছে। মূলত পুলিশ সদস্যকে আতঙ্কগ্রস্ত ও দুর্বল করার টার্গেটেই এসব করছে নাশকতাকারীরা। ১৯৯০ সাল থেকেই এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘সম্প্রতি হরতাল ও অবরোধে পুলিশকে টার্গেট করে হামলা চালানোর চেষ্টা করছে পিকেটাররা। তারা রাজনৈতিক দাবি আদায়ে পুলিশকে প্রতিপক্ষ ভাবছে। মিছিল করার নাম করেই সরাসরি পুলিশের ওপর হামলা চালাচ্ছে তারা। ককটেল নিক্ষেপ করছে পুলিশকে লক্ষ্য করে। পুলিশ কারো প্রতিপক্ষ নয়। পুলিশ দেশের সেবক, জনগণের বন্ধু। পুলিশ যা করে, তা জনস্বার্থে করে।’
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের আমলে জামায়াতে ইসলামের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সহিংসতা শুরু হয়। এরসঙ্গে যোগ হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। নভেম্বর থেকে হরতাল অবরোধের আড়ালে শুরু হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের নাশকতা। শিগগিরই বাস্তবায়ন হতে পারে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের রায়- এ নিয়েও জামায়াত-শিবির আরও বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা করছে গোয়েন্দারা। আর এসব কারণেই নাশকতায় টার্গেট করা হচ্ছে পুলিশকে। নাশকতাকারীরা পুলিশের মনোবল ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্যেই এমন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
সূত্র জানায়, হরতাল ও অবরোধের আড়ালে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা তৈরি করছে দুর্বৃত্তরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে থাকার কারণে নাশকতা ও সহিংসতার ঘটনা প্রতিরোধ করা যাচ্ছে। ফলে পুলিশই এখন নাশকতাকারীদের মূল টার্গেট হয়ে পড়ছে। এমনকি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তাদের যেকোনো কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত পুলিশি বাধার মুখে পড়েছে।
ডিএমপি সূত্র জানায়, নাশকতা প্রতিরোধে পুলিশ সতর্ক অবস্থানে আছে। এ বছর ঢাকা মহানগরীতে অভিযান চালিয়ে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ৬ কেজি বিস্ফোরক, ৭০০টির বেশি ককটেল এবং ৬টি আইইডি (উন্নতমানের বোমা) উদ্ধার করে পুলিশ। আর এ কারণেই নাশকতার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি দুর্বৃত্তরা। এতে তারা পুলিশের ওপর বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে সুযোগ পেলেই পুলিশকে আক্রমণ করছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি পুলিশের বাধা ও গ্রেফতার আতঙ্কে জামায়াত বিএনপি গোপনে সংগঠিত হচ্ছে। পুলিশের ওপর গুপ্ত হামলা চালাচ্ছে। পেট্রোল বোমায় পুড়িয়ে দিচ্ছে পুলিশের গাড়ি। গত শুক্রবার বাড্ডা এলাকায় পুলিশের একটি পিকআপভ্যান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। শনিবার রাত পৌনে ৭টার দিকে নিউমার্কেট থানার ভেতরে পর পর দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ নিয়ে হরতাল ও অবরোধের মধ্যে নিউমার্কেট থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে ৩ বার ককটেল হামলা হয়েছে। এরও আগে রমনা থানা এলাকার মধুবাগ বাজার সংলগ্ন ফাঁড়িতে ককটেল হামলা হয়। পুরান ঢাকার নবাবপুর রোডে রবিবার সকালে পুলিশের গাড়িকে লক্ষ্য করে ২টি ককটেল নিক্ষেপ করা হয়।
গত বৃহস্পতিবার নয়াপল্টনের ভাসানী গলিতে দায়িত্ব পালন করার সময় ককটেলের আঘাতে আহত হন সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) সাইফুল ইসলাম। তিনি জানান, দুর্বৃত্তরা পরপর তিনটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটালে তার পাসহ বিভিন্ন স্থানে জখম হয়। ককটেল বিস্ফোরণের আগে তিনি আচ করতে পারেননি। এখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চিকিৎসাধীন আছেন। তিনি আরো জানান, পুলিশ সদস্যরা আহত হলে তাদের রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এসব হামলার কারণে সাধারণ পুলিশ সদস্যদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। কর্তব্যরত কয়েকজন পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালন এবং যেকোনো নাশকতা রোধে সদা প্রস্তুত থাকতে বলেছে। সদস্যদের কিছু নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। তারা দায়িত্ব পালন করার সময় আতঙ্কে থাকছেন বলে জানা গেছে।
আত্মরক্ষার্থে পুলিশের পক্ষ থেকে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এ প্রসঙ্গে মহানগর পুলিশের মতিঝিল জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) আশরাফুজ্জামান বলেন, নিজস্ব নিরাপত্তার লক্ষ্যে পুলিশ সদস্যরা প্রস্তুত আছে। এক্ষেত্রে একাধিক কৌশল অবলম্বন করা হয়। এ কারণেই তারা পুলিশের ওপর সহজে আক্রমণ করতে পারছে না। কি পন্থায় আত্মরক্ষা করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে তা কৌশলগত কারণে প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এটা প্রকাশ পেলে দুর্বৃত্তরা সুযোগ পেয়ে যাবে।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান তথ্য অনুসারে, গত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সরকার আমলেই পুলিশ সদস্যদের ওপর বেশি হামলা হয়েছে। নিহতের সংখ্যাও বেশি। গত ২২ বছরে সারাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতাসহ বিভিন্ন ঘটনায় ৬৮২জন পুলিশ নিহত হয়েছেন। এ তালিকায় একজন পুলিশ সুপার (এসপি) ও ৪ জন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন। বাকিরা মাঠ পর্যায়ের সদস্য।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯২ সালে ২০, ৯৩ সালে ২০, ৯৪ সালে ১৪, ৯৫ সালে ২৮ জন, ৯৬ সালে ৩৫, ৯৭ সালে ২৬, ৯৮ সালে ১৯, ৯৯ সালে ৩১, ২০০০ সালে ১৫, ২০০১ সালে ৫৩, ২০০২ সালে ৪৭, ২০০৩ সালে ৫০, ২০০৪ সালে ৪২, ২০০৫ সালে ৩৩, ২০০৬ সালে ৩৪, ২০০৭ সালে ২৪, ২০০৮ সালে ২৬, ২০০৯ সালে ২৮, ২০১০ সালে ৪০, ২০১১ সালে ৫১, ২০১২ সালে ৩৮ ও ২০১৩ সালে এ পর্যন্ত ৮ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।
চলতি বছর দেশে বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হয়েছেন ৮ জন পুলিশ। এরা সকলেই পুলিশ কনস্টেবল। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধায় রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হন কনস্টেবল বাবু, হযরত আলী ও তোজাম্মেল হোসেন। ওইদিনই চট্টগ্রামে কনস্টেবল আবু তারেক ও সৈয়দপুরে কনস্টেবল খাজা নাজিমউদ্দিনকে পিকেটাররা পিটিয়ে হত্যা করে। ৩ মার্চ ঝিনাইদহে কনস্টেবল জিএম ওমর ফারুক, ৫ মার্চ রংপুরে কনস্টেবল মোজাহার আলী ও ১০ মার্চ খুলনায় কনস্টেবল মফিজুর রহমান বিক্ষোভকারীদের হাতে নিহত হন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কোনো পুলিশ সদস্য নিহত হলে ৫ লাখ টাকা দেওয়ার বিধান করা হয়। তবে এর আগে এর পরিমাণ ছিল ৩ লাখ টাকা। আর কোনো সদস্য যদি আহত হয় তবে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে পুলিশের পক্ষ থেকে। এছাড়া পুলিশের ফান্ড থেকে আহতের অবস্থা বিবেচনায় অর্থ সহায়তাও দেওয়া হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, রাজধানীতে যেকোনো ধরনের নাশকতা রোধে পুলিশ কাজ করছে। নাশকতার উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের কর্মপরিকল্পনা দুর্বৃত্তরা বাস্তবায়ন করতে পারবে না। পুলিশ জনগণের কাজ করে। পুলিশকে টার্গেট করে কোনো রাজনৈতিক দাবি আদায় করা সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করে। তারা কখনো আতঙ্কের মধ্যে থাকে না।
(দ্য রিপোর্ট/কেজেএন/এএইচএ/এইচএসএম/শাহ/এসবি/ডিসেম্বর ০৯, ২০১৩)