চলচ্চিত্রে মতিন রহমানের আবির্ভাব সত্তর দশকের শুরুতে। তখন তিনি আজিজুর রহমানের সহকারী পরিচালক। দীর্ঘ ১০ বছর অভিজ্ঞতা অর্জনের পর নিজে পরিচালনা করেন ‘লাল কাজল’। পরিচালক হিসেবে দর্শকের ইতিবাচক সাড়া তাকে পরবর্তী চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ করে দেয়। ‘বীরাঙ্গনা সখিনা’, ‘বিয়ের ফুল’, ‘রং নাম্বার’ ও সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘তোমাকেই খুঁজছি’সহ পঁচিশটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে চলচ্চিত্র শিল্পে নিজেকে স্বতন্ত্র প্রমাণ করেছেন। পরিচালক মতিন রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন দ্য রিপোর্টের প্রতিবেদক মুহম্মদ আকবর

দ্য রিপোর্ট : আপনার প্রথম চলচ্চিত্র ও সর্বশেষ চলচ্চিত্রের মধ্যে পার্থক্য কী?

মতিন রহমান : চলচ্চিত্র পরিচালনার শুরুটা তো আর হঠাৎ করে হয়নি। অনেক পরিকল্পনার পর দীর্ঘদিনে নিজেকে তৈরি করে তারপর আমি চলচ্চিত্রে এলাম। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম চলচ্চিত্রটি কিন্তু সুনির্মিত হয়। একজন পরিচালক মনে করেন এটাই তার প্রথম এবং হয়তোবা শেষ কাজ। তাই পরিকল্পনার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে যতরকম ভালো করা যায়, দর্শকের মনোজগৎকে উপলব্ধি করা যায়- সে সব প্রসঙ্গই স্থান পায় প্রথম নির্মাণে। এই বিবেচনার ফলশ্রুতিতেই আমার প্রথম চলচ্চিত্র ‘লাল কাজল’। সর্বশেষ বলব না, কারণ আমি তো বলিনি যে আমি আর চলচ্চিত্র নির্মাণ করব না। তবে সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘তোমাকেই খুঁজছি’। এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য অনেক। এটা হাস্যরসাত্মক আর প্রথমটা হাসি-কান্না দুয়েরই সমন্বয়। হয়তোবা সেটা সময়ের দাবি। তবে যত্নের অভাব তো কখনই নির্দেশকের থাকে না। সাংগঠনিক দিক থেকে পার্থক্য থাকলেও সামাজিক দায়বদ্ধতার দিক থেকে কোনো সেপারেশন নেই আমার চলচ্চিত্রে।

দ্য রিপোর্ট : ঐতিহাসিক কাহিনী নিয়ে আপনার কিছু কাজ আছে। তেমনি একটি চলচ্চিত্র ‘বীরাঙ্গনা সখিনা’ সম্পর্কে জানতে চাই?

মতিন রহমান : এ চলচ্চিত্রটির একটা ঐতিহাসিক সত্যতা আছে। এর কাহিনী ময়মনসিংহ গীতিকা থেকে সংগৃহীত। বাঙালি নারীর চিরায়ত স্বভাব স্বামীর প্রতি ভালোবাসা, ভক্তি ও শ্রদ্ধা। অপরদিকে স্বামীর অনুভূতি, আচরণ ও সমাজের মানুষের অভিব্যক্তি স্থান পেয়েছে এই চলচ্চিত্রে। গল্পটি একটু বললে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে- স্বামীকে বাঁচাতে বাবাকে প্রতিপক্ষ করে যুদ্ধে লিপ্ত হয় সখিনা। স্বামীকে উদ্ধারের শেষে যখন জানতে পারে যে স্বামী তাকে তালাক দিয়েছে, সে সময় তার শক্তি, দেহের উত্তাপ ও শিরস্ত্রাণ খুলে পড়ে। একটি করুণ বেদনাময় মুহূর্ত উপস্থাপন করে তা থেকে উত্তরণের ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে।

দ্য রিপোর্ট : বর্তমান চলচ্চিত্র নিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা প্রসঙ্গে আপনার বক্তব্য কী?

মতিন রহমান : তথ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকায় দুটোই হয়েছে, একদিকে ভারতের চলচ্চিত্র আমদানি করে দেশের চলচ্চিত্রকে হুমকির দিকে ফেলা দেওয়া, অন্যদিকে সরকারি অনুদানে চলচ্চিত্রের সংখ্যা বাড়ছে। চলচ্চিত্রকে আধুনিক করতে সরকার কোটি টাকার অনুদান দিচ্ছে। কিন্তু আদৌ কোথাও ৬০ পয়সার কাজও হয়েছে কিনা, তা আমার জানা নেই। তবুও আমি আশাবাদী একদিন সব হবে। রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসীদের অনুদান দেওয়া, যাদের হাতে সমাজের তথা দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার ছোঁয়া নেই তাদের হস্তক্ষেপ থেকেও একদিন চলচ্চিত্র মুক্ত হবে। অন্তত আশা করতে তো সমস্যা নেই।

দ্য রিপোর্ট : একটু অন্য বিষয়ে জানতে চাই, আপনারা যখন চলচ্চিত্রে এসেছেন সে সময় তো চলচ্চিত্রকে ঘিরে তেমন একাডেমিক চর্চার ব্যবস্থা ছিল না। বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়াশুনার ব্যবস্থা হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনি কতটুকু আশাবাদী?

মতিন রহমান : আমার কথাই যদি বলি- সেই ১৯৭২ সালে যখন ঢাকায় এলাম তখন আলমগীর কবিরের ‘ঢাকা ফিল্ম ইন্সটিটিউট’ ছাড়া তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। সেখানে চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ, সাংবাদিক রফিকুজ্জামান ও আমিসহ বেশ কয়েকজন একাডেমিক পাঠ নিয়েছি। ফলে আমরা এক সময় ফিল্ডওয়ার্ক হিসেবে দীর্ঘদিন একজন পরিচালকের সহকারীর কাজ করার পর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ পাই। এখন অনেক প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়টি নিয়ে পড়ানো হচ্ছে। একাডেমিক পাঠের মধ্য দিয়ে একজন ছাত্র খুব দ্রুত চলচ্চিত্রের প্রযুক্তিগত ভাষা থেকে শুরু করে নানা কলাকৌশল শিখে নিচ্ছে। ফলে এর একটা প্রভাব চলচ্চিত্র শিল্পে খুব অচিরেই পড়বে বলে আমার বিশ্বাস।

দ্য রিপোর্ট : অনেকেই বলতে শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব অভিজ্ঞ শিক্ষার্থীরা চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ পাচ্ছে না। এ কথার সত্যতা কতটুকু?

মতিন রহমান : একজন প্রযোজক তো তাদের চেনে না, তাই তাদের কর্মদক্ষতা সম্পর্কে অবগত হওয়ার সুযোগ নেই। চলচ্চিত্রের মতো বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগে একজন অজানা-অচেনা লোককে সুযোগ দেবে না এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষার্থীদের এ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের কিংবা শিক্ষকদের। এটা করা উচিত। তাহলেই চলচ্চিত্র বিষয়ে পড়ুয়া বর্তমানের মননশীল তরুণদের মাধ্যমে চলচ্চিত্রাঙ্গন উপকৃত হবে।

দ্য রিপোর্ট : দেশ ভেদে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আছে। কিন্তু কোনোরকম বিবেচনা না করে আংশিক ভিন্নতা নিয়ে বাংলাদেশে নতুন অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে, এর ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনার কথা জানতে চাই?

মতিন রহমান : এটা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হওয়া উচিত। অনেকেই জানেন না এ চলচ্চিত্রগুলো কিন্তু কপিরাইটে কিনে আনা। তাই এটা ঠিক না কিংবা বেআইনি এটা কিন্তু বলা যাবে না। দর্শককে ফাঁকি দিয়ে বিরাট অংকের টাকা দিয়ে অনুমোদন করে নিয়ে নির্মিত হচ্ছে এ সব চলচ্চিত্র। কিন্তু দর্শক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের স্বাদ না পেয়ে সে সব চলচ্চিত্র গ্রহণ করছে না। কারণ, ধরুন তামিল সিনেমার কথা কিংবা মুম্বাইয়ের কথা; তারা তাদের নিজস্ব কায়দায় নিজস্ব এলাকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ভেতরে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে। যা আমাদের দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে কখনো যায় না, সম্পূর্ণ বিপরীত। দর্শকের ভাবনার উপলব্ধি করে এ দেশের পরিচালকদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

দ্য রিপোর্ট : দেশের সাহিত্যিক, কবিদের একসময় চলচ্চিত্রের কাহিনী, সংলাপ, গান রচনায় সম্পৃক্ততা ছিল। কিন্তু এ সময় তেমনটি অনেকাংশে হচ্ছে না। আপনি কী বলেন?

মতিন রহমান : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের ১৯৫৬, ’৫৭, ’৫৮ ও ’৫৯ সাল বিবেচনা করলে আমরা দেখব- তখন যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তার গল্প, সংলাপ, চিত্রনাট্য ও গীত রচনার সঙ্গে দেশের লেখকরা সম্পৃক্ত ছিলেন। এক্ষেত্রে মুর্তজা বশির, হুমায়ুন কবির, সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখের নাম উল্লেখ্যযোগ্য। এখন আমরা এ জায়গাটা থেকে সরে যাচ্ছি। এটা হতে পারে পরিচালকদের পাঠাভ্যাসের অভাব অথবা লেখক-পরিচালকদের বোঝাপড়ার ঘাটতি। আমি তো মনে করি এ দেশে সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন, নাসরিন জাহানের মতো কথা সাহিত্যেকদের লেখা প্রতিনিয়ত নতুন আঙ্গিকের কাহিনীর উৎস হতে পারে। একজন হুমায়ূন আহমেদের লেখা থেকেই তো আগামী ১০ বছরের সিনেমা নির্মিত হতে পারে।

দ্য রিপোর্ট : নতুনদের কাজের বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই?

মতিন রহমান : ওরা অনেকেই ভালো কাজ করছে। ওদের নিয়ে আমি অনেক আশাবাদী। অনেকেই তাদের গণ্ডিবদ্ধতা থেকে বের হয়ে নতুনের সন্ধানে আছে। নতুনদের কাজ দেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দেবে- আমি এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

(দ্য রিপোর্ট/এমএ/আইজেকে/শাহ/এইচএসএম/ডিসেম্বর ০৯, ২০১৩)