মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। সর্বশেষ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া আহত মোস্তফা হাওলাদার (৫৫) মারা গেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের আইসিইউ’তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত সোমবার রাত আড়াইটায় মারা যান তিনি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর কাছে জানতে চাইলে তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সাক্ষীদের মেরে ফেলা সম্পূর্ণ আইনবিরোধী কাজ। এটা সরকারের ব্যর্থতা।’

নিহত মোস্তফা হাওলাদারের বাড়ি পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলার পারেরহাট ইউনিয়নে। গত শনিবার মধ্যরাতে হোগলাবুনিয়ার গ্রামের বাড়িতে সিঁধ কেটে ঢুকে ঘুমন্ত মোস্তফা হাওলাদারের ওপর হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় তার স্ত্রী হাসিনা বেগমকেও কুপিয়ে আহত করা হয়।

ঘটনার পর প্রথমে মোস্তফা হাওলাদারকে খুলনা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে রোববার তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

এর আগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার বাদী মাহবুবুর রহমানকে হুমকি ও বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়। পরবর্তীতে পিরোজপুরের সকল নিরাপত্তা জোরদারের কথা জানিয়েছেন জিয়ানগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। কিন্তু বাঁচতে পারলেন না মোস্তফা হাওলাদার।

চলতি বছরের ৯ মার্চ বাংলাদেশের স্বনামধন্য সংগীত ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভাই মিরাজউদ্দিন আহমেদকে হত্যা করা হয়। রাজধানীর কুড়িল ফ্লাইওভারের নিচে রেললাইনের ওপরে মিরাজউদ্দিনের লাশ পড়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের একজন সাক্ষী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘কি আর বলব? খুবই দুঃখের বিষয় এটি। যারা ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন বা দিবেন তাদের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। জানি না, সরকারিভাবে নিরাপত্তার মাধ্যমে সাক্ষীদের রক্ষা করা যাবে কিনা। তবে, যারা নিরাপত্তা চান তাদের অবশ্যই নিরাপত্তা দেওয়া উচিত।’

তিনি বলেন, ‘এভাবে হামলার শিকার হলে কেউ সাক্ষী দিতে এগিয়ে আসবেন না। এই বিষয়টিতে সরকারকে খুব ভালোভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।’

আপনি নিজেও ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। নিরাপত্তা নিয়ে কোনো আশঙ্কা করেন কি? উত্তরে আনিসুজ্জামান বলেন, ‘নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা আছে। কিন্তু সরকারের কাছে নিরাপত্তা চাইব না। কারণ এভাবে নিরাপত্তা নিয়ে নিরাপদ থাকা যাবে কি? আমার পক্ষে এত নিরাপত্তা নিয়ে চলাফেরা করাও সম্ভব না।’

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদানকারী ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসির মামুন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সাক্ষী, প্রসিকিউটর এবং বিচারকসহ ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তার বিষয়ে বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। এর পরও যদি সরকারের চৈতন্য না আসে, তাহলে কিছু করার নেই। সরকার এই বিষয়ে কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা আমি জানি না।’

আপনার নিরাপত্তা নিয়ে কোনো উদ্বেগ আছে কি? উত্তরে তিনি বলেন, ‘এর আগে এসব কারণ ও লেখালেখি নিয়ে আমার ওপর কয়েক দফা হামলা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তা চাই না। সামগ্রিক নিরাপত্তা দরকার। বিশেষ করে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যারা সাহস নিয়ে সাক্ষ্য দিতে এসেছেন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।’

নিহত গোলাম মোস্তফার ছেলে হাফিজুল ইসলামের সঙ্গে দ্য রিপোর্ট-এর কথা হয় মঙ্গলবার। এ সময় তিনি বাবার লাশ নিয়ে বাড়ির পথে ছিলেন। মাওয়া ঘাটে থাকার সময় মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদকের কথা হয় তার সঙ্গে।

দ্য রিপোর্ট : আপনার বাবার উপর কীভাবে হামলা হয়েছিল?

হাফিজুল ইসলাম : আনুমানিক রাত দুইটার (সোমবার রাত) দিকে সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকে বাবার উপর হামলা চালায়।

দ্য রিপোর্ট : কারা হামলা করেছে?

হাফিজুল ইসলাম : জামায়াত-শিবিরের লোকজন।

দ্য রিপোর্ট : তারা কারা?

হাফিজুল ইসলাম : তাদের দেখলে চিনি।

দ্য রিপোর্ট : নাম কি?

হাফিজুল ইসলাম : নাম জানি না।

দ্য রিপোর্ট : তাহলে জামায়াত-শিবিরের লোক কীভাবে বুঝলেন?

হাফিজুল ইসলাম : আগে থেকেই তারা হুমকি দিয়ে আসছিল।

দ্য রিপোর্ট : থানায় অভিযোগ করেছিলেন?

হাফিজুল ইসলাম : থানায় অভিযোগ করিনি। তবে মাঝে মধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হতো।

দ্য রিপোর্ট : ঘটনার পর পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন?

হাফিজুল ইসলাম : জিয়ানগর থানায় জানিয়েছি।

দ্য রিপোর্ট : ঘটনা পরবর্তী সময়ে পুলিশ কী করেছে?

হাফিজুল ইসলাম : আমি আহত বাবাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসি। এরপর আর জানি না।

এরপর আমরা কথা বলি জিয়ানগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামান তালুকদারের সঙ্গে। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ঘটনার আধাঘন্টা আগেও মোস্তফা হাওলাদারের বাড়িতে পুলিশ টহল দেয়। ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ঘটনাস্থলে যাই। তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে খুলনা হাসপাতালে পাঠাই।’

-ঘটনার পরে আপনারা কী উদ্যোগ নিয়েছেন?

উত্তরে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান ‘সবে মামলা হয়েছে। তদন্ত করছি।’

-প্রাথমিক তদন্তে কী পেয়েছেন?

এই বিষয়ে নিহতের ভাই আব্দুল মজিদ হাওলাদার জিয়ানগর থানায় কারো নাম উল্লেখ না করে একটি মামলা করেছেন। এখন ঢাকা থেকে লাশ আসছে। ব্যস্ত আছি। পরে জানাতে পারব।

-এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কে?

ইন্সপেক্টর শেখ সারোয়ার।

এই পর্যায়ে আমরা কথা বলি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর শেখ সারোয়ারের সঙ্গে।

দ্য রিপোর্ট : তদন্তে কী পেয়েছেন?

শেখ সারোয়োর : এখনো তেমন কিছু পাইনি। মামলা সম্পর্কে যিনি ভালো জানেন তিনি (নিহতের স্ত্রী) এখনো এলাকায় আসেননি।

দ্য রিপোর্ট : কাউকে গ্রেফতার করেছেন?

শেখ সারোয়োর : সন্দেহজনক ৬ জনকে আটক করেছি। জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

দ্য রিপোর্ট : পিরোজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সংবাদ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, এই ঘটনায় বিএনপি জামায়াতের কেউ জড়িত নেই। তার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আপনারা কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?

শেখ সারোয়োর : উনি বললে আমরা কী করব?

দ্য রিপোর্ট : আপনি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। মামলার সঙ্গে কী এই বক্তব্যের কোনো যোগসূত্র পান না?

শেখ সারোয়োর : দেখুন আমরা গ্রাম এলাকায় থাকি। কে কি বলেছেন এখনো জানি না। এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।

দ্য রিপোর্ট : জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনার বিষয়ে উনি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন অথচ আপনাদের জন্য এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার?

শেখ সারোয়োর : এখনো লাশ এসে পৌঁছায়নি। রাস্তায় আছে। আমরা লাশের অপেক্ষা করছি। পরে অন্য কাজে হাত দিতে পারবো।

মোস্তফা হাওলাদারের নিহতের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল হান্নান খানের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য প্রতি জেলায় সাক্ষী সুরক্ষা কমিটি আছে। তারা বিষয়টা দেখভাল করেন। তবে ঘটনাটি নিশ্চয় হৃদয়বিদারক। তার মতো একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে হারাতে হলো।’

(দ্য রিপোর্ট/বিকে/সাদি/এইচএসএম/ডিসেম্বর ১০, ২০১৩)