মতিনুজ্জামান মিটু, দ্য রিপোর্ট : দেশের প্রাচীনতম স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে মঙ্গলবার টানা ১২ ঘণ্টার সংঘর্ষে ছয়জন কর্মচারী আহত হয়েছেন। হয়েছে ব্যাপক ভাঙচুর। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

হাসপাতালের কর্মকর্তা, প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, সোমবার রাত ২টায় হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে ভয়াভয় এই তাণ্ডবের সূত্রপাত ঘটে। এন্টার্নি ডাক্তার আশফাক আলী ওই সময় মেহেদি নামের এক রোগীর শরীরে এইচআইভি ভাইরাস আছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য ব্লাড ব্যাংকে আসেন। সেখানে কর্তব্যরত টেকনিশিয়ান আব্দুল আওয়াল তিন মিনিটের মধ্যে কহিনুর বেগম নামের অন্য এক রোগীর একটি রিপোর্ট ডাক্তারের হাতে তুলে দেন। ঘটনাটি ধরা পড়লে ডাক্তার আশফাক বিষয়টি পরিচালক সাহেরের কাছে অভিযোগ করার কথা বলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আওয়াল ডাক্তারের জামার কলার ধরে তাকে লাঞ্ছিত করেন।

খবরটি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের ছাত্ররা লাঠিসোটা নিয়ে এসে আওয়ালকে বেধড়ক মারপিট করে। এতে সে মারাত্মক আহত হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

প্রতিক্রিয়ায় মঙ্গলবার সকাল ৭টায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর ৮০/৯০ জন কর্মচারী জড়ো হয়ে ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে থাকে। এসময় তারা ৩/৪ জন ছাত্রকে ধাওয়া করে। পরপরই শতাধিক ছাত্র ও এন্টার্নি ডাক্তাররা লোহা এবং কাঠের লঠিসোটা নিয়ে এসে কর্মচারীদের ওপর চড়াও হয়। এসময় জরুরি বিভাগের কাউন্টার ইনচার্জ অফিস সহকারী খোরশেদ, বাবুর্চি ফজলুল হক, সুইপার বাবু লাল ও বাবুসহ ছয়জন আহত হয়। ব্যাপক তাণ্ডবের মুখে সকাল না হতেই বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীরা ভয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়।

হাসপাতাল ডাক্তার, নার্স ও রোগীশূন্য হয়ে পড়ে। মোতায়েন থাকা পুলিশ ও র‌্যাব এমনকি সাবেক সংসদ সদস্য হাজী সেলিম এবং বর্তমান সংসদ সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের উপস্থিতিতেও দফায় দফায় ভাঙচুর চলতে থাকে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রধান দরজা, জরুরি বিভাগ, বাবুর্চি খানার গেট, ব্লাড ব্যাংক, কর্মচারীদের সমিতি অফিস, স্টাফ কোয়ার্টারের বিভিন্ন ভবন কোন কিছুই এই তাণ্ডব থেকে রেহাই পায়নি।

হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়ে। সকালের নাস্তা, দুপুর ও বিকেলের নাস্তাও রোগীদের মাঝে পরিবেশন করা যায়নি। রাতের খাবারও ছিল অনিশ্চিত। জাতীয় সংসদ সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর দিলিপ কুমার ধর, পরিচালকের দায়িত্বে থাকা প্রফেসর সৈয়দ এ কে মাহাবুবুল হক, উপাধ্যক্ষ প্রফেসর সাকাওয়াত হোসেন, উপ-পরিচালক ডা. আবু ইউসুফ, হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধান, শাখা প্রধান, ৩য় শ্রেণীর কর্মচারীদের সভাপতি চঞ্চল, সাধারণ সম্পাদক মিজান, ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের সভাপতি আব্দুল মতিয়ার, সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গির আলম, ছাত্রনেতা শাওন দাসের মধ্যে হাসপাতাল ও কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে দুদফা সভা অনুষ্ঠানের পর বেলা আড়াইটায় পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে।

সভায় তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রফেসর শরীফুল ইসলামকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে বলে অধ্যক্ষ দিলিপ কুমার ধর দ্য রিপোর্টকে জানান। তদন্ত কমিটি পরবর্তী দুই কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দেবে।

বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে হাসপাতালের কর্তব্য ও দায়িত্বরত সহকারী পরিচালক ডা. আব্দুল মজিদ সংঘর্ষ ও দিনব্যাপী তাণ্ডবের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা যায়নি বলে জানান। তিনি আরো জানান, ঘটনার ব্যাপারে কোন মামলা হয়নি। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

সোমবার হাসপাতালে ৬৮৪ রোগী ভর্তি ছিল। হাসপাতালের কর্মরত বারশ ১৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ৬৬৯ কর্মচারী রয়েছে। প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা ২৫২ ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নার্স রয়েছে ২৫৬ জন।

হাসপাতালের পথ্য বিভাগে কর্তব্যরত কিচেন সুপারভাইজার সুদেব কুমার মন্ডল বলেন, রবিবার ৬৮১ রোগীকে পথ্য দেওয়া হয়েছিল। স্টুয়ার্ড গোলাম মোস্তফা সাহেব না থাকায় আমাকে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। প্রতি শিফটে এখানে ১৩ জন করে দুই শিফটে ২৬ জন বাবুর্চি থাকে। সকালে নাস্তার সময় থেকে এখন পর্যন্ত একজনও আসেনি।

খাদ্য সরবরাহকারী গোলাম মোহম্মদ বলেন, আমার ৩৫ বছরের জীবনে হাসপাতালে এমন ঘটনা দেখিনি।

বেলা সাড়ে ১২টায় তাণ্ডবের মধ্যে দায়িত্বরত জরুরি বিভাগের ডাক্তার হাবিবুর রহমান বলেন, সেবা দেওয়ার পরিবেশ নেই। দেখতেই তো পারছেন, এ অবস্থায় কে সেবা নিতে আসবে। বেলা ৪টায় সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার রাশেদ বলেন, আমি দুপুর ৩টায় যথারীতি ডিউটিতে এসেছি। কেউ সেবা নিতে আসছে না। এখন সেবা দেওয়ার পরিবেশ নেই। এসময় এক ব্রাদার বলেন, কেউ এলে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেব।

সন্ধ্যার সময়ও সেখানে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। দুপুরে ৫৫ বছরের বৃদ্ধা খোরশেদাকে কাঁপতে কাঁপতে বলতে শোনা যায়, বাবা কি করবো? তিনি তার এক রোগীর জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলেন।

(দ্য রিপোর্ট/এম/এমএআর/ডিসেম্বর ১১, ২০১৩)