‘বাবার গান সংরক্ষণে পুনরায় রেকর্ড করতে হবে’
ইসহাক ফারুকী : দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেলো। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা খান আতাউর রহমান ৯ বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ‘খান আতাউর রহমান’ নামটি শুনলে গর্বে যেন আমাদের বুক ফুলে ওঠে।
খান আতাউর রহমানের ছেলে আগুন। নিজেকে আর তার বাবার পরিচয়ে পরিচিত হতে হয় না। অভিনেতা ও সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তিনি নিজের স্থান করে নিয়েছেন। তারপরও বাবাকে নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই।
মঙ্গলবার আগুনের বাসায় নানা প্রসঙ্গে কথার ফাঁকে বললাম, বাবাকে নিয়ে আপনার স্মৃতিচারণ শুনতে চাই। একটু ভেবে বললেন, আসছি। তার চোখের কোনে স্ফটিক জল দেখতে পেলাম। বাইরে গেলেন, কিছুক্ষণ পর পাশে এসে বসলেন। জিজ্ঞেস করলাম, বাবার জন্মদিন উপলক্ষে কি করছেন? উত্তরে বললেন, ‘বুধবার বাংলাভিশনে রাত ১১টা ২৫ মিনিটে ফোনোলাইভ স্টুডিও কনসার্টে আমি ও আমার বোন রুমানা ইসলাম একসঙ্গে গাইবো। বাবার গানগুলোই গাইবো আমরা। বাসায় মিলাদ মাহফিলের আয়োজন রয়েছে। আমরা এটুকুই করছি। তবে আর কে কি করছে তা আমার জানা নাই।’ বলেই থামলেন তিনি। খানিকটা উদাসীনতা ভর করলো তার চোখে-মুখে।
আপনার বাবার গান সংরক্ষণের জন্য কি করা দরকার? এমন প্রশ্নের জবাবে আগুন বললেন, ‘বাবার গান পুনরায় রেকর্ড করতে হবে। বর্তমান প্রজন্ম টেকনোলজিকে এমনভাবে গ্রহণ করেছে যে, বাবার সময়ের রেকর্ড করা গান তাদের সামনে আনা যাবে না। তথ্য-প্রযুক্তির যুগে এর সঠিক ব্যবহার করে বাবার গান সংরক্ষণ করতে হবে।’
এই দায়িত্ব কার? প্রশ্ন করতেই আগুন বললেন, ‘বাবা তো দেশের সম্পদ। তাই সরকারকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের একার পক্ষে তো এই দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়।’
এই ফাঁকে চোখ রগড়ানোর ভাব করে জমে থাকা পানিটুকু মুছে নিলেন। আপনারা এ নিয়ে কিছু করছেন না? প্রশ্নটা ছুড়তেই তিনি খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘বাবার গান নিয়ে আমার বোন পুরো একটা অ্যালবাম করেছে। আর আমিও আমার সলো অ্যালবামে বাবার গান রেখেছি।’
এরপর বেশ কিছুক্ষণ থমথমে রইলো পরিবেশ। খান আতা যেন দুজনের মনের ওপর ভালবাসার পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ খান আতাউর রহমানকে নিয়ে কোনো স্মৃতি মনে পড়ে কিনা জানতে চাইলে হেসে দিলেন আগুন। বললেন, ‘কত কিছুই তো মনে পড়ে। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবো? তবে হ্যাঁ। একটা কথাই এখন সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে। বাবার ‘এখন অনেক রাত’ চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। ‘ও আমার জন্মভূমি’ শিরোনামে গানটি গাওয়ার পর অনেক শ্রোতাপ্রিয়তা পেলো। কিন্তু চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পর মা (কণ্ঠশিল্পী নীলুফার ইয়াসমিন) শুনে বললেন, গানটি তো বেসুরো, তাল ঠিক নেই। এই কথা শোনামাত্র আমার মাথায় হাত। বাবার কাছে ছুটে গেলাম। বাবাকে বললাম, আচ্ছা বাবা, একজন কষ্টে থাকা মুক্তিযোদ্ধার গলা থেকে সুরে গান বের হয় কীভাবে? তার তো গান বেসুরো হতেই পারে। বাবা শুনে বললেন, তুই যা বলেছিস, ঠিক আছে। কিন্তু তোর মাকে বলিস না।’ এ কথা বলেই হাসতে থাকলেন আগুন। হাসি যেন থামেই না।
তার চোখে বাবার স্মৃতিকাতরতার অশ্রুর ওপর জন্মবার্ষিকীর আনন্দ যেন ছাপিয়ে যায়-এই প্রত্যাশা বুকে নিয়ে আগুনের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
(দ্য রিপোর্ট/আইএফ/নূরু/এমসি/এইচএসএম/ডিসেম্বর ১১, ২০১৩)