পৌষের কাছাকাছি রোদ গায়ে মাখবেন না মান্না দে
বৈচিত্র্যের বিচারে তাকেই হিন্দি গানের ভুবনে সর্বকালের সেরা গায়ক হিসেবে স্বীকার করে থাকেন অনেক সঙ্গীতবোদ্ধা।
পূর্ণ চন্দ্র এবং মহামায়া দে’র সন্তান মান্না দে ১ মে ১৯১৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মা ছাড়াও সংগীতে তাকে অনুপ্রাণিত করেন চাচা সংগীতজ্ঞ কে সি দে (কৃষ্ণ চন্দ্র দে), যিনি তার সংগীত জীবনে বড় ভূমিকা রাখেন। শৈশবে ভর্তি হন ‘ইন্দু বাবুর পাঠশালা’ নামে একটি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর স্কটিশ গির্জা কলেজিয়েট স্কুল ও স্কটিশ গির্জা কলেজে স্নাতক পর্যন্ত পড়েন। ঐ সময়ে মান্না দে আন্তঃকলেজ গান প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিকভাবে তিন বছর তিনটি আলাদা বিভাগে প্রথম হন।
কে সি দে’র হাত ধরেই ১৯৪২ সালে পা রাখেন মুম্বাইয়ে৷ কাকার সঙ্গে কাজ করতে করতেই নজরে পড়েন শচীন দেব বর্মনের৷ ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের তালিম নেন উস্তাদ আমান আলি খান, উস্তাদ দবির খান ও উস্তাদ আব্দুল রহমান খানের কাছে৷ ১৯৪৩ সালে তামান্না ছবিতে প্রথম প্লে-ব্যাক করেন মান্না দে৷ সুরাইয়া’র সঙ্গে দ্বৈত গানে সুরকার ছিলেন কে সি দে। অভিষেকেই মান্না দে’র গলা শ্রোতাদের মন ছুঁয়ে যায়৷ ১৯৫২ সালে মান্না দে বাংলা এবং মারাঠী ছবিতে একই নামে এবং গল্পে ‘আমার ভূপালী’ গান গান। এই গানে জনপ্রিয় গায়ক হিসেবে সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পান। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। নানা ভাষায় নানা আঙ্গিকের চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্রের বাইরে গান রেকর্ড করেন তিনি। তার বেশিরভাগই শ্রোতাপ্রিয়তা লাভ করে।
মান্না দে’র চলচ্চিত্রের গান নিয়ে লিখেছেন গায়ক কবির সুমন। ‘ডাক হরকরা’ ছবিতে তার গায়কী বিশ্লেষণ করছেন এভাবে, ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় ও সুধীন দাশ গুপ্তের সুরে যে মান্না দে’কে পেলাম, তিনি যেন আমজনতার ঘরের মানুষ। তার আগলহীন, আড়ষ্টতাহীন স্বরপ্রক্ষেপ, যেকোনও পর্দায় সুর ধরে রাখায় তার দম যেন কায়িক শ্রমে অভ্যস্ত মানুষের ধাঁচা’।
একই লেখায় কাওয়ালি গানের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘১৯৬০ সালে ‘বরসাত কি রাত’ ছবিটি যখন মুক্তি পেল, উপমহাদেশ জানতে পারল কাওয়ালি আঙ্গিকে মান্না দে কোন উচ্চতায় উঠতে পারেন। ‘না তো কারওয়াঁকি তালাশ হ্যায়’ গানটি তিনিই ধরছেন। খামাজ রাগে রওশনের সুর। আঙ্গিক কাওয়ালি। যন্ত্রসংগীতের ভূমিকার পর একটি মোক্ষম ঝোঁকের মাথায় তিনি শুদ্ধ গা থেকে মিড় দিয়ে সা-এর মোকামে এলেন। তারপর বিদ্যুৎ গতিতে একটি তান দিয়ে সটান তারের শুদ্ধ গা। সেখান থেকে তারের পঞ্চম ছুঁয়ে একটি অবরোহণ তান একই ক্ষিপ্র গতিতে মোকাম লক্ষ্য করে। তারপর মধ্য সপ্তকের পা, শুদ্ধ মা, শুদ্ধ গা, শুদ্ধ রে— এই স্বরগুলিকে নিয়ে মধুর অভিমানের খেলা। এর পর কথাভিত্তিক গান। খামাজ রাগে যে মুখবন্ধ মান্না দে এই গানের রেকর্ডিং-এ প্রয়োগ করেছেন, তা শুনলে মার্গসংগীতের সেরা শিল্পীরাও তাকে কুর্নিশ করবেন। শুধু প্রায়োগিক দক্ষতার প্রশ্ন নয়। মেজাজ’।
বিবিসি’র জরিপে সর্বকালের সেরা বাংলা গানে স্থান পেয়েছিল তার ‘কফির হাউসের আড্ডাটা আজ আর নেই’। গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা ১৯৮৪ সালের গানটি এখনো সব প্রজম্মের বাংলাভাষীদের কাছে সমান জনপ্রিয়। গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার ছাড়াও তার বিখ্যাত গানগুলোর বেশিরভাগ লিখেছিলেন পুলক বন্দোপাধ্যায়। বাংলায় তার গাওয়া জনপ্রিয় গানের মধ্যে- অনেক কথা বলেও (১৯৮৬), অপবাদ হোক না আরো (১৯৭২), আজ আবার সেই পথে দেখা হয়ে গেল (১৯৭২), আবার তো দেখা হবে (১৯৬৪), আমি যে জলসাঘরে (১৯৬৭), আমি ফুল না হয়ে কাঁটা হলে বেশ (১৯৭৮), আমি শ্রী শ্রী ভজহরি মান্না (১৯৭০), উথালি পাথালি আমার বুক (১৯৬০), এই কূলে আমি ঐ কূলে তুমি (১৯৫৮), ক’ফোটা চোখের জল ফেলছো (১৯৭১), কালো যদি মন্দ তবে (১৯৭৪), কোন কথা না বলে (১৯৬৭), কতদিন দেখিনি তোমায় (১৯৮৪), কথায় কথায় যে রাত হয়ে যায় (১৯৬৮), যদি কাগজে লেখো নাম (১৯৭৪), তুমি তানপুরাটার তার বেঁধে নাও (১৯৮০), ধান ধান্যে পুষ্পে ভরা (১৯৭২), পৌষের কাছাকাছি (১৯৮২), সই ভালো করে বিনোদ বেণী (১৯৮০), সে আমার ছোট বোন (১৯৭৮, সবাই তো সুখী হতে চায় (১৯৮২) উল্লেখযোগ্য।
তার একক গানগুলো বেশি জনপ্রিয় হলেও দ্বৈতগানে তিনি কন্ঠ দিয়েছেন তার সময়কালের অনেক জনপ্রিয় শিল্পীর সঙ্গে। কলকাতায় আরতি মুখোপাধ্যায়, সবিতা চৌধুরী ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় উল্লেখযোগ্য। এছাড়া গেয়েছেন লতা মুঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, ভীমসেন জোসি ও কিশোরকুমার প্রমুখের সঙ্গে।
কেরালার সুলোচনা কুমারনকে তিনি ১৮ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সালে বিয়ে করেন। তাদের দুই কন্যা শুরোমা এবং সুমিতা। মান্না দে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় মুম্বাইয়ে কাটানোর পর শেষের দিনগুলো ব্যাঙ্গালোরের কালিয়ানগর শহরে কাটান। ১৬০ দিন ভর্তি থাকার পর ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর রাতে ৩টা ৫০মিনিটে ৯৪ বছর বয়সে বেঙ্গালুরুর হাসপাতালে দেহত্যাগ করেন তিনি। শেষ দিকে তিনি ফসফুসের সংক্রমণ ও কিডনির সমস্যা ভুগছিলেন।
২০০৫ সালে বাংলাভাষায় তার আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’ প্রকাশিত হয়। পরে এটি ইংরেজি, হিন্দি ও মারাঠী ভাষায় অনুদিত হয়ে। তার জীবন নিয়ে ‘জীবনের জলসাঘরে’ নামে একটি তথ্যচিত্র ২০০৮ সালে মুক্তি পায়। মান্নাদে সঙ্গীত একাডেমী তার সম্পূর্ণ আর্কাইভ রক্ষণাবেক্ষণ করছে। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও কোলকাতা সঙ্গীত ভবন মান্নাদে’র সঙ্গীত সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে।
পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ ও দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
(দিরিপোর্ট২৪/ওএস/ডব্লিউএস/অক্টোবর ২৪, ২০১৩)