ইস্যু কিল ইস্যু
রানা হানিফ
মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিডিআর বিদ্রোহ, বসুন্ধরা সিটিতে আগুন, হলমার্ক ও সুরঞ্জিতের ঘুষ কেলেঙ্কারি, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড, ইলিয়াস আলী গুম, পদ্মাসেতু দুর্নীতি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির মতো ঘটনাগুলো ঘটার পর পরই তা জনমনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। আর এসব ঘটনার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জনগণকে কৌতুহলী করেছে দেশের গণমাধ্যমগুলো।
প্রতিটি গণমাধ্যম এসব ঘটনাকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কাভার করলেও বিষয়বস্তু ছিলো একই। আর এসব ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে হুমকির মুখে পড়তে থাকে। কিন্তু একটি ঘটনার রেশ মিডিয়াতে থাকতে না থাকতেই অন্য আরেকটি ঘটনা ঘটে। এতে করে প্রথম ঘটনাটির শেষ পরিণতি আর জানা হয় না মানুষের। আর আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোও নিজেদের ব্যবসায়িক অস্তিত্ব ধরে রাখতে নতুন ঘটনার পেছনেই ছুটতে থাকে। এতে করে পুরাতন ঘটনাটি পুরাতনই থেকে যায়।
বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে এমন ঘটনা বার বার ঘটতে থাকলেও কয়েকটি উল্লেখ না করলেই নয়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক ‘বিপুল’ পরিমাণ ঘুষের অর্থসহ ধরা পড়ার পর ঘটনাটি নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সকল গণমাধ্যমই বিষয়টিকে রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে থেকে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের চেষ্টা করে। আর সরকারের প্রভাবশালী একজন মন্ত্রীর অর্থ কেলেঙ্কারি নিয়ে জনগণের কৌতুহলেরও কমতি ছিলো না। কিন্তু ঘটনাটির শেষ পরিণতির আগেই গুম হন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী। আর তখন গণমাধ্যমগুলো বেমালুম ভুলে যায় রেলের অর্থ কেলেঙ্কারির বিষয়টি।
আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকায় সফরকালে একই সঙ্গে ঢাকায় অবস্থান করে লিওনেল মেসির আর্জেন্টাইন ফুটবল দল। রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক বিশ্লেষকরা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘গোপন’ বা ‘দেশবিরোধী’ চুক্তি হতে পারে এমন কথা বললেও জনগণের নজর আটকে ছিলো মেসির দিকে। আর এতে করে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি মার খায় বিনোদনের কাছে।
কাকতালীয়ভাবে ঘটনাগুলো ঘটলেও অনেকেই মনে করেন ‘আওয়ামী লীগ গভর্মেন্ট কিলিং দ্য ইস্যুজ বাই দ্য ইস্যুজ’। এ যেন ইস্যুজ আর কিলিং ইস্যুজ।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জনগণের উদ্বেগ, উৎকন্ঠার শেষ নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থার শেষ পরিণতি কি হতে চলেছে তা নিয়েই ব্যস্ত গণমাধ্যমগুলো। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোও বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে ‘নাক গলাতে’ শুরু করেছেন। অবশেষে জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকা সফরে এসে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনায় বসছেন একটি সমঝোতা ও সমাধানের পথ খুঁজতে। দেশের গণমাধ্যমগুলোও এ নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। সবার নজর রাজধানীর বানানী-বারিধারার কূটনৈতিক পাড়ায়। ঠিক এমন সময় সরকারের স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা আসে ১০ ডিসেম্বর রাত ১২টা এক মিনিটে ফাঁসির রায় কার্যকর করা হবে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার। গণমাধ্যমকে জানিয়ে এভাবে ‘ঢাকঢোল পিটিয়ে’ কোনো ফাঁসির আসামির রায় কার্যকর করাটা ‘বিরল’ বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকরের ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগণের দাবি সবসময়। আর যখন সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত আসে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হবে, ঠিক তখনই সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে কৌতুহলও বেশ দেখা যায়। অনেকেই অবস্থান নেয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকে। যারা নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে জেলগেটে যাননি তারা চোখ রেখেছেন টেলিভিশন ও অনলাইন গণমাধ্যমগুলোতে।
কারাফটকের চিত্র ও অবস্থা প্রচারে একদিকে যেমন ব্যস্ত গণমাধ্যমগুলো ঠিক তেমনি একই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমগুলো ব্যস্ত ছিলো বিচারপতি মাহমুদ হোসেনের বাসার সামনে।
কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে এমন সংবাদ ইতোমধ্যে প্রথম সংস্করণে ছেপে তা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেয় জাতীয় বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা। কিন্তু ফাঁসির রায় কার্যকরের ঠিক দুই ঘণ্টা আগে ঘটে যায় ভিন্ন ঘটনা। সুপ্রিমকোর্টের চেম্বার আদালতের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন রাত সাড়ে দশটার দিকে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের উপর স্থগিত আদেশ দেন। মঙ্গলবার রাতে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা কাভার করতে গণমাধ্যমগুলোর ছিলো একধরনের প্রতিযোগিতা। কে কার আগে সর্বশেষ খবরটি পৌঁছাতে পারে জনগণের কাছে।
আশ্চার্যজনক হলেও সত্য, মঙ্গলবার বিকেল ৫টা পর্যন্তও গণমাধ্যমগুলো ব্যস্ত ছিলো দেশের রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতিসংঘ দূত তারানকোকে নিয়ে। যখনই আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা এলো কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হবে ঠিক তখনই কাভারেজ কমে যায় তারানকো ইস্যুর। আর কাদের মোল্লার ফাঁসি নিয়ে যখন সবাই ব্যস্ত তখন গুলশান, বনানী, বারিধারাতে চলছিলো বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা, ‘দরকষাকষি’, ও সমঝোতার চেষ্টা। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার ইভেন্টটি বেশি ভেল্যু (সংবাদমূল্য) বহন করে তাই গণমাধ্যমগুলো ওই ইভেন্টটিকে বেশি কাভারেজ দিতে থাকে। আর জনগণেরও দৃষ্টি তখন কাদের মোল্লার রায় কার্যকরের দিকে। কিন্তু ঠিক ওই মুহূর্তে বারিধারা, বনানীতে কি হচ্ছে তা নিয়ে কোনোই ‘মাথা ব্যথা’ ছিলো না জনগণের। বুধবারের সকল পত্র-পত্রিকায় প্রধান শিরোনামে ছাপা হয় কাদের মোল্লার ফাঁসি ও তা স্থগিত হওয়ার খবর। কিন্তু তারানকোর উদ্যোগের ‘ব্যর্থতার’ খবর ছাপা হলেও তা চাপা পড়ে যায় কাদের মোল্লা ইস্যুর কাছে।
পুরো ঘটনা প্রবাহের পর চায়ের টেবিলে, অফিসের ডেস্কে আলোচনা হতে থাকে বিষয়টি নিয়ে। তবে অনেকেই আবার বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করছেন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। অনেকেই মনে করছেন কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের নাম করে সরকার জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে নিতে একটি ‘নাটক’ সাজিয়েছে। আর কাদের মোল্লার ফাঁসির ইস্যুটি গণমাধ্যমকে কম করে হলেও এক সপ্তাহ ‘গরম’ রাখতে পারবে এমনটিও ধারণা সাধারণ মানুষসহ বিশিষ্টজনদের। অনেকেই মন্তব্য করছেন নির্বাচনকালীন সংকট নিয়ে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতেই সরকার এমন ‘ছলচাতুরির’ আশ্রয় নেয়। আর কাদের মোল্লার ইস্যুটির সঙ্গে আরো ঘটনা প্রবাহ মিশিয়ে সরকার একটি মাস পার করতে পারলেই বিনা বাঁধায় আগামী নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারবে বলেও মনে করছেন অনেকে।
একই সঙ্গে কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ‘জামায়াত-শিবিরের’ তাণ্ডবও সরকারের জন্য অনুকুল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দিবে এবং তা আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে এমনটিও ভাবনার মধ্যে রয়েছে। মোটামুটি ক্ষমতায় যাওয়ার প্রচেষ্টা থেকেই সরকার একের পর এক ইস্যুকে চাপা দিচ্ছে নতুন ইস্যু দিয়ে এমনটিই ভাবছেন অনেকেই।
লেখক : সাংবাদিক