দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের নায়ক আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জন্ম ২০ ডিসেম্বর ১৮৮০। মৃত্যুবরণ করেন ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬ সালে। দেশের মানুষের কাছে তিনি 'মজলুম জননেতা' হিসাবে অধিক পরিচিত ছিলেন।

আবদুল হামিদ খান ভাসানী জীবদ্দশায় ১৯৪৭ সালে সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রাজনৈতিক জীবনের বেশীরভাগ সময় তিনি মাওপন্থী কমিউনিস্টের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার অনুসারীদের কাছে তিনি এই কারণে ‘লাল মওলানা’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জন্ম সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে। তার পিতার নাম হাজী শরাফত আলী খান। শিক্ষা জীবন শুরু মক্তবে। পরবর্তীতে কিছুদিন তিনি মক্তবেই শিক্ষকতা করেন। ১৮৯৭ সালে পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীনের সঙ্গে আসামে যান। ১৯০৩ সালে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯০৭ সালে তিনি ইসলামী শিক্ষার উদ্দেশ্যে দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ সফরকালীন ভাষণ শুনে ভাসানী অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ১০ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জনের স্বরাজ্য পার্টিকে তিনি সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এখান থেকে তার নাম হয় ‘ভাসানীর মাওলানা’। এরপর থেকে তার নামের শেষে ‘ভাসানী’ শব্দ যুক্ত হয়।

১৯৩১-এ সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩-এ গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলীম লীগে যোগ দেন। ১৯৪০ সালে শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলীম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলীম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৫-৪৬ সালে আসাম জুড়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ‘বাঙ্গাল খেদাও’ আন্দোলনের সময় বাঙালিদের রক্ষার জন্য ভাসানী বারপেটা, গৌহাটিসহ আসামের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ান। পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৯৪৭ সালে আসামে গ্রেফতার হন। ১৯৪৮ সালে মুক্তি পান। এরপর তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে আসেন। ১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। মুসলিম লীগ দলের সদস্য হয়েও সরকারের সমালোচনা করায় মুসলিম লীগের ক্ষমতাসীন সদস্যরা তার ওপর অখুশী হয়ে তাকে নানাভাবে হয়রানি করতে থাকে। পরিশেষে মওলানা ভাসানী পদত্যাগ করেন। ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে পূর্ববঙ্গে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ১১ অক্টোবর আরমানীটোলায় অনুষ্ঠিত জনসভায় খাদ্য সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার জন্য পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করা হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মওলানা ভাসানী ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। এ কারণে ১৯৪৯-এর ১৪ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাবরণ করেন।

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা জেলার বার লাইব্রেরীতে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামক নির্বাচনী মোর্চা গঠন করেন। ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্ণরের শাসন জারি করে এবং মাওলানা ভাসানীর দেশে প্রত্যাবর্তনের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। ১১ মাস লন্ডন, বার্লিন, দিল্লী ও কলকাতায় অবস্থান করার পর তার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে ১৯৫৫ সালের ২৫ এপ্রিল দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের খসড়া শাসনতন্ত্র বিলে পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা দেওয়া হলে মাওলানা ভাসানী পল্টনের জনসভায় তার বিরোধিতা করেন৷

১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই তার নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' (ন্যাপ) গঠিত হয়। ১৯৫৭ সালের ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হলে ১২ অক্টোবর মাওলানা ভাসানীকে কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকায় ৪ বছর ১০ মাস কারারুদ্ধ থাকেন।

১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে আইয়ুব খানের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। একই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর চীনের বিপ্লব দিবস-এর উৎসবে যোগদানের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচীর বিরোধিতা করেন। ১৯৬৭ সালের ২২ রেডিও ও টেলিভিশন থেকে থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধের নির্দেশ জারি করলে এর প্রতিবাদ করেন।

১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় 'স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান' দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলন এর প্রতি সমর্থন প্রদান করেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয় যার সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী।

রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সমাজ সংস্কারমূলক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন।

তার প্রকাশিত গ্রন্থ

* দেশের সমস্যা ও সমাধান (১৯৬২)
* মাও সে তুং-এর দেশে (১৯৬৩)

১৯৭৬ সালের ১৬ই মে তিনি গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবীতে ফারাক্কা লংমার্চের নেতৃত্ব দেন। ফারাকা লং মার্চের মাধ্যমে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী জাতীয় দুর্দিনে কিভাবে আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হয়, সে পথ নির্দেশ রেখে গেছেন।

১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই দেশ বরেণ্য নেতা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে দাফন করা হয়। সারা দেশ থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ তার জানাযায় অংশগ্রহণ করে।

(দ্য রিপোর্ট/কেএম/এআইএম/ডিসেম্বর ১২, ২০১৩)