‘একেকটা গান ছিল বুলেটের মতো’
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রধান শিল্পী তিমির নন্দী। দীর্ঘ সঙ্গীতসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন নানা সম্মাননা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও নানা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন দ্য রিপোর্টের প্রতিবেদক মুহম্মদ আকবর। সাক্ষাৎকারের চৌম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
দ্য রিপোর্ট : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং আপনার সম্পৃক্ততার কথা বলুন।
তিমির নন্দী : ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে আসাদ শহীদ হওয়ার পর থেকেই আমরা এসব অপকর্মের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গণসঙ্গীত পরিবেশন শুরু করি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর। সেই সময় আমি ঢাকায় ছিলাম না। কুড়িগ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলাম। ঢাকায় আসতে না পেরে সেখানেই আমরা কয়েকজন মিলে পাকিস্তানিদের শোষণ-নিপীড়নের প্রতিবাদের প্রত্যয়ে গণসঙ্গীত গেয়ে বেড়াতে শুরু করি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করা।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটি অস্থায়ী বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পর এর নাম বদলে বাংলাদেশ বেতার করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা থেকে সম্প্রচার শুরু করে বাংলাদেশ বেতার, যা রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর মনোবলকে উদ্দীপ্ত করতে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিল। যুদ্ধের সময় প্রতিদিন মানুষ অধীর আগ্রহে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনার জন্য অপেক্ষা করত। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি এ বেতার কেন্দ্রের সূচনা সঙ্গীত হিসেবে প্রচারিত হতো।
১৯৭১ এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে ঢাকা শহরের কয়েক হাজার নিরস্ত্র বাঙালি নিধন করে এবং একই সঙ্গে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পূর্বে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা এবং একটি সংক্ষিপ্ত বার্তা প্রদান করে যান। বার্তাটি ঢাকা ইপিআর ওয়ারলেস স্টেশন থেকে সিলিমপুর ওয়ারলেস স্টেশনের ইঞ্জিনিয়ার গোলাম রব্বানী ডাকুয়ার হাত দিয়ে চট্টগ্রামে পৌঁছে ২৫ মার্চ মধ্যরাতেই। তার পরই পাকিস্তানিরা ইপিআর ওয়ারলেস ধ্বংস করে দেয়। ভোর হওয়ার আগেই বার্তাটির শত শত কপি তৈরি হয়ে যায় একটা সাইক্লোস্টাইল মেশিনের সাহায্যে। চট্টগ্রামের অনেক জায়গায় মধ্যরাত থেকেই মাইকে বার্তাটি প্রচার করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ দুপুর বেলা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান কালুরঘাট ট্রান্সমিশন কেন্দ্র থেকে প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ওই বার্তা পাঠ করেন।
এর মধ্যেই বেলাল মোহাম্মদ এবং আবুল কাশেম সন্দীপসহ তৎকালীন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন বেতারকর্মী সিদ্ধান্ত নেন যে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে তারা বেতারের মাধ্যমে কিছু প্রচার করবেন। এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তারা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রকে কাজে লাগানোর চিন্তা করেন এবং তার নতুন নাম দেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’। তবে তারাও নিরাপত্তার কারণে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রকে কাজে না লাগিয়ে শহর থেকে কিছু দূরে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে চলে যান এবং ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে প্রথম প্রচার করেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। পাকিস্তানপন্থী দুর্বৃত্তদের হাতে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র বিপর্যস্ত হলে প্রতিষ্ঠাতা ১০ জন সদস্য দুটি দলে বিভক্ত হয়ে আগরতলা ও ত্রিপুরার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ৫৭/৮নং দোতলা বাড়িটিতে রাষ্ট্রপতি ও অন্যান্য মন্ত্রীদের আবাসকক্ষের পাশের একটি কক্ষে ওেই ট্রান্সমিটার দিয়ে সম্প্রচার শুরু হয়। রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীরা অন্য বাড়িতে উঠে যাওয়ার পর সেই ৫৭/৮ নম্বর বাড়িটিই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্থায়ী কার্যালয়রূপে গড়ে ওঠে। এরপর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান নিয়মিতভাবে সম্প্রচারিত হতে থাকে। সে সময়টার পরিস্থিতি তো বক্তব্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করা যাবে না। ওই সময় হানাদার বাহিনী দেশের শিশু, সন্তান-সম্ভবা নারীসহ সাধারণ জনগণকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অমানবিক অপকর্ম দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম আমিও যুদ্ধে যাবো। প্রথমে মা নিষেধ করেন কিন্তু পরে যখন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি শিশুর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ছবিটি দেখালাম। তখন মা বললেন, ‘যাও তবে যেহেতু গান গাইতে পার সেক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দাও’ ব্যাস মার অনুমতি নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দেই।
দ্য রিপোর্ট : সে সময় যে গানগুলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতো, তা মানুষের মনে কী রকম প্রভাব ফেলত?
তিমির নন্দী : আসলে বেতার কেন্দ্রের একেকটা গান ছিল একেকটা বুলেটের মতো। আমি মনে করি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এ কার্যক্রম মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
দ্য রিপোর্ট : শিল্পী হিসেবে আপনার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে জানতে চাই।
তিমির নন্দী : সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো, যে স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গিয়েছিলাম তার বাস্তবায়ন হিসেবে একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। এমন একটি মহৎ কাজের সদস্য হতে পেরে আমি গর্বিত। আমার বড় প্রাপ্তির জায়গা এটাই।
আর বেদনার কথা কিংবা অপ্রাপ্তির ব্যাপারটা হলো কোনো সরকারই এ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কোনো শিল্পীকে সম্মাননা দেয়নি। অন্যভাবে যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের মতো কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের কোনো ভাতা দেওয়া হয় না। অথচ আমাদের মনে রাখা উচিত যে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রই ছিল দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম তৎপরতা। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে অবদান রাখার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষকে সম্মাননা দিচ্ছে- এটা খুব আনন্দের কথা, গর্বের কথা। ঠিক সেভাবে দেশের সব মুক্তিযোদ্ধাদের সারা বছরব্যাপী সময় নিয়ে যদি সম্মাননা দেওয়া হয় তবে সবার মনে যে নানা ক্ষোভ আছে তা অনেকাংশই কমে যেত। আমার ভাষ্য হলো, সারাজীবন দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে আমরা সঙ্গীত পরিবেশন করি কিন্তু রোগে-শোকে সাহায্যের জন্য কেন মানুষের দুয়ারে গিয়ে দাঁড়াতে হয়? এটার পরিবর্তন হওয়া দরকার।
দ্য রিপোর্ট : একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক, বর্তমানে সঙ্গীতাঙ্গনে তরুণ যারা গাইছেন, তাদের প্রতি আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি?
তিমির নন্দী : এক্ষেত্রে আমি বলব, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও ক্রিয়াসিদ্ধ সঙ্গীত সব স্থানেই কিন্তু চর্চার প্রয়োজন। অধ্যবসায় ও নিষ্ঠা ছাড়া সঙ্গীত আত্মস্থ করা যায় না। সেই সঙ্গে নন্দনতত্ত্বের একটা বড় শিল্প হিসেবে সঙ্গীতের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকা চাই।
(দ্য রিপোর্ট/এমএ/এমসি/শাহ/এইচএসএম/ডিসেম্বর ১২, ২০১৩)