দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতের মধ্যস্থতায় সরকারি দল আলোচনায় বসতে সম্মত হওয়ায় দেশবাসীর মধ্যে নতুন আশা সঞ্চার হয়েছে। আমি আশা করি, দেশের মানুষের প্রত্যাশাকে তারা বিবেচনায় নেবে এবং একগুঁয়েমি প্রত্যাহার করে শান্তি ও সমঝোতার পথে এগুবে।’

দেশের চলমান পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে এক বিবৃতিতে বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘দেশ-জাতি আজ সর্বগ্রাসী এক গভীর সংকটে নিপতিত। চলমান পরিস্থিতির বিষয়ে দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ আমাদের বক্তব্য ও দাবির প্রতি সমর্থন, একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করেছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় সরকার জনমতকে গ্রাহ্য করেনি। ক্ষমতাসীনদের এ অনঢ় মনোভাব, এ ফ্যাসিবাদী আচরণ, নির্মম দমননীতি এবং জনগণের সমর্থনও অনুমোদন ছাড়াই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উদগ্র আকাঙ্ক্ষাই দেশকে চরম নৈরাজ্যকর ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিক্ষেপ করেছে। সরকারের চরম হঠকারিতার কারণেই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আজ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতেও ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমি এ প্রসঙ্গে অভিনন্দন জানাই জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনকে। তিনি বাংলাদেশে বিরাজমান সংকট নিরসনে দীর্ঘদিন ধরে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন। তিনি সর্বশেষে তৃতীয় দফায় তার বিশেষ দূত হিসেবে রাজনীতি বিষয়ে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে পাঠিয়েছেন। আমি যুক্তরাষ্ট্র সরকার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, গণচীন ও জাপান সরকারসহ বিভিন্ন বন্ধু দেশের সরকারকে ধন্যবাদ জানাই, তারাও এ সংকট নিরসনে সমঝোতার আহ্বান অব্যাহত রেখেছেন।’

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ ভারতের সরকার ও জনগণের প্রতিও আমার আহ্বান, তারাও যেন বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যক জনগণের অনুভূতি, দাবি ও মনোভাবের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের অবস্থানের সঙ্গে একাত্ম থাকেন।’

‘বাংলাদেশে আজ গণতন্ত্রের নাম-নিশানা মুছে দিয়ে চরম স্বৈরাচারী এক ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন জগদ্দল পাথরের মতো জাতির ওপর চেপে বসেছে। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার স্বপ্ন বিলীন হয়ে গেছে। এর ওপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এ বিচার ব্যবস্থা নিয়ে আজ উত্থাপিত হচ্ছে গুরুতর প্রশ্ন। সংবাদ মাধ্যম আজ শৃঙ্খলিত। সংবাদ, টকশো, মতামত নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বেআইনিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেল। চলছে সরকারের পক্ষে প্রায় একতরফা প্রচারণা। বিরোধী দল ও জনগণের শান্তিপূর্ণভাবে মতামত প্রকাশের এবং প্রতিবাদ জানাবার সব সুযোগ ও পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বিএনপিসহ প্রায় সব বিরোধী দলের সদর দফতর এবং কার্যালয়গুলো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। মিথ্যা অভিযোগে বিরোধী দলের সিনিয়র নেতাদের আটক করে রাখা হয়েছে। সারাদেশে নেতাকর্মীদের ওপর চলছে হত্যা, গুম, নির্যাতন ও দমন-পীড়ন। সরকার নিজেই সারাদেশে এক চরম অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে’ বলেন খালেদা জিয়া।

তিনি বলেন, ‘দেশের শিল্প-বাণিজ্য-অর্থনীতি আজ স্থবির। সুপরিকল্পিত চক্রান্ত ও নাশকতায় বিকাশমান তৈরি পোশাক খাত আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। সরকারের একগুঁয়েমি এবং ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উদগ্র বাসনার কারণেই আজ সর্বক্ষেত্রে এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, আজ আবারও বলছি, আমাদের আন্দোলন ও কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক। নিরপরাধ কোনো সাধারণ নাগরিক কোনোক্রমেই যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে আমাদের প্রতিটি নেতাকর্মীকে সবসময় সচেতন থাকতে হবে। জনগণই আমাদের শক্তির উৎস। তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে সাফল্যের পথে এগিয়ে নিতে হবে।’

বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ বিপুলভাবে আমাদের সমর্থনে রয়েছেন, তা আমাদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। এখনো শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিলে ও নিষ্ঠুর নির্যাতন বন্ধ করলে মানুষের যে ঢল রাজপথে নামবে তা সৃষ্টি করবে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস। সরকার তা জানে এবং তারা একথাও জানে যে, সব দলের অংশগ্রহণে একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে দেশবাসী তাদের কীভাবে প্রত্যাখ্যান করবে। সে কারণেই তারা সমঝোতার পথ এড়িয়ে সংঘাত ও বলপ্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছে। সব দলকে বাইরে রেখে একতরফা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এক নির্বাচনী প্রহসনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে তারা। মহাজোটের শরীক এরশাদের জাতীয় পার্টিও এ তথাকথিত নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ইতোমধ্যেই সরে দাঁড়ানোর ফলে পুরো প্রক্রিয়াটিই আজ হাস্যকর প্রহসনে পরিণত হয়েছে।’

খালেদা জিয়া বলেন, ‘নির্বাচন মানেই হচ্ছে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতা। যে নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, সেটা কোনো নির্বাচন নয়। অথচ সংবিধানের বিতর্কিত পঞ্চদশ সংশোধনীর দোহাই দিয়ে সরকার সেই প্রহসনের মাধ্যমেই তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে চাইছে। আর এর প্রতিবাদে সারাদেশে মানুষ আন্দোলন করছে। এদিকে আন্দোলনরত মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে মারা হচ্ছে। প্রতিদিন ক্ষমতার লোভে রঞ্জিত হচ্ছে সরকারের হাত। সরকারের পৈশাচিক দমন-পীড়ন এবং এর বিরুদ্ধে জনগণের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে জনজীবন আজ স্থবির হয়ে পড়েছে। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। অচলাবস্থার কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ সরকার নির্বিকার ও অনড়। দেশের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সবাই অনুভব করলেও সরকার বলছে, সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। এটা কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মনোভাব হতে পারে না।’

তিনি বলেন, ‘আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন এখনো প্রহসনের নির্বাচনের তফশিল স্থগিত করেনি। বিরোধী দলের অবরুদ্ধ অফিস ও বন্ধ সংবাদ-মাধ্যমগুলো এখনো খুলে দেওয়া হয়নি। এখনো শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি। এখনো আন্দোলনকারীদের প্রাণসংহার ও রক্ত ঝরানো বন্ধ হয়নি। এ বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করে সংলাপ ও সমঝোতার পথ প্রশস্ত করার জন্য আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।

খালেদা জিয়া বলেন, ‘দেশবাসীকে আমি বলবো, জনগণের দাবিকে পাশ কাটাতে সরকার উস্কানি, অন্তর্ঘাত, নাশকতা ও অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ওপর হামলা, আলেম সমাজের ওপর নিপীড়ন এবং নিরপরাধ মানুষকে অন্তর্ঘাতের মাধ্যমে হত্যা করে পরিস্থিতির মোড় ঘুরাবার অপচেষ্টা তারা বারবার করছে। এ ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। হঠকারিতার আশ্রয় নিয়ে উস্কানিমূলক বিভিন্ন ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের উদ্দেশ্য নিয়েও তারা অপপ্রচার চালাচ্ছে। অতীতেও এভাবে গণআন্দোলনকে বিপথগামী করার অপচেষ্টা সফল হয়নি। বর্তমান সরকারও সফল হতে পারবে না ইনশা আল্লাহ।’

বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘আজ লক্ষ্মীপুরে যাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যারা ইতোমধ্যে আত্মাহুতি দিয়েছেন আমি সেই সব শহীদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। তাদের স্বজনদের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সমবেদনা জানাচ্ছি। আহত ও নির্যাতিত হাজার হাজার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের প্রতি জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সহমর্মিতা।’

খালেদা জিয়া বলেন, ‘সংকট থেকে দেশ-জাতির মুক্তির জন্য, গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারের সুরক্ষা এবং শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা আন্দোলন করছি। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর ও জনগণের পছন্দসই একটি সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এ সংগ্রাম তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাবে। আমি শান্তিপূর্ণ এ আন্দোলনে দেশবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণ কামনা করি।’

(দ্য রিপোর্ট/টিএস-এমএইচ/এনডিএস/ডিসেম্বর ১২,২০১৩)