চার ইচ্ছা পূরণ হয়নি কাদের মোল্লার
জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার শেষ চার ইচ্ছা পূরণ হয়নি। পরিবারের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার রাতে শেষ সাক্ষাতে আইনজীবীদের সাক্ষাৎ, মৃত্যুর পর জানাজা পড়াবেন বড় জামাতা, পবিত্র ওমরার কাপড় দিয়ে তার লাশ দাফন এবং দুই ছেলে ও ৩ মেয়ের জামাই কবরে লাশ নামাবেন এমন চারটি ইচ্ছার কথা জানান স্বজনদের কাছে।
কাদের মোল্লার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১ মিনিটে ফাঁসির রায় কার্যকরের প্রায় ৩ ঘণ্টা আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে সোয়া ৭টা পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেষ কথা হয় কাদের মোল্লার। এ সময় স্ত্রী সানোয়ারা জাহান, ২ পুত্র হাসান জামিল, হাসান মওদুদ ও ৪ মেয়েসহ পরিবারের মোট ১০ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
কাদের মোল্লার সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাতের সময় এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছেন ছোট ছেলে হাসান মওদুদসহ পরিবারের কয়েক সদস্য। এ সময় অন্যদের মতো কাদের মোল্লাও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
রাত ১০টা ১ মিনিটে তার ফাঁসির রায় কার্যকর হবে এটা নিশ্চিত ছিলেন না কাদের মোল্লা। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যেকোনো সময় ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হবে তাকে। তাই জীবন সায়াহেৃ দাঁড়িয়ে স্বজনদের কাছে ৩টি অসিয়ত (নির্দেশনা) ও একটি ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন কাদের মোল্লা।
প্রথমে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, ‘শুধুমাত্র রাজনৈতিক হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সরকার আমাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলাচ্ছে। আইনের সব রাস্তাই বন্ধ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপতির কাছে মার্সি পিটিশনের সময় এখনও আছে।’
মার্সি পিটিশন করবেন কী করবেন না- এ ব্যাপারে তিনি তখনও কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানাননি। তবে শেষ মুহূর্তে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলতে চান তিনি। পরবর্তীতে কাদের মোল্লার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের কাছে তার এ ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন বড় ছেলে হাসান জামিল।
সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আইনজীবীদের একটি প্রতিনিধি দল জেল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু সে আবেদন গ্রহণ করেনি কর্তৃপক্ষ। ফলে তার ইচ্ছাপূরণ হয়নি।
তার ৩টি অসিয়তের মধ্যে একটি ছিল মৃত্যুর পর বড় জামাতা তার জানাজা পড়াবেন, তিনি যে ওমরা করেছেন, সেই ওমরার কাপড় দিয়ে যেন তার লাশ জড়ানো হয় (কাফনের কাপড় হিসেবে) এবং অন্যটি ছিল- তার দুই ছেলে যেন তার লাশ কবরে নামান। এ ৩টি অসিওয়তের একটিও পূরণ হয়নি কাদের মোল্লার।
কাদের মোল্লার বড় ছেলে হাসান জামিল ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, রাত পৌনে ১০টার দিকে ফরিদপুরের উদ্দেশে রওয়ানা হন পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু, বাসার নিচে সরকারদলীয় লোকজনের হামলার শিকার হন তারা। জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজন আমাদের ওপর হামলা চালায়, পুলিশও লাঠিচার্জ করে। এতে তারা ২ ভাই-ভগ্নিপতিসহ ৬-৭ জন আত্মীয়স্বজন আহত হন। আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় ১১ জনকে। যদিও পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কয়েকজন গুরুতর আহত হন। তাদের চিকিৎসা দিতে হয়েছে। এভাবেই রাত গভীর হয়ে যায়। ততক্ষণে মরদেহ পৌঁছে যায় গ্রামের বাড়িতে।
হাসান জামিল বলেন, ‘এ অবস্থায় আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলাম। বিশেষ করে আমার মা-বোনসহ মহিলারা আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। তাই শেষ পর্যন্ত আর গ্রামে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আমরা আব্বুকে মাটি দিতে পারিনি।’
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার আমার আব্বুর লাশ ফরিদপুরে নিতে নিরাপত্তা দিয়েছে। কিন্তু আমাদের কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেনি।’
কাদের মোল্লার ছেলে বলেন, ‘জীবিত অবস্থায় আব্বু ন্যায়বিচার পাননি। মৃত্যুর পরও তার সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে। তার কোনো অসিয়তই পূরণ করতে দেওয়া হয়নি। আমাদের ন্যূনতম মানবিক অধিকারটুকুও দেওয়া হয়নি। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তিনি যে অসিয়ত করেছিলেন আমরা তা পূরণ করতে পারিনি। দেশে যে আইনের শাসন নেই তার বড় প্রমাণ এটি।’
হাসান জামিল বলেন, ‘রাত ৩টার দিকে বাবার লাশ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে। সেখানে আমার ছোট চাচা স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মাইনুদ্দিন মোল্লা বাবার লাশ গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাপ দেওয়া হয় তাড়াতাড়ি লাশ দাফনের জন্য। বাড়ির উঠানেই রাত সাড়ে ৩টার দিকে তড়িঘড়ি করে জানাজা পড়িয়ে কবরস্থ করা হয়।’
কাদের মোল্লার ছোট ছেলে হাসান মওদুদ লেখাপড়ার জন্য মালয়েশিয়ায় থাকতেন। বাবার সঙ্গে শেষ দেখা করতে ৪ দিন আগে দেশে এসেছেন তিনি। বৃহস্পতিবার বাবার সঙ্গে শেষ দেখা ছিল হাসান মওদুদের। তাই আবেগ ছিল অন্যদের চেয়ে একটু বেশি। অনেক দিন পর বাবার সঙ্গে দেখা। তবে স্বাভাবিক দেখা নয়, জীবনের শেষ দেখা। তাই কান্না ধরে রাখতে পারেননি হাসান মওদুদ। হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছেন বাবাকে ধরে। অন্যদিকে কাদের মোল্লাও ছেলেকে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
বড় ছেলে হাসান জামিলকে কয়েকটি পরামর্শ দেন কাদের মোল্লা। তার ওপরই সংসারের দায়িত্ব তুলে দেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘তুমি সবার সঙ্গে সমন্বয় করে আমার দাফন কাফনের ব্যবস্থা করবে। সবাই যেন ইসলামের পথে থাকে সেজন্য পরিবারকে গড়ে তুলবে।’ সবশেষে তিনি সবাইকে সালাম দিয়ে আল্লাহ হাফিজ বলে বিদায় জানান। এ তথ্য জানান হাসান জামিল।
(দ্য রিপোর্ট/কেএ/শাহ/এইচএসএম/ডিসেম্বর ১৩, ২০১৩)