বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলা
দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে দেশে আনার উদ্যোগ নেই
বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামিকে ফিরিয়ে আনতে সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা কূটনৈতিক তৎপরতার কথা বললে, মূলত কোনো অগ্রগতি নেই। বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার রায়ে আলবদর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। দু’জনই বর্তমানে বিদেশে আছেন।
এ বিষয়ে জানতে প্রধানমন্ত্রীর আইন উপদেষ্টা শফিক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আসামিদের ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। তিনি এ দুই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
যোগাযোগ করা হলে শুক্রবার বিকেলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু দ্য রিপোর্টকে বলেন, বুদ্ধিজীবী ও বঙ্গবন্ধু হত্যার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিকভাবে আমরা তৎপরতা চালাচ্ছি। একইভাবে এ বিষয়ে ইন্টারপোলেরও সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।
তবে মুক্তিযোদ্ধাসহ বিশিষ্টজনেরা জানিয়েছেন, সরকার মুখে কূটনৈতিক তৎপরতার কথা জানালেও পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। বঙ্গবন্ধুর দণ্ডপ্রাপ্ত খুনিদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও কোনো অগ্রগতি নেই সরকারের। এক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতার কথা বলছে তারা।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সিনিয়র সহ-সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহ দ্য রিপোর্টকে বলেন, পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে কোনো উদ্যোগ আমরা দেখছি না। আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায় বাস্তবায়ন করতে সরকারের সবটুকু সামর্থ্য কাজে লাগানোর দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ওইসব দেশের সঙ্গে জোরালোভাবে আলোচনা চালাতে হবে সরকারকে।
কূটনৈতিক তৎপরতা বললেই হবে না। কাজের মাধ্যমে তা দেখাতে হবে।
স্বাধীনতার পরপরই বুদ্ধিজীবী হত্যার দুই আসামি বিদেশে পালিয়ে যান। জানা গেছে, মুঈনুদ্দীন বর্তমানে যুক্তরাজ্যে আছেন। তিনি সেখানে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের মুসলিম স্পিরিচুয়াল কেয়ার প্রভিশনের পরিচালক। অপরদিকে আশরাফুজ্জামান থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। তিনি সেখানে ইসলামিক সার্কেল অব নর্থ আমেরিকার (আইসিএনএ) শুরা সদস্য।
স্বাধীনতার ২৫ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় রমনা থানায় প্রথম মামলা করা হয়। ওই হত্যা মামলায় আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে আসামি করা হয়। মামলাটি দায়ের করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের বোন ফরিদা বানু।
নানা চড়াই উৎরাই পার হয়ে অবশেষে শেষ হয় মামলাটি। গত ৩ নভেম্বর চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে ফাঁসির আদেশ দেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলায় দুই জনের বিরুদ্ধে আনা ১১টি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলায় একাত্তরে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল ১১টি অভিযোগে।
২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানীদের অতর্কিত হামলার শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয়ের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পাক-হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলসামস বাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশকে পঙ্গু করে দিতে ষড়যন্ত্র করছিলো। এজন্য তারা দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা মূলত ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সংঘটিত হলেও সারা বছরব্যাপী তা বিস্তৃত ছিল।
১৪ ডিসেম্বর স্বাধীনতার মাত্র দুই দিন আগে নিমর্মভাবে হত্যা করা হয় ৯৯০ জন প্রখ্যাত শিক্ষক, ১৩জন সাংবাদিক, ৫০জন চিকিৎসক, ৫০জন আইনজীবী ও ১৮ জন লেখক, প্রকৌশলীসহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবীকে।
হত্যার শিকার বিশিষ্টজনদের মধ্যে রয়েছেন, সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীন, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, ড. মো. মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরীসহ আরো অনেকে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের মরদেহ পরে রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া গেছে, কয়েকজনের মরদেহ পাওয়া যায়নি।
এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী পাকিস্তানী সামরিক জান্তার পক্ষে ছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। আর তাকে তালিকা প্রস্তুতিতে সহযোগিতা ও হত্যাকাণ্ডে বাস্তবায়নের পেছনে ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামীর গঠিত কুখ্যাত আলবদর বাহিনী। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান ঘাতক ছিলো বদর বাহিনীর নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। ১৬ ডিসেম্বরের পর আশরাফুজ্জামান খানের নাখাল পাড়ার বাড়ি থেকে তার একটি ব্যক্তিগত ডায়েরি উদ্ধার করা হয়, যার দুটি পৃষ্ঠায় প্রায় ২০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কোয়ার্টার নম্বরসহ লেখা ছিল।
(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/নূরু/এইচএসএম/ডিসেম্বর ১৩, ২০১৩)