ভোট ছাড়াই জয়ী হচ্ছে নৌকা
মাহফুজ স্বপন ও রাজু হামিদ, দ্য রিপোর্ট : অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বাধিক সংখ্যক প্রার্থী আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথে। যাদের সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিংবা ১৪ দলের মনোনীত প্রার্থী।
সামান্য যে কয়েকটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে সেখানেও নেই শক্তিশালী কোনো বিরোধী পক্ষ।
ভোট নিয়ে অনেকেই বলাবলি করছে, সামনে আসছে নৌকা মার্কার নির্বাচন। এ নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির চেয়েও কম হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেক আসনে প্রতিপক্ষ প্রার্থীরও সংকট দেখা দিতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের দাবিতে শুরু থেকেই এই নির্বাচনের বিরোধিতা করে আসছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলগুলোর বড় একটি অংশ। শেষ পর্যায়ে এসে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল জাতীয় পার্টিও। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন দলটির মনোনয়নপত্র শেষ দিনেও প্রত্যাহার করেনি।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে ৪১টি। বিএনপি-জাপার সঙ্গে মোট ২২টি দল এই নির্বাচন বর্জন করেছে। যারা নির্বাচনে রয়েছে তাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন ১৪ দলের শরিক পাঁচটি। জাতীয় পার্টি (জেপি) ও বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে পরিচিত। বাকি দলগুলোর কারো সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৫ ডিসেম্বর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে এখন পর্যন্ত যথাসময়ে নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে ভোটারদের মাঝে।
প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় নির্বাচন নিয়ে তেমন আমেজ নেই আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝেও।
নির্বাচন কমিশনের শুক্রবার রাত ১০টা পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১০৯ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথে রয়েছেন। এর মধ্যে ৩৩ আসনে কোনো প্রার্থী না থাকায় আগেই নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন প্রার্থীরা। এরশাদের জাতীয় পার্টির (জাপা) নয়জন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জেপির দুইজন, ওয়ার্কার্স পার্টির একজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথে বাকিরা সবাই আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এছাড়া ঢাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন ৭ জন প্রার্থী।
কমিশন সচিবালয় সূত্র জানায়, প্রায় দেড়শ’ আসনে কমিশনকে নির্বাচন করতে হবে না।
একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘বিতর্কিত’ ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ২১ শতাংশ। ২৭৮টি আসন নিয়ে বিএনপি সরকার মাত্র দেড় মাস স্থায়ী হয়। এরপরেও ওই নির্বাচন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। শেষে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন পাস করে তার অধীনে আবার নতুন নির্বাচন দিতে হয়েছিল বিএনপিকে।
১৫ ফেব্রুয়ারির ওই নির্বাচনের চেয়েও এবার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা কম। ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৪৫০ জন, এবার ৭৪০ জন। শেষ পর্যন্ত প্রার্থীর সংখ্যা ৪শ’তে নেমে আসতে পারে বলে জানিয়েছে ইসি সচিবালয় সূত্র।
ওইবার বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল ৪৯টি আসনে ৪৮ জন। এবার আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ইতোমধ্যে বিনা বাধায় নির্বাচিত হয়েছেন ৩৩ জন। জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকলে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের সংখ্যা বেড়ে দেড়শতাধিকে পৌঁছবে। আবার জাতীয় পার্টি সরকারের সঙ্গে সমাঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রায় ২ শতাধিক প্রার্থী বিনা বাধায় নির্বাচিত হবেন।
জানা যায়, ২১৫ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পেয়েছে জাতীয় পার্টি। এর মধ্যে ১১৬টি আসনে জাতীয় পার্টির প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ, জাসদ কিংবা ওয়ার্কার্স পার্টি। জাতীয় পার্টি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিলে শরিকদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে একক প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে নৌকা প্রতীকের। এর বাইরে বেশ কয়েকটি আসনে প্রার্থী সংকট দেখা দিতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এমনটা ঘটলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকবে।
এ বিষয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘যা হচ্ছে তা নির্বাচন নয়, অনেকটা নির্বাচন নির্বাচন খেলা হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মাঝেও তেমন আগ্রহ নেই। আবার সাধারণ ভোটাররা অনেক বেশি ভীতসন্ত্রস্ত। যে কারণে এবার ভোটারদের উপস্থিতি ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির চেয়েও কম হবে বলে মনে হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কোনো কোনো আসনে শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংকট দেখা দিতে পারে। এমনটা ঘটলে নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।’
ইসি সচিবালয় সূত্র জানায়, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪টি রাজনৈতিক দলসহ ১ হাজার ৯১ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। ২ হাজার ১২৫ প্রার্থীসহ ২৯টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় সংসদ নির্বাচন। এতে ২৮টি দলের ১ হাজার ৫২৭ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৮ সালে। এতে ৯৭৭ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। রাজনৈতিক দল ছিল ৮টি। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম সংসদ নির্বাচন। এর প্রার্থী সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৭৮৭ জন, আর দল ছিল ৭৫টি। ১৯৯৬ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনটি ছিল সপ্তম সংসদ নির্বাচন। এতে অংশগ্রহণকারী দল ছিল ৮১টি। প্রার্থীর সংখ্যা ২ হাজার ৫৭২ জন। জোটগত রাজনীতি শুরু হওয়ার পর ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম সংসদ নির্বাচন। এতে ৫৫টি রাজনৈতিক দলের ১ হাজার ৯৩৯ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এতে নিবন্ধিত ৩৮টি দল থেকে ১ হাজার ৫৬৭ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
নির্বাচন নিয়ে নানা পক্ষের মাঝে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকলেও ঘোষিত তফসিলে অনড় রয়েছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়।
নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ বলেন, ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচন পেছানোর সুযোগ নেই। যথাসময়েই নির্বাচন করতে হবে।’
সবদলের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময়ই সবদলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছি।’
(দ্য রিপোর্ট/আরএইচ/সাদি/এইচএসএম/ডিসেম্বর ১২, ২০১৩)