রক্ত ও অভ্যুত্থানের গল্প
মনি হায়দার
রিফাত হোসেন বিছানায় উঠে বসে। বালিশের পাশে রাখা দুই ব্যাটারির টর্চ জ্বালায়। তাকায় ঘড়ির দিকে। রাত সাড়ে এগোরাটা। বিছানা থেকে নামে সে। হাই তোলে এবং আড়মোড়া ভেঙে লুঙ্গিটা শক্ত করে আবার কোমরের সঙ্গে বাঁধে। আলনা থেকে গামছাটা কাঁধে নেয়। টর্চ মেরে ঘরের কোণায় রাখা আগল আর কোদাল হাতে নেয়। দাঁড়ায় দরজার সামনে। নিঃশব্দে দরজাটা খুলে বাইরে নামে। হাতের আগল আর কোদাল মাটিতে নামিয়ে রেখে দরজাটা আস্তে করে লাগায়। কুরুৎ একটা শব্দ হয়। কান খাড়া করে রিফাত। না, কেউ শোনেনি। আবার আগল আর কোদাল হাতে নিয়ে সামনে হাঁটতে শুরু করে। তাকায় আকাশের দিকে। আকাশে চাঁদ নেই, তবে তারায় ভরা। আবছা হলেও পথঘাট দেখতে সমস্যা হচ্ছে না। চিরকালের নিজের বাড়ির পথ, গাঢ় অন্ধকারেও দেখতে পাবে সে। চোখে ভালোই দেখতে পাচ্ছে সে। উঠোন পার পার হয়ে রিফাত বাড়ির সামনের রাস্তায় আসে। সামান্য হেঁটে রাস্তা পার হয়ে কবরস্থানে ঢোকে। চারপাশটা আর একবার দেখে কবরস্থানের একেবারে মাথায় চলে আসে। একটা কবরের সামনে দাঁড়ায়।
কবরের মাটি অনেকটা নেই। গত তিন রাতে রিফাত প্রায় একশো আগল মাটি তুলে বাড়ির সামনের ছোট্ট খালে ফেলে দিয়েছে। আজকে রাতে আরও কয়েক আগল মাটি ফেলে দিতে পারলেই পুরো কবরটা উৎখাত করা সম্ভব হবে। কবরটা রিফাতের বাবা আমির হোসেনের।
বাবার কবরটাই অসহ্য হয়ে উঠেছে রিফাতের কাছে। বাড়িতে আসা যাওয়ার পথে কবরটা চোখে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে রিফাতের মনের ভেতরের একজন বলে, প্রতিদিন একজন বিশ্বাসঘাতকের কবর দেখছ তুমি।
-বিশ্বাসঘাতক!
নয়তো কী? মানুষ জন্মেই তার জন্মমাটির কাছে কৃতজ্ঞ থাকে। সেই মাটি ও মানুষের সম্মান ও কল্যাণের জন্য কাজ করে। প্রয়োজন হলে জন্মভূমির জন্য জীবন দেয়। আর তোমার বাবা মিস্টার আমির হোসেন কী করেছে?
রিফাতের মাথা নত হয়ে আসে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র সে। এখন কলেজে পড়াচ্ছে রাষ্ট্রবিজ্ঞান। বাংলা ও ইংরেজি ভাষার সকল রাষ্ট্রবিজ্ঞান সে পড়েছে। পড়ছে কারণ, সে একটা সূত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে, মাতৃভূমির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোনো সূত্র বা ব্যাখা পাওয়া যায় কি না? কিন্তু না, দেশ বা বিদেশের কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মাতৃভূমির স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার যুক্তি দেন নি।
-তাহলে?
-তাহলে কী? তুমিতো বইয়ের পাতায় পাতায় অনেক যুক্তি খুঁজলে। কী পেলে?
-কিছুই পেলাম না।
-সুতরাং
-আমি মায়ের কাছে আমার বাবা সর্ম্পকে জানতে চাই।
-ওকে, জানো।
মা?
রিফাত হোসেনের মা কোহিনূর বেগম রান্না করছে। তার বড় ছেলে বাড়ি এসেছে। দুই ছেলে আর এক মেয়ের মা সে। ছোট ছেলে ইসমাইল হোসেন বাজারে মুদির দোকান দিয়েছে। মেয়ে যমুনাকে বিয়ে দিয়েছে। যমুনার গর্ভে তিনটি ছেলে-মেয়ে। শ্বশুর বাড়িতে মেয়ে ভালোই আছে। বড় ছেলে রিফাতকে একটু ভয়ই পায় কোহিনূর। সব সময়ে পড়াশুনা নিয়ে থাকে। কত বড় বড় বই পড়ে! ইউনিভারসিটির পড়া শেষ করেছে। এখন একটি বেসরকারী কলেজের অধ্যাপক সে।
আমার বাবা আমির হোসেনকে কারা মেরেছে?
ছেলের প্রশ্নে কোহিনূর বেগম অবাক চেয়ে থাকে। তার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। ছেলে-মেয়েদের মানুষটা কত ভালোবসাতো। নিজের হাতে গোছল করাতো। পাশে বসাইয়া খাওয়াতো। তাকে কী কম ভালোবাসতো? কোনোদিন একটা খারাপ বা রাগের কথা বলতো না। কী যে হলো, মানুষটা চোখের সামনে রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে গেল। নিজের স্বামীকেও চিনতে পারছিল না কোহিনূর বেগম। হাইস্কুলের আরবির শিক্ষক ছিল মানুষটা। কী যে হলো দেশে আইলো যুদ্ধ!
যুদ্ধের আগে আইলো ইলিকশন। এই ইলেকশনই মানুষটাকে আমূল পাল্টে দেয়। সকালে উঠে চলে যেত মুসলিম লীগের ক্যানভাস করতে। আসত রাতে। মুসলিম লীগের প্রার্থী দবিরুল ইসলামকে জিতানোর জন্য নিজের বাবার দশ কাঠা জায়গা বিক্রি করেছে। অন্যের ইলিকশনের জন্য নিজের বাপের জমি বিক্রির ঘটনা এলাকায় আলোড়ন তোলে। কোহিনূর বেগম জমি বিক্রির প্রতিবাদ করেছিল।
আপনি জমি বেচতেছেন ক্যান? শীতের সকালে রান্নাঘরে পানতা ভাত পুঁটি মাছের সঙ্গে বেগুন ভাজি দিতে দিতে প্রশ্ন করে সে।
মুখের ভাত চিবাইতে চিবাইতে আমির হোসেন উত্তর দেয় ওইসব তুমি বুঝবা না।
বুঝব না ক্যান? চাইরদিকের মানুষে নানান কতা কইতেছে।
তুমি ওইসব কতায় কান দিবা না। তোমার সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে, হাস মুরগী আছে, তাদের লইয়া থাহো।
কোহিনূর বেগম তারপরও জিজ্ঞেস করে দবির মিয়ার লাইগা আপনে নিজের বাপের জমি বেচতেছেন ক্যান?
আমির হোসেন মুখের ভাত চিবানো বন্ধ করে তার দিকে তাকায়। ঠাণ্ডা ভয়ার্ত দৃষ্টি। এগারো বছরের সাংসারিক জীবনে এমন চোখ, এমন দৃষ্টি দেখেনি কোহিনূর বেগম। ভয়ে তার কলিজা কাঁপে।
আপনার লাইগা পানি আনি? পানির উছিলায় সে আমির হোসেনের সামনে থেকে উঠে যায়। ঘরের ভেতরে গিয়ে দরজা ধরে কোহিনূর বেগম নিজেকে সামলে নেয়। নিজেকে প্রশ্ন করে, মানুষটা এমন আচরণ করলো ক্যান? কোনো উত্তর পায় না কোহিনূর নিজের কাছ থেকে। পানি নিয়ে এলে পানি পান শেষে আমির হোসেন বলে- শোন, জীবন কয় দিনের? দুই দিনের জীবন। আখেরাতের লাইগা একটা কিছু তো করা দরকার। নাইলে কী জবাব দিবা আল্লারে? আল্লার লাইগা, ইসলামের লাইগা এই জমি বেচতেছি। তুমি কিছু চিন্তা কইরো না। ইলিকশনটা হউক, মুসলিম লীগ আল্লার রহমাতে ক্ষমতায় আহুক। এই জমির চাইিয়া দশগুণ জমি তোমারে আমি রাইখা দিমু।
আমির ভাই? খাওয়া শেষ হতে না হতেই দবিরুল ইসলামের লোক এনায়েত হাজির বাড়ির উঠোনে। তাড়াতাড়ি আহেন। এমপি সাব আপনার লাইগা খারাইয়া রইচে।
এইতো খারাও, আইতেছি।
মুখের পানি কুলি করতে করতে মানুষটা বের হয়ে যায়। উঠোনে বসে পান খাবে, কোথায় কোথায় যাবে, পরামর্শ করে চলে যাবে। কখন ফিরবে ঠিক নাই।
বাড়ির চারপাশের লোকেরা এসে কোহিনূর বেগমকে বলে আপনে আমির ভাইরে ফিরাইতেছেন না ক্যান? হেয় দবির মিয়ার লগে মেশে ক্যান?
আমি কেমনে ফিরামু?
হেরে কইবেন, মুসলিম লীগ জিতব না। জিতবে নৌকা। শেখ মুজিব বাঙালির নেতা। ওই অত দূরের পাকিস্তানের নেতা দিয়া আমাগো কী কাম অইব?
হেয়, রিফাতের বাপে আমার কথা হোনে না।
এত বুদ্ধিমান মানুষটা কীসের আশায় মুসলিম লীগ করল, কে জানে? দেশের কেউ না চাইলে হেয় একলা চাইলে পাকিস্তান কী জিন্দা অইবো? রাতদির খাটাকাটনির পর ইলিকশন অইল। জীবনে প্রথম বোরকা পরে ভোট দিয়া আইলো কোহিনূর বেগম। রিফাতের বাবাই তাকে ভোটকেন্দ্রে লইয়া যায়। কোলে চার বছরের রিফাত। সন্ধ্যায় রেডিওতে খবর পাওয়া গেল সারাদেশে মুসলিম লীগ মাত্র দুইটা সিট পাইচে। আর সব সিটে জিতেছে আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিবের দল। সারা গ্রামের মানুষ নৌকা, জয় বাংলা আর শেখ মুজিবের নামে শ্লোগান দিয়ে ঘুরে বেড়ালো। বাড়ির সামনে দিয়ে মিছিল যাবার সময়ে রিফাত ছোট ভাই ইসমাইলের হাত ধরে যাচ্ছিল দেখতে। মানুষটা ঘরের ভেতর শোকে পাথর হয়ে শুয়েছিল। চিলের মতো বের হয়ে রিফাতকে বেদম মারল। কোহিনূর বেগম দৌড়ে এসে না ধরলে ছেলেটাকে মেরেই ফেলত। আসলে মুসলিম লীগের পরাজয় মানুষটার ভেতরের ক্রোধ ক্ষোভ নিজের অবুঝ ছেলেটার উপর দিয়ে প্রকাশ করল। ইলিকশনে পরাজয়ের পর মানুষটা হাইস্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। সারা দিন শোকার্ত মুখে ঘরের মধ্যে থাকে। কয়েকদিন পর দবিরুল ইসলাম বাড়িতে হাজির দল-বল নিয়ে। সারাদিন গল্প হল। হাসি মশকরা হল। আলাপ-আলোচনায় কোহিনূর বেগম জানতে পারল, দেশে যুদ্ধ আইতেছে। পাকিস্তানীরা শেখ মুজিবরে বিশ্বাস করে না। সে এবং আওয়ামী লীগ ইন্ডিয়ার দালাল। তাগো হাতে দেশ ছাইরা দিলে ইসলাম ধ্বংস অইয়া যাইবে। কোহিনূর বেগম রান্নাঘরে রান্না করে মেহমানদের খাওয়ায়।
কয়েক দিন পর সত্যিই গ্রামে মিলিটারি আসে। পাকিস্তান সরকার রাজাকার বাহিনী গঠন করলে রিফাতের বাবা আমির হোসেন কমান্ডার হয় জোলাগাতি ইউনিয়নের। এলাকার মানুষ, যারা শেখ মুজিবের দল করেছে তারা বনে জংগলে পালিয়ে বেড়ায়। কোহিনূর বেগম পড়ে মুশকিলে। একই গ্রামের মানুষ, একই মহল্লার মানুষ শত্রু হইলো কেমনে? তাগো মারতে অইবো ক্যান? তার হয়েছে বাড়তি জ্বালা। যখন তখন রাজাকার বাহিনী নিয়ে এসে বলে, ভাত দেও। আবার রান্ধন, আবার বাড়ন। কত আর পারা যায়? চারপাশ থেকে তাদের বাড়িটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কোনো মানুষ এখন আর তাদের বাড়িতে আসে না। এমন কী রিফাতের সঙ্গে গ্রামের কোনো ছেলে-মেয়েরা খেলে না। কথা বলে না। সবাই ওকে ভয় পায়। পাশের বাড়ি কোহিনূর বেগম নিজে বেড়াতে গেছে। তাকে দেখে সবাই দ্রুত চলে যায়। যারা সরে যেতে পারে না, তারা এমনভাবে কথা বলে, যেন অনেক দূরের একজন মানুষ সে। এইমাত্র দেখা হয়েছে। অথচ এই মানুষজনদের সঙ্গে তার কয়েকদিন বা মাস আগেও কী নিবিড় যোগাযোগ ছিল! তার মনে হয়, সে একটা ছাড়া-বাড়িতে আছে। তার চারপাশে কোনো মানুষ নেই। সব কিছুর জন্য আমির হোসেন দায়ী। অথচ তাকে কিছু বলতে পারে না সে।
একদিন উঠোনে দু’জন ছেলেকে ধরে এনে বাঁধে কাঁঠাল গাছের সঙ্গে। একটা ছেলের গোফও ওঠেনি। এতদিন মানুষের কাছে শুনে এসেছে রিফাতের বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে খুঁজে গুলি করে রাস্তায় ফেলে রাখে। তাদের বাড়ি ঘরে আগুন দেয়। বিশ্বাস হয় নি কোহিনূরের। কিন্তু উঠোনে বাঁধা ছেলে দু’টোকে দেখে বিশ্বাস করতেই হলো। সে রান্নাঘরের ফাঁক দিয়ে দেখতে থাকে। দবিরুল ইসলামের বড় ঘেটু এনায়েতের এক হাত রাইফেল অন্য হাতে কাফুলার লাটি। ছেলে দু’টিকে বেদম মারছে। ছোট ছেলেটা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে আর বড়টা ভেউ ভেউ কাঁদছে। চারপাশে বেশ কয়েকজন রাজাকার। তারা হাসছে। রাজাকারদের একজন এনায়েদের কাছ থেকে কাফুলার লাঠি নিয়ে হাঁটুর উপর পিটাতে শুরু করে আর জিজ্ঞেস করে, এহন তোর মজিবর আব্বায় কই? আমাগো হাত দিয়া তোগো কেডায় বাঁচাইবে? মুক্তি অইচো? আমাগো মারতে চাও?
ছেলে দু’টোর মাথা ঘাড় থেকে ঝুলে পড়ে।
রিফাত ভয় পায়। জিজ্ঞেস করে, মা অগো মারছে ক্যান?
মুখে আঁচল চাপা দিতে বলে কোহিনূর বেগম, জানি না বাজান।
মা, মুক্তি কী?
ওই ছেলে দুইডা মুক্তি।
মুক্তি কী খারাপ মা?
রিফাতের প্রশ্নে আগেই দলবল নিয়ে উঠোনে ঢোকেন দবিরুল ইসলাম আর রিফাতের বাবা। তাদের দেখে ছেলে দু’টোর উপর লাঠির মার আর বাড়িয়ে দেয় এনায়েত। সে তার শরীরের তাগদ দেখায়। অন্যরা হাসে। যেন মজার একটা কিছু হচ্ছে।
এ্যাই হোন, অগো সামনে লইয়া আয়, আদেশ দেয় দবিরুল ইসলাম।
এনায়েদ ও তার লোক জনে ছেলে দু’টিকে কাঁঠাল গাছের বাঁধন থেকে ছুটিয়ে এনে উঠোনে দাঁড় করায়। ছেলে দু’টিকে ঘুরে ঘুরে দেখে দবিরুল ইসলাম আর আমির হোসেন। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে ছেলে দু’টোর মুখোমুখি দাঁড়ায় দবির, তাকায় বড় ছেলেটার দিক, এ্যাই হারামজাদা তোর নাম কী ?
‘পানি। পানি খামু’ বড় ছেলেটা ফোপাতে থাকে।
পানি পরে খাইবি। আগে ক’ তোগো নাম কী?
আমার নাম জাহিদুল।
ছোট ছেলেটার সামনে দাঁড়ায় দবিরুল। মুখে পান। আয়েশ করে চিবুচ্ছে আর ধীরে ধীরে কথা বলছে দবিরুল ইসলাম। ডান হাতের অনামিকায় চুন। অনামিকা থেকে এক চিমটি চুন মুখে দিয়ে জিজ্ঞেস করে তোর নাম কী?
শিমূল।
হিন্দু না মোসলমান?
ছেলেটা বেশ চালাক। উত্তর দেয় কৌশলে, আমার বাপরে নাম মিসবাউর রহমান।
আহারে, দুইডাই মোসলমানের পোলা! আফসোস! আফসোসের সঙ্গে দবিরুল ইসলাস জাহিদ আর শিমূলকে ঘিরে হাঁটে। তার পিছে পিছে হাঁটে বান্দা গরুর মতো রিফাতের বাবা। রিফাতের বাবার এই মোসাহেবী ভালো লাগে না কোহিনূর বেগমের।
তোগো বাড়ি কই?
বেলপাড়া।
বেলপাড়া? নিজের মনে কথা বলে কোহিনূর বেগম। নিজের গ্রাম। এই তালতলা গ্রাম থেকে তিনটে গ্রামের পরই বেলপাড়া গ্রাম। শিমূল বলেছে ওর বাবার নাম মিসবাউর রহমান। মিসবাউর স্যারের কাছে প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত পড়েছে সে। তার কাছেই হাতে খড়ি হয়েছিল। হায় আল্লাহ, সেই মিসবাউর স্যারের ছেলেই কোহিনূর বেগমের বাড়িতে আর মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে?
শোন, তোরাও মোসলমান। আমরাও মোসলমান। আমরা ভাই ভাই। কী দরকার ওই হিন্দুগো লগে থাইকা দেশটারে টুকরা টুকরা করার? পাকিস্তানে আমরাতো ভালোই আছি। তোগো আমি মাফ কইরা দিতে পারি, যদি আমাগে রেজাকার দলে যোগ দেও। তার আগে অবশ্য তোগো একটা কাম করতে অইবো।
কী কাম? জানতে চায় জাহিদূল।
উঠোনে থুতু ফেলে দবিরুল ইসলাম। পান খাওয়া মুখের শ্লেষ্মা মিশানো এক দলা নিকৃষ্ট থুতু উঠোনের ধুলোয় লেপ্টে গেছে। চারদিকে তাকায় দবিরুল ইসলাম। রাজাকার আর মজা দেখতে আসা লোকজনের কাছ থেকে এক ধরনের অনুমোদন নেয় সে, মুক্তিতে নাম লেখাইয়া তোরাতো ইসলাম থেইকা খারিচ অইয়া গেচো। ইসলামে নতুন কইরা সামিল হওয়ার আগে আমার থুতু চাইটা চাইটা খাইতে অইবে তোগো।
সঙ্গে সঙ্গে শিমূল নিজেও থুতু ফেলে উঠোনে। মনে হলো দবিরুল ইসলামের চওড়া গালে কেউ থাপ্পর মারল। তার শ্বাপদ দাঁত বেরিয়ে পড়ে। চোখ হিংস্র হয়ে ওঠে। আমির হোসেন ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে শিমূলের ঘাড় ধরে মাথা মাটিতে নামিয়ে আনে। তাকে সাহায্য করে তিন-চারজন রাজাকার।
শিমূলের মুখটা মাটিতে এনে দবিরুলের থুতুর উপর মুখ নিতে বাধ্য করতে চায়। শিমূল শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করছে। জাহিদুল বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। অন্যরা মজা দেখছে। শিমূলের মাথা নিচে নামাতে পারছে না চারজনে মিলেও। মাটিতে পা আটকিয়ে শিমূল প্রতিরোধ করে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা রাজাকার পিঠে কাফুলা কচার বাড়ি দেয়। শিমূল এক খণ্ড মাটির মতো মাটিতে শুয়ে পড়ে। মুখ থেকে বেরোয় এক ধরনের জান্তব শব্দ, গো ... গো... গো।
কী যে হয় কোহিনূর বেগমের, কী যে ভর করে তার উপর, সে নিজেও বুঝতে পারে না। সে বাতাসের গতিতে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসে। আসতে আসতে কোমরে আঁচল বাঁধে। তাকে আসতে দেখ আমির হোসেন হতম্ভব। সে শিমূলকে ছেড়ে দাঁড়ায়। চোখ বিস্ফোরিত। তাকে দেখে অন্যরাও বিচলিত। কোহিনূর বেগম নুয়ে শিমূলকে ধরে, তাকায় দবিরুলের দিকে, এতগুলান মানুষ দুইটা বাচ্চার লগে শক্তি দেহাইতেছেন, লজ্জা হরে না? তাগদ থাকলে যান না মুক্তিযোদ্ধাগো লাগে বন্দুক লইয়া লড়াই করেন। আমার হাতে খড়ি দিছিল মিসবাউর স্যার, হের পোলা আইজ আমার বাড়ির উঠানে! আয় বাজান, আয়।
কোহিনূর বেগম অনেক কষ্টে টেনে তোলে শিমূলকে। দবিরুল ইসলাম, আমির হোসেন, এনায়েত- স্থির। পাথর। বাকীরাও নির্বাক। তাকায় জাহিদুলের দিকে, তুমিও আহো আমার লগে। জাহিদুল এগিয়ে এসে দাঁড়ায় কোহিনূর বেগমের পাশে। তাকায় দু’জন। জাহিদুল ধরে শিমূলকে। তিনজনে ঢুকে যায় ধীরে ধীরে রান্নাঘরে। ওদের পেছনে পেছনে রিফাত। পুরো ঘটনা ঘটতে তিন থেকে চার মিনিট সময় লাগে। দবিরুল ইসলাম তাকায় আমির হোসেনের দিকে। আমির হোসেন মাথা নিচু করে থাকে। তারা দলবল নিযে বাড়ি থেকে চলে যায়। কোহিনূর বেগম জাহিদুল আর শিমূলকে পেট ভরে ভাত খাইয়ে হাতে কিছু টাকা, পুরোনো জামা ধরিয়ে দিয়ে বাড়ির পেছন থেকে নামিয়ে দেয়। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে আমির হোসেন। খুব ভয়ে আছে কোহিনূর বেগম। ছেলে দু’টো চলে যাবার পর রাত যত বাড়ছে সে ভয়ে ছটফট করছে। বাড়ি এসে আমির হোসেন কী করবে? কী বলবে? তাকে মারবে? মারুক। খাবে মার। কিন্তু ছেলে দু’টোকেতো বাঁচাতে পেরেছে, তাতেই সে খুশি। দরজা খুলেই আমির হোসেন পিটাতে শুরু করে কোহিনূর বেগমকে। হাতে উঠানে ফেলে দেওয়া দুপুরের কাফুলার লাঠি। কোহিনূর বেগম নিঃশব্দে মার খায়। মার খেতে খেতে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। শব্দ করে কাঁদছে না। পাছে কেউ টের পায়। দরজার আড়াল থেকে মায়ের উপর পিতার পাশবিক নিপীড়ন দেখে রিফাত।
এই ঘটনা ঘটার মাসখানেক পরই এলাকার মুক্তিযোদ্ধরা প্রবলভাবে আক্রমণ শানাতে শুরু করে। আমির হোসেনদের স্কুলে পাকিস্তানী আর রাজাকারেরা মিলে ক্যাম্প করেছিল, এক রাতের আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা স্কুলটাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। অনেক পাকিস্তানীদের সঙ্গে অনেক রাজাকারও মারা যায়। আমির হোসেন সেই রাতে ক্যাম্পে ছিল। অনেক কষ্টে রাতের অন্ধকারে ন্যাংটো শরীরে বাড়ি আসে। জামা-কাপড় পরে বাইরে গোয়াল ঘরে রাত কাটায়। তারপর থেকে নিয়মিত গোয়ালঘরেই থাকতে শুরু করে সে। দিনের বেলা খুব সাবধানে চলে। মুক্তিযোদ্ধরা দিনেও আক্রমণ করে বাতাসের সঙ্গে মিলে যায়। চারদিকে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে হরেক রকম আলোচনা। কোহিনূর বেগম দিশেহারা। আমির হোসেনকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে মেরে ফেললে সে কোথায় যাবে তিনটি বাচ্চা নিয়ে? দবিরুল ইসলামকে ধরে মুক্তিরা গুলি করে পুলের খাম্বায় বেঁধে রেখেছে। জোয়ার ভাটায় তার লাশ ভাসে। এনায়েত নাকি গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল। শিয়াল আর কুকুর মিলে তার শরীরের মাংস খেয়েছে। হাড়গোড় পরে আছে। ঘরে বসে নানা লোকের কাছে এসব শোনে কোহিনূর বেগম আর ভয়ে অজানা আশংকার কুঁকড়ে থাকে।
অক্টোবরের এক সকালে আমির হোসেন ধরা পরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে, বাড়ির দরজায়। সে খুব ভোরে গিয়েছিল পায়খানায়। কাজ সেরে আসতেই ওৎ-পেতে থাকা মুক্তিযোদ্ধরা ধরে খালের পারে নিয়ে যায়। শোনা যায় তখন নাকি সে মুক্তিযোদ্ধাদের পা ধরে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। কিন্তু খালপারে এনেই সেখানেই তাকে গুলি করে ফেলে যায় তারা। গুলির শব্দে ঘুম ভাঙ্গে কোহিনূরের। বুকটা তার যন্ত্রণায় মোচড়াতে থাকে। সে দৌড়ে খালপারে গিয়ে দেখে আমির হোসেনের লাশ অর্ধেক খালে আর অর্ধেক রাস্তায় পড়ে আছে। লাশটা স্পর্শ করে। তখনও গরম। উষ্ণ। লাল রক্ত গড়িয়ে খালে পড়ছে।
লাশ নিয়ে কী করবে একা একজন কোহিনূর বেগম? কেউ আসছে না তাকে সাহায্য করতে। শেষে বাড়ির কাছের দু’জন মহিলার হাত পা ধরে তাদের সাহায্যে আমির হোসেনের লাশ টেনে এনে কোনোভাবে মাটি চাপা দিয়ে রাখে। সারাদিনে একটুও কাঁদেনি সে। প্রিয়জন মারা গেলে কান্না আসে, শোকে বুক থৈ থৈ করে, কিছুই তার ভেতরে কাজ করে নি। লাশ মাটিচাপা দিয়ে ঘরে আসার পর কোহিনূর বেগমের মনে হলো জগৎ সংসারে সে একা, একদম একা। কেউ কোথাও নেই। শরীর মন-প্রাণ ভেঙে কান্না নামে তার। সারা রাত কেঁদেছে। রিফাত, ইসমাইল সারা রাত না খেয়ে ঘুমিয়েছে। মেয়ে যমুনা পেটে, টের পেয়েছে আমির হোসেন মারা যাওয়ার পনেরো বিশ দিন পর। সেই থেকে শুরু হলো কোহিনূর বেগমের অবিশ্রান্ত সংগ্রাম। ছেলে-দু’টোকে মানুষ করা, মেয়েটাকে বড় করা, বিয়ে দেওয়া সবই করেছে সে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে তার মনের প্রশ্ন, ওদের বাবা কেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলো? মানুষটা তো খারাপ ছিল না। বুদ্ধি বিবেচনাও ভালো ছিল। এলাকার সালিশিতে সে মানুষের কত সমস্যা মিটিয়েছে। সেই মানুষটি কেন এমন ভুল বা অন্যায় কাজে অংশ নিলো? ধর্ম কী মানুষকে অমানুষ তৈরি করে? নাকি স্বার্থ? তার মনের ভেতরের এই প্রশ্নের উত্তর সে এখনও পায়নি। কিন্তু একা একা খুঁজে বেড়াচ্ছে।
বাজান, তোমার বাপরে কারা মারছে, তুমি জানো না?
জানি মা।
জানলে ক্যান আমারে জিগাও।
আমি একটা উত্তর চাই মা, কেন আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে গিয়েছিল? আমি এই মুখ দেখতে আমার ঘৃণা হয়। আমি এই দেশের আকাশে তাকাতে পারছি না। মাটিতে পা রাখতে পারছি না। সবুজ বৃক্ষের দিকে তাকাতে পারি না। প্রবহমাণ জলের দিকে তাকাতে পারছি না। তাকালেই ওরা হাসে, ওরা উপহাস করে। আমাকে বলে এই দেশে তোর না। এই মাটি তোর না। এই আকাশ, আকাশের নীল, জলের ধারা তোর না। আমি কী করতে পারি? বলো মা, আমি কী করব?
কোহিনূর বেগম ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন।
তোমাদের কী ভূতে পাইচে? ইসমাইল এতদিন পর এইসব নিয়ে কথাবার্তায় খুব বিরক্ত। দেশের সব মানুষ সব ভুইলা গেচে। এহন রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধা এক লগে নাস্তা খায়। একজনার ছেলে-মেয়ের লগে বিয়ে শাদি দ্যায়। খালি তোমরা আছো রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধা লইয়া, বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় সে। বোন যমুনার বাবা বিষয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। যমুনাতো আমির হোসেনকে দেখেই নি। মানুষের মুখে মুখে বাবার মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী অবস্থানের কথা শুনেছে। তাতে ওর কিছু যায় আসে না। সে তার জীবন ও সংসার নিয়ে ভালোই আছে। ইতিহাস থাকুক ইতিহাসে।
কিন্তু রিফাত নিজে বাবা আমির হোসেনকে একটা পাথরই মনে করে। জগদ্দল পাথর। তার বুকের উপর চেপে বসেছে। রিফাতের শ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। যতদিন যাচ্ছে আরও সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে পিতার কবর। কারণ, বাড়ির ভেতরে ঢুকতে ও বেরুতে এই কবরের পাশ দিয়ে যেতে হয়। যতবার যায়, ততবারই দেখতে হয় করবটাকে। চেতনে-অবচেতনে কবরটা তাকে নরকের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ক্রোধে তার শরীর-মন বিষাক্ত হয়ে ওঠে। কীভাবে এই নরক যন্ত্রণা থেকে রিফাত মুক্তি পাবে? অনেক ভেবে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমির হোসেনের লাশ, লাশের মাটি, কবর উৎখাত করতে পারলেই সে মুক্তি পাবে। সে মুক্ত মানুষ হিসেবে শ্বাস নিতে পারবে।
বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছে রিফাত। জানে, কেউই তার প্রস্তাব মেনে নেবে না বা সমর্থন করবে না। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে অর্জিত দেশটা ভাগ বাটোয়ারার দেশে পরিণত হয়েছে। যেভাবে পারছে দেশটাকে খাবলে খাবলে খাচ্ছে। সেখানে সে উপহাসের পাত্র হতে চায় না। নিজে চেতনার রঙে পান্না হয়ে এই কঠিন ও মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
মোরগ ডাকছে। রাত শেষ। শেষ রাতে কবরের মাটির শেষ আগলে ভরে মাথায় নেয় রিফাত। চলে আসে খালের পারে। একটু একটু ঘামছে সে। মাথার আগলের মাটি নিয়ে খালের পারে দাঁড়ায়। ভোরের আবছা আলোয় সামনে একজন মানুষ। পাশের বাড়ির ছয়ফুর মোল্লা। যাচ্ছে মসজিদে নামাজ পড়তে। শেষ রাতে রিফাতের মাথায় মাটি সমেত আগল দেখে অবাক।
তোমার কী মাথায়?
মাটি।
কিয়ের মাটি?
আমার বাজানের কবরের মাটি।
হতম্ভব সয়ফুর মোল্লা। সে মাথা নুইয়ে রিফাতকে ভালো করে দেখে। কোনো ভুল হচ্ছে নাতো? সাত সকালে মাথায় বাপের কবরের মাটি নিয়ে সত্যি কে দাঁড়িয়ে তার সামনে? কোনো ভূত-টুত নয়তো? সয়ফুর মোল্লার মাথায় পাঁগড়ি। মুখে কাচা পাকা চাপ দাড়ি। চওড়া কপাল। কপালে ভাজ পড়েছে বেশ কয়েকটা।
মাটি কর কী?
খালে ফালাইয়া দিতাচি।
বাপের কয়বরের মাটি খালে ফালাইতেচো ক্যান?
আমার বাপ রাজাকার ছিল। একজন বিশ্বাসঘাতকের কবরের মাটি দেখতে আর ইচ্ছা করছে না। তাই কবর খুঁড়ে সব মাটি ফেলে দিলাম, বলতে বলতে আগল ভরা মাটি খালে ফেলতে থাকে। মাটি খালে পড়ে পানিতে শব্দ করছে। মাটি ফেলে তাকায় রিফাত। সয়ফুর মোল্লা নেই।
সে দৌড়াচ্ছে। একাত্তর সালে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সে-ও রাজাকার ছিল। রাজাকার কমান্ডার আমির হোসেনের সঙ্গে মিলে কত বাড়ি লুট করেছে, কত হিন্দু মেয়েদের... কত মুক্তিযোদ্ধা নিজের হাতে জবাই করেছে! সে-সব জানে না ছেলেটা। জানলে... সে, সয়ফুর মোল্লা দ্রুত দৌড়াচ্ছে। মিহি সকালে ছেলেটাকে একাত্তরের একজন গেরিলার মতো নির্দয়, নির্মম আর নিশানা ভেদী মনে হচ্ছে।
দৌড়ের চোটে তার মাথার পাঁগড়ি পেছনে হটি বনে পড়ে হাসছে। কাপড় ভিজে নাপাক হচ্ছে। কোনোদিকে খেয়াল নেই। সে দৌড়াচ্ছে...